গর্জাচ্ছে ইডি, বর্ষাবে ইডি? দু'দশকে ৪,৭০০ মামলা, শাস্তি মাত্র ২৩ জনের!

গত ১৭ বছরে ইডির তরফে নেওয়া ব্যবস্থার ফলে শাস্তি পেয়েছেন মাত্র ২৩ জন ব্যক্তি। সাফল্যের হার ০.০৫ শতাংশেরও কম। এই কারণেই প্রশ্ন ইডি-র এই অভিযান নিয়ে।

কেন্দ্রীয় সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট অথবা ইডি এখন অতি পরিচিত নাম। ইডিকে দুর্নীতি দমনের কাজে নজিরবিহীন ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সম্প্রতি। অনেকেই বলছেন শাসকদলের অঙ্গুলিহেলনে বিরোধী রাজনীতিকদের জব্দ করতে লাগাতার ভাবে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অভিযান হচ্ছে রাজ্যে রাজ্যে। তবে সবচেয়ে সাড়া ফেলা ঘটনা ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গেই। পশ্চিমবঙ্গের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও পার্থর ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা, সোনাদানা ইডির অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছে। পার্থ চট্টোপাধ্যায় রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিবও ছিলেন। ইডির হানার পরে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখতে মন্ত্রিসভায় রদবদল করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলাবাহুল্য, ইডির গোয়েন্দারা আচমকা হানা না দিলে পার্থ-অর্পিতার বিপুল পরিমাণ বেআইনি সম্পত্তির হদিশই মিলত না। কিন্তু যে প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে এর সঙ্গেই, তা হল, যা গর্জাচ্ছে আজ, তা কাল বর্ষাবে তো?  প্রশ্ন উঠছে ইডি-র অতীত পারফরমেন্সের কারণেই।

২০০২ সালে এনডিএ আমলে অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন জারি হয় 'প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট'। এই আইনের সংক্ষিপ্ত নাম পিএমএলএ। কিন্তু আর্থিক দুর্নীতি সংক্রান্ত এই আইনে অভিযুক্তদের মধ্যে বেশিরভাগেরই দুর্নীতির দায়ে কোনও শাস্তি হওয়া তো দূরের কথা, এমনকি গ্রেফতারও করা হয়েছে নগণ্য সংখ্যক অভিযুক্তকে। অবাক করার মতো বিষয় হলেও সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে এই তথ্য পেশ করেছে খোদ কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রের পেশ করা তথ্যানুসারে, ২০০২ সালে 'প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট' জারি হওয়ার পর থেকে এপর্যন্ত পিএমএলএ আইনে মোট ৪ হাজার ৭০০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু গ্রেফতার করা হয়েছে মাত্র ৩১৩জন অভিযুক্তকে। ইউপিএ আমল এবং ২০১৪ সাল থেকে এনডিএ আমলের সূত্রপাত হলেও পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তনই হয়নি। তবে কি ইডিকে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না? এই প্রশ্ন উঠছে সঙ্গত কারণেই।

দেশের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা ঋণ নিয়ে শিল্পপতিদের একাংশ ভারত থেকে পালিয়েছেন অন্যান্য দেশে। এই পরিস্থিতিতে কঠোর ব্যবস্থাগ্রহণ করা তো দূরের কথা কেন্দ্রীয় সরকার অনাদায়ী ১০ লক্ষ কোটি টাকা হিসেবে খাতা থেকে মুছে ফেলেছে। সম্প্রতি সংসদে এই তথ্য জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থপ্রতিমন্ত্রী ভগবত কে কারাদ।

আরও পড়ুন-কোথায় যায় ইডি-র হাতে উদ্ধার হওয়া কালো টাকা?

কেন্দ্রের পেশ করা পরিসংখ্যান অনুসারে, গত চার বছরে ঋণখেলাপি অথবা অর্থপাচারের সংখ্যা বেড়ে ১০ হাজার ৩০৬তে এসে ঠেকেছে। এই টাকা উদ্ধারের কোনও আশাও নেই। ফলে দেশের ব্যাঙ্কগুলি থেকে বিপুল টাকা ঋণ নেওয়ার ঘটনায় অভিযুক্তরা অনায়াসেই পার পেয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে ইউপিএ আমলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণের ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতি ছিল, সেই একই শৈথিল্য বজায় রয়েছে মোদি নেতৃত্বাধীন এনডিএ আমলেও।

তবে একথাও স্বীকার করতে হবে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জমানায় ইডি-র সক্রিয়তা অনেকটা বেড়েছে। সম্প্রতি সংসদের দুই কক্ষেই বিরোধীরা অভিযোগ করেছেন, ইডি-কে ব্যবহার করে বিরোধীদের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। এছাড়া ইডির পাশাপাশি ব্যবহার করা হচ্ছে সিবিআই-কেও।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে এও অভিযোগ উঠছে, বিজেপি ঘনিষ্ঠ একশ্রেণির শিল্পপতি বিপুল পরিমাণ টাকা আর্থিক দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হলেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। এই শিল্পপতিরা ১০ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সেই টাকা পরিশোধ তো করেনইনি, উপরন্তু দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। অথবা নাম লিখিয়েছেন ঋণখেলাপিদের তালিকায়। বেআইনিভাবে পাচার করা হয়েছে বিপুল অর্থ।

এ ব্যাপারে সংসদে উদ্বেগজনক তথ্য পেশ করেছেন খোদ কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী ভগবত কে কারাদ। অর্থ প্রতিমন্ত্রী ভগবত কে কারাদ জানিয়েছেন, গত চার বছরে এধরনের ঋণখেলাপির সংখ্যা ১০ হাজার ৩০৬জন। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কাছ থেকে কারসাজি করে এদের নেওয়া ঋণের ১০ লক্ষ কোটি টাকা আদায়ের আশা নেই। কার্যত ঋণের ওই বিপুল পরিমাণ টাকা ফেরত পাওয়া আশাও ত্যাগ করেছে কেন্দ্র। এদিকে দেশের বহু নাগরিকের নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে। দু'মুঠো খাবার জোটাতেই কালঘাম ছুটছে।

যে বিপুল পরিমাণ টাকা তছরূপ হয়েছে তুলনায়  সামান্য অংশই বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি দীনেশ মাহেশ্বরী এবং সি টি রবিকুমারের বেঞ্চে যে তথ্য পেশ করেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে, ঋণখেলাপি অথবা বেআইনি অর্থপাচারে অভিযুক্ত অসাধু শিল্পপতি বিজয় মাল্য, মেহুল চোকসি কিংবা নীরব মোদির ১৮ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, অনাদায়ী মোট ১০ লক্ষ কোটি টাকার তুলনায় এই অর্থ নেহাতই স্বল্প পরিমাণ। বাকিক্ষেত্রে কী হবে সেব্যাপারে কোনও দিশা নেই।

কেবল এনডিএ আমলেই নয়, বিপুল অর্থ ঋণ নিয়ে তা পকেটস্থ করে দেশের মানুষকে ডোবানোর পর্বটা চলেছে গত ইউপিএ আমলেও। সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতার সুপ্রিম কোর্টে পেশ করা তথ্যানুসারে, গত পাঁচ বছরের হিসেবে 'প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্টে' ২০২০-২০২১ সালে ইডির দায়ের করা মামলার সংখ্যা ৯৮১। এই আইনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মামলা দায়ের করে তদন্ত প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়সীমায়। তদন্ত প্রক্রিয়া চলেছে ২ হাজার ১৮৬টি মামলাতে।

কিন্তু গত ২০ বছরে 'প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্টে' ৪ হাজার ৭০০টি মামলা দায়ের করা হলেও কেন অতি নগণ্য সংখ্যক অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হল, সেব্যাপারেও কেন্দ্রীয় সরকার এপর্যন্ত কোনও যুক্তিই পেশ করেনি। গত ১৭ বছরে ইডির তরফে নেওয়া ব্যবস্থার ফলে শাস্তি পেয়েছেন মাত্র ২৩ জন ব্যক্তি। সাফল্যের হার ০.০৫ শতাংশেরও কম। এই কারণেই প্রশ্ন ইডি-র এই অভিযান নিয়ে।

'মানি লন্ডারিং অ্যাক্টে' বিশ্বের অন্য দেশগুলি- যেমন ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, হংকং, বেলজিয়াম, রাশিয়ার যে মামলাগুলি দায়ের করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেই তুলনায় ভারতের অবস্থা সত্যিই করুণ। গত ২০ বছরে প্রচুর পরিমাণ টাকা অনাদায়ী থাকলেও এপর্যন্ত ৩১৩জন অভিযুক্তকে গ্রেফতার এবং বাকিদের দিব্যি পার পেয়ে যাওয়াটা ভারতের মতো একটা স্বাধীন দেশের পক্ষে দুভার্গ্যজনকই।

সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা সুপ্রিম কোর্টে সম্প্রতি এও দাবি করেছেন, অনাদায়ী অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থানও আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে কঠোর। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এক্ষেত্রে কথায় এবং কাজে কোনও মিল দেখা যাচ্ছে না কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে। চলতি বছরের গোড়াতেও সুপ্রিম কোর্ট এবিষয়ে অভিমত জানিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা সেইসময়ে নির্দেশ দেন, 'প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট'-এর মামলাগুলিতে যেন গতি আনা হয়। সেই নির্দেশ কার্যত বাস্তবায়িত হয়নি।
এব্যাপারে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতার যুক্তি, 'প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্টে' দায়ের হওয়া গুরুতর মামলাগুলিতে দুই শতাধিক পিটিশন দায়ের হয়েছে। এরপর আদালত অন্তবর্তী স্থগিতাদেশ জারি করাতে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা পড়েছে। কেন্দ্রের এই যুক্তি ধোপে টিকছে না বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।

More Articles