চোখ ধাঁধানো আলো-শব্দের খেলা, লক্ষ ভক্তকে চমকে দিতে তৈরি দক্ষিণেশ্বর

এবার বাঙালির প্রিয় দক্ষিণেশ্বরের বুকে আলো এবং শব্দের সাজে সেজে উঠল ইতিহাস। এই দিন ছিল দক্ষিণেশ্বরের ১৬৭তম প্রতিষ্ঠা বর্ষও বটে। ১৬ জুন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এই বিখ্যাত কালী মন্দির।

আকর্ষণীয় 'লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো' কে না ভালবাসে! ভারতের ঐতিহাসিক জায়গাগুলিতে এই শো এক অন্য মাত্রা যোগ করে। আগ্রা ফোর্টের সামনে সিঁড়িতে বসে বসে দর্শক যখন দেখেন হেঁটে যাচ্ছেন কোনও এক মুঘল সম্রাট, তাঁকে চোখে দেখা যায় না বটে, কিন্তু একের পর এক আলো জ্বলে ওঠে, ভেসে ওঠে পায়ের শব্দ— সব মিলিয়ে রহস্যাবৃত সেই সন্ধ্যা তাঁদের মনে দীর্ঘকালীন ছাপ ফেলে যায়। আলো এবং শব্দের খেলায় মন মাতিয়ে খুব সহজেই ইতিহাস সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করে তোলা যায় মানুষকে। গল্পের ছলে বলে চলা কাহিনি সাধারণ মানুষ স্মৃতিতে রাখতে বেশি সক্ষম। আর উপভোগ্য গল্প কে না ভালবাসে! কিন্তু বাংলার কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এমনটা দেখা গিয়েছে কি কখনও? উত্তর, খুব সম্ভবত, ‘না’।

১৬ জুন যে দৃশ্যের সাক্ষী থাকল বাংলা তথা ভারত- এই দৃশ্য এর আগে বাংলায় কখনও অনুষ্ঠিত হয়নি। উড়িষ্যার কোনারক মন্দির বা গুজরাতের সোমনাথ মন্দিরে অবশ্য এর চল রয়েছে অনেকদিনই। কিন্তু এবার বাঙালির প্রিয় দক্ষিণেশ্বরের বুকে আলো এবং শব্দের সাজে সেজে উঠল ইতিহাস। এই দিন ছিল দক্ষিণেশ্বরের ১৬৭তম প্রতিষ্ঠা বর্ষও বটে। ১৬ জুন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এই বিখ্যাত কালী মন্দির। বেলা ঠিক চারটে বাজতে না বাজতেই শুরু হল এই শো। একে একে রানি রাসমণি, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো চরিত্রও ভেসে উঠলেন দর্শকদের চোখের সামনে।

এই দিন আগে থেকেই মন্দির কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে জানান দেওয়া হয়েছিল, “শ্বেতপাথরের সিংহাসন ও যুগাবতার শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের পবিত্র প্রচ্ছদ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভক্তসাধারণের দর্শনের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।” নাটমন্দিরের উল্টোদিকে ‘ইউ’ আকৃতিতে বসানো হয়েছিল দর্শকদের। শিবমন্দির এবং শ্রীরামকৃষ্ণের শয়নকক্ষের বারান্দা আর সিঁড়ি থেকেও এই দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখানে প্রায় কয়েক হাজার দর্শক যাতে একসঙ্গে শো দেখতে পান, তেমন ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন: লোহার চেনে গঙ্গাকে বেঁধে ফেলেছিলেন, শূদ্র কন্যা রাসমণি উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠতম মুখ

দু'দিনের দিল্লি সফর শেষ করে ১৬ জুন কলকাতা ফিরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই অনুষ্ঠানটির উদ্বোধন করেন। নাটমন্দিরকেই মূল পর্দা হিসেবে ব্যবহার করা হয় এই শো-তে। ভবতারিণী মন্দির, রাধাকৃষ্ণ মন্দির, অফিস ব্লক ইত্যাদিকে ঘিরে লেজারের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় ইতিহাসের আবহে নানা গল্পচিত্র। কখনও রামকুমার পুজো করছেন, কখনও রাসমণির স্বপ্নাদেশ– ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে গল্প। ১৮৫৫ সালে নির্মিত এই মন্দিরের দীর্ঘ ইতিহাস, এক শূদ্র নারীর হাতে তৈরি মন্দিরের অনন্যতা, শ্রীরামকৃষ্ণের কালীদর্শন, তাঁর সাধনা, তাঁকে ঘিরে নানা গল্প, বাংলার নবজাগরণ, সেই সময় তার সম্পূর্ণ প্রতিবেশ-সহ হাজির হয় এই লেজার আর শব্দ বুননের ফাঁকে ফাঁকে। উঠে আসেন স্বামী বিবেকানন্দ অতীত থেকে বর্তমানের নাটমন্দিরের গায়। জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের গল্প, উনিশ শতকের একটা বড় অংশ ফুটে উঠেছিল এই শো-তে। রামকৃষ্ণর নির্দেশে বারবার কালীর ঘরে ঢুকছেন আর বেরোচ্ছেন নরেন, এর সঙ্গে নেপথ্যে বেজে উঠছে– ’মন চলো নিজ নিকেতনে’। এমন সব প্রাসঙ্গিক গানে, গল্পে ভরপুর সন্ধ্যা উপহার পেলেন দর্শকরা।

মন্দির চত্বরজুড়েই আজ ছিল ইতিহাসের ছোঁয়া। দক্ষিণেশ্বর কতৃপক্ষের দাবি, এই রাজ্যে কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এমন শো প্রথম। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে দর্শনার্থী এবং পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার যে যে কর্মসূচি নিয়েছে সরকার, এটি তার মধ্যে অন্যতম। বেলুড় মঠ, দক্ষিণেশ্বর ও বাগবাজারকে ঘিরে জলপথে পর্যটনের সার্কিট গড়ে উঠেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশেই। দক্ষিণেশ্বরে একটি স্কাইওয়াকও নির্মিত হচ্ছে। আজ অনুষ্ঠান শুরুর সময়েই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, "কালীঘাটে ৩০০ কোটি টাকার স্কাইওয়াক বানানো হচ্ছে দক্ষিণেশ্বরের মতোই। বাংলাজুড়ে ধর্মের ওপর অনেক কাজ হয়েছে। দক্ষিণেশ্বরে কেএমডিএ আরও ১০ কোটি টাকা দেবে গেস্ট হাউসের কাজ শেষের জন্য।" আজ দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছে আগে পুজো দেন মুখ্যমন্ত্রী, তারপর একটি মিউজিয়াম চালু করার সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেন। দক্ষিণেশ্বরের ইতিহাস এবং ছবি-সম্বলিত একটি বইও প্রকাশ করেন তিনি।

দক্ষিণেশ্বরের তিনটি ঘাটের সংস্কারকার্য চালানো, গঙ্গাপাড়ের ভাঙন রোধ এবং এই অঞ্চলে যথেষ্ঠ পরিমাণে আলোর ব্যবস্থা করার জন্যও ১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর। এই প্রকল্পেই লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অছি এবং সম্পাদক কুশল চৌধুরী একথা জানান। তাঁর মতে, ‘‘এই মন্দির শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়। এর সঙ্গে লোকশিক্ষা, সমাজসংস্কার ও দেশাত্মবোধ জড়িয়ে রয়েছে। সমস্ত বিষয় একত্রিত করে সকলের সামনে তুলে ধরতেই এই পরিকল্পনা।’’ কুশলবাবু আরও জানান, মন্দির কর্তৃপক্ষই এই শোয়ের জন্য যাবতীয় দৃশ্যপটের ব্যবস্থা করেছেন। ধারাভাষ্যের জন্য খ্যাতনামা ব্যক্তিদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সুখবর, এবার থেকে নিয়মিত চলবে এই শো। গ্রীষ্ম এবং শীতে সন্ধে সাড়ে সাতটায় ভবতারিণী মন্দিরে আরতি শেষ, আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড। আধঘণ্টার শো। সপ্তাহে দুই বা তিনবার বাংলা, ইংরেজি এবং হিন্দি তিনটি ভাষাতেই দুই বার করে এই শো অনুষ্ঠিত হবে। কিছুদিন আগে এই বিষয়ে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেছিলেন, ‘‘মন্দির কর্তৃপক্ষর তরফে ঐতিহ্যশালী ওই জায়গায় লাইট অ্যান্ড সাউন্ড চালুর প্রস্তাবটি পেয়েছি। বিষয়টি ভালো, সব দিক দেখে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হবে।’’ সেই পরিকল্পনা আজ সাফল্যমণ্ডিত হল। এত ভালো মানের লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখে অভিভূত অনেকেই।

 

More Articles