বিশ্বের প্রথম পাঁচশোর তালিকায় কেন নেই বাংলাদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়?


 
আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সময় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বিরোধিতা করেছিলেন, এমন একটা মতবাদ এদেশে প্রচলিত আছে। বিষয়টি যদিও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয় এবং রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতার কোনও অকাট্য প্রমাণও তেমন নেই, তারপরেও এই ধারণাটি বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় এবং এই বিষয়টি নিয়ে আজও এ-দেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল চর্চা অব্যাহত। শতাধিক বছর আগে কলকাতার শিক্ষিত ও অভিজাত হিন্দু সমাজ কীভাবে পূর্ববঙ্গে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বাধা দিয়েছিলেন ও রবীন্দ্রনাথও তাতে সায় দিয়েছিলেন কি না– এ নিয়ে বাংলাদেশে তর্কবিতর্ক এখনও চলছে।

বিতর্কটি এই প্রতিবেদনের পটভূমিতে কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক নয়, কারণ স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জনমানসে কতটা গর্ব ও গৌরবের জায়গা দখল করে আছে, এটা তার একটা ছোট উদাহরণ। এদেশে নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের আঁতুড় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বারে বারে আত্মপ্রকাশ করেছে, কিন্তু পাশাপাশি আন্তজার্তিক শিক্ষাঙ্গনে ক্রমেই হারিয়েছে গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা।

রূঢ় বাস্তবতাটা হলো, এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই বলি বা আজকের বাংলাদেশে অন্য যে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্বের প্রথম পাঁচশো ইউনিভার্সিটির র‍্যাঙ্কিংয়ের ধারেকাছেও কিন্তু নেই! পঞ্চাশ বছরের ‘নবীন’ একটি দেশের জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে লজ্জা না হোক, এটি একটি বিড়ম্বনার বিষয় বইকি!

আরও পড়ুন: বাংলাদেশ তার নীরব মোদি ও বিজয় মাল্য-দের নিয়ে কী করছে?

পরিসংখ্যান বলছে, লন্ডনভিত্তিক ‘কিউ এস লিস্ট’ প্রতি বছর সারা বিশ্বের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে ‘গ্লোবাল ইউনিভারসিটি র‍্যাঙ্কিং’ প্রকাশ করে থাকে তাতে গত এক যুগেও বাংলাদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় ঠাঁই পায়নি। কোন মাপকাঠিতে এই প্রতিষ্ঠান এই র‍্যাঙ্কিং করে থাকে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলো আন্তর্জাতিক মানের নিরিখে বহু পিছিয়ে পড়েছে, তা নিয়ে কোনও সংশয়ের অবকাশ নেই। সেটা কেন আর কীভাবে, এই প্রতিবেদন তারই তত্ত্বতালাশ করার চেষ্টা করেছে।

২০১০ সালে এককভাবে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা হলো কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডস (কিউএস)। লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে ৮ জুন সদ্য-প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাঙ্কিং ২০২৩।

গত এক যুগের ধারাবাহিকতায় এবারও কিউএস ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিং ২০২৩-এ বিশ্বসেরা পাঁচশো বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করে নিতে পারেনি বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কিউএস কর্তৃপক্ষ এই বছরের রাঙ্কিংয়ের জন্য বিশ্বব্যাপী ১৪০০ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মূল্যায়ন করেছিল যার মধ্যে কোনও বাংলাদেশি সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষ স্তরে স্থান পায়নি। উল্লেখ্য, ২০১০ থেকে এই পর্যন্ত বাংলাদেশি কোন বিশ্ববিদ্যালয় সেরার তালিকায় নেই। বরং রয়েছে তালিকার পিছনের সারিতে এবং বছর ঘুরতেই যেন এক ধাপ করে নিচে নেমে যাচ্ছে তালিকায় থাকা বাংলাদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম।

কিউএস র‍্যাঙ্কিং ২০২৩ সেরা ৫০০-তে না আসতে পারলেও বাংলাদেশের দুটো শীর্ষস্থানীয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সেরা ১০০০-এর শেষ ২০০-তে অবস্থান করছে।

এক নজরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)-র গত এক যুগের কিউএস ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিংয়ের অবস্থান দেখে নেওয়া যাক ছবিতে।

QS World Ranking Dhaka University

অন্যদিকে বাংলাদেশের আরেকটি শীর্ষস্থানীয় সরকারি ইন্সিটিউট প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কিউএস ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিংয়ের পেছনের সারিতে গত পাঁচ বছর ধরে একই (৮০১ থেকে ১০০০) অবস্থানে রয়েছে।

এছাড়াও কিউএস র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্র্যাক ও নর্থ সাউথের অবস্থান রয়েছে ১০০১ থেকে ১২০০ এর মধ্যে । গত বছরও এই দুই বিশ্ববিদ্যালয় একই অবস্থানে ছিল।

কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডস (কিউএস) ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিং মূলত অ্যাকাডেমিক খ্যাতি, নিয়োগকর্তার খ্যাতি, অনুষদ-ছাত্র অনুপাত, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক এবং কর্মসংস্থান ফলাফলের মতো পরামিতিগুলির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় এবং তারা ৫০০ এর নিচের তালিকায় বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য নির্দিষ্ট অবস্থান সংজ্ঞায়িত করে না।

টানা ১১তম বার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি কিউএস ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা দখল করেছে। ইউনিভার্সিটি অফ কেমব্রিজ নিজেদের অবস্থানকে ৭ম স্থান থেকে উন্নত করে এবছর দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছেছে।

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি এবং ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি পর্যায়ক্রমে ৩য়, ৪র্থ, ৫ম এবং ৬ষ্ট তম অবস্থানে রয়েছে।

৯টি ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবছর শীর্ষ ৫০০-তে জায়গা করে নিয়েছে এবং ৩টি পাকিস্তানি বিশ্ববিদ্যালয়ও শীর্ষের তালিকায় রয়েছে। মোট ২৬টি এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান অর্জন করেছে।

কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমস্যাটা ঠিক কোথায় হচ্ছে?

বস্তুত বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন শিক্ষা এবং গবেষণার মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষা খাতে মোট জিডিপির ৪% থেকে ৬% বরাদ্দের প্রয়োজন কিন্তু এই হার ১% থেকে ২% এর মধ্যেই রয়েছে যেটা কিনা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। ফলে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী হিগস-বোসন পার্টিকল (তখন অবশ্য নামকরণ হয়নি) নিয়ে গবেষণা করেছেন, সেখানে আজ আর আন্তর্জাতিক মানের কোনও গবেষণা হয় না বললেই চলে।

আসলে উচ্চশিক্ষা খাতে, বিশেষ করে গবেষণার ক্ষেত্রে যতটা অর্থের প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক কম বরাদ্দ থাকে। দেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মান বাড়াতে আরও বেশি অর্থের প্রয়োজন এমনটাই বলে আসছেন বাংলাদেশের শিক্ষাবিদরা। শিক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে বিনিয়োগের কমতির কারণে বাংলাদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিউএস ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিং-এর মতো উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে দীর্ঘ এক যুগ ধরে ব্যর্থ হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা ব্যাখ্যা করেছেন।

বাংলাদেশের শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে নজর দিলে এবং শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ করলে অ্যাকাডেমিক ও গবেষণার মান উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্বের শীর্ষ ৫০০-র তালিকায় বাংলাদেশও উঠে আসতে পারবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম পরিষ্কারভাবে বলেন, একটা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে যখন খারাপ পারফরম‍্যান্স করে, নিম্ন স্কোর করে, তখন সামগ্রিক স্কোর পতনের দিকে ধাবিত হবেই।

“র‍্যাঙ্কিংয়ে ভালো অবস্থান অর্জনের জন্য গবেষণাই মুখ্য। আমাদের গবেষণার মান ভাল নয় বলে আন্তর্জাতিক মান পূরণ করতে ব্যর্থ হয়”, তাঁর পর্যবেক্ষণ।

তিনি আরও বলেছেন, গবেষণা, আন্তর্জাতিক ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত এবং কর্মসংস্থানের ফলাফল যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্রুত খ্যাতি অর্জনে সহায়তা করে তাই ভালো গবেষণার কাজের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা এবং পর্যাপ্ত তহবিল একটি পূর্বশর্ত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেছেন, “আমাদের এখন মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়ন ও গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তার করা । বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ দুটি ক্ষেত্রে যেভাবে উন্নয়ন ঘটেছে, তাতে আমরা এই দুই খাতে উন্নয়ন না করলে আরও পিছিয়ে পড়বো।”

“বর্তমানে র‌্যাঙ্কিংয়ের বিষয়ে আমাদের আপাতত মনোযোগ নেই। সারা পৃথিবী র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে যাক, আমরা পিছিয়ে থাকি। আগে আমরা মৌলিক ভিত মজবুত করি”, খানিকটা সাফাই দেওয়ার ঢংয়েই তিনি মন্তব্য করেছেন।

ঘটনাচক্রে যেদিন এবছরের কিউএস লিস্ট প্রকাশিত হলো, ঠিক তার পর দিনই (৯ জুন) বাংলাদেশে আগামী অর্থ বছরের বাজেট পেশ করলেন দেশের অর্থমন্ত্রী আহম মোস্তফা কামাল। এবং সার্বিকভাবে দেশের শিক্ষাঙ্গনকে হতাশ করে তিনি শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বাজেট বরাদ্দ আনুপাতিক হারে বেশ কমিয়েও দিলেন। গত বছরেও যেখানে শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল শতকরা হারে ১৫.৭ শতাংশ, এবছর সেটাই কমে দাঁড়াল ১৪.৭ শতাংশে।

বাংলাদেশের ইউজিসি-র (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান তো তার হতাশা গোপন করতে না-পেরে বলেই ফেললেন, “এটা মোটেই বাস্তবসম্মত হয়নি। কোভিডে স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাঙ্গনে ফিরিয়ে আনতে যেখানে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার ছিল, সে জায়গায় উল্টে বরাদ্দ কমানো হল!” অথচ বাজেটের পরদিনই শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানিয়ে দিলেন, বাজেটে শিক্ষাখাত যা বরাদ্দ পেয়েছে তাতে তিনি ‘অত্যন্ত খুশি’।

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন!

 

More Articles