যৌনকর্মী, বেপরোয়া প্রেমিকা! কে ছিলেন কলকাতার প্রথম মহিলা মস্তান নির্মলা দাসী?

First Lady Mastan of Kolkata : প্রেমিকাকে অস্ত্র যুগিয়ে দিতে হাওয়ায় ডেগার ছুঁড়ে দেয় শৈলেন। অনেকটা ফ্লাইং সসারের মতো। শৈলেনের ছোড়া সেই ডেগার দিয়েই খণ্ড যুদ্ধ চালিয়ে যায় নির্মলা।

কুসুম কুসুম বাঙালি মেয়েদের আখ্যান এক লহমায় চুরমার হয়ে যায় শান্তির জীবনের গল্প শুনলে। যদিও এই চুরমার হয়ে অন্ধকারে মিশে যায় যে মেয়েদের দল, শান্তি তাদের দলের হয়েও ঠিক তাদের মতোও নয় আবার। তার জীবনের স্বতন্ত্র আখ্যান তার নিজের হাতেই লেখা। ভাগ্যদেবী নিজ ইচ্ছায় হুবহু লিখে যেতে পারেননি তার জীবনের গল্প। শান্তি লিখে রেখে গেছে নিজের নাম অথবা দুর্নাম অথবা এক গভীর রহস্য। যদিও লালবাজারের হিস্ট্রি শিট তাকে দ্বিধাহীনভাবে মস্তান বলেই আখ্যা দেয়। দ্য বেঙ্গল গভর্নমেন্ট গুন্ডা অ্যাক্ট অনুযায়ী শান্তি ওরফে নির্মলা দাসী কলকাতার প্রথম সারির মহিলা মস্তান। চল্লিশের দশকে পুলিশের খাতায় নাম তোলা এক গডমাদার, পেশায় বারবনিতা এবং আর্মস ডিলার। আর এক বেপরোয়া প্রেমিকা। পুলিশের হিস্ট্রি শিট অনুযায়ী ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত মধ্য কলকাতায় বেপরোয়া অভিযান চালিয়েছে শান্তি আর শান্তির প্রেমিক শৈলেন।

'দ্য গুন্ডাস টুওয়ার্ডস আ রিকনস্ট্রাকশন অব ক্যালকাটা আন্ডারওয়ার্ল্ড' বইতে অধ্যাপক সুরঞ্জন দাস একটি জরুরি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। বেঙ্গল গভর্নমেন্ট গুন্ডা অ্যাক্ট ১৯২৬ লাগু হওয়ার পর মস্তান, রাজনৈতিক কর্মী, ছেঁদো দুষ্কৃতী- সকলেই এই আইন অনুযায়ী প্রশাসনের চোখে আখ্যা পেয়েছে গুন্ডার। চল্লিশের দশকে মহিলা ডন হিসেবে নাম পাওয়া যাচ্ছে আমাদের নির্মলা দাসীর। তার দুষ্কর্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে অস্ত্র।

কলকাতার তলপেটের হদিস নিতে গিয়ে চল্লিশের দশকের এই মহিলা মস্তানের উল্লেখ এবং পর্যালোচনা ইতিহাস চর্চার প্রয়োজনেই বিশেষ জরুরি। যদিও নির্মলা দাসী নিয়ে যৎসামান্যই লেখা রয়েছে পুলিশের হিস্ট্রি শিটে। কিন্তু খুব খুঁটিয়ে পড়লে ওই এক প্যারাগ্রাফের মধ্যেই রয়েছে নানা ইঙ্গিত। সমাজেতিহাসের ছাত্র হিসেবে ওই ইঙ্গিতগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গল্প খুঁজে যাওয়াই আমাদের আজকের অনুসন্ধান।

আরও পড়ুন- দার্জিলিংয়ের অনাথ শিশুই ছিল কলকাতার ত্রাস! কে এই ‘চাইনিজ ডন’?

নির্মলা দাসী ওরফে শান্তি আদতে মেদিনীপুরের মেয়ে। ১৯২৮ সালে জন্ম। নির্মলার বাবা কলকাতা শহরে মোটর মেকানিক হিসেবে কাজ করতেন। মাত্র ষোলো বছর বয়সেই বাবাকে হারান নির্মলা। ১৯৪৪ সালের মেদিনীপুর, বাবাকে হারিয়ে গোটা সংসার যেন এসে দাঁড়ায় খাদের কিনারে। গ্রামেরই এক প্রতিবেশী কলকাতায় বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসেন নির্মলার মায়ের কাছে। এর চেয়ে স্বস্তির প্রস্তাব আর কিছুই হতে পারে না ভেবে রাজি হয়ে যান নির্মলার মা। গ্রামের ওই প্রতিবেশীর হাত ধরেই কলকাতা শহরে পা নির্মলার। কিন্তু কোথায় বিয়ে! কিছুদিন পরেই নির্মলা বুঝতে পারে, বিয়ের নাম করে শহরের এক বেশ্যালয়ে তাকে বিক্রি করে গেছেন ওই প্রতিবেশী। আহিরিটোলার কাছে এক বেশ্যালয়। এই কাহিনি দুর্ভাগ্যজনক হলেও খুব ব্যতিক্রমী কিছু নয়। সেইসময় এমন ঘটনা আখছারই ঘটত। শহরের অন্ধকার জগতে এমন বহু লোক ছড়িয়ে ছিল যারা নারী পাচারকারী হিসেবেই পরিচিত ছিল। কত শত নির্মলাদের তারাই পৌঁছে দিত বেশ্যালয়ের দুয়ারে। বেশ্যাবৃত্তিতে নাম লেখানো সেই সব হতভাগিনীদের নাম কেউ মনে রাখেনি। কিন্তু নির্মলা দাসী ছিল ব্যতিক্রমী। বেশ্যার পরিচয় ছাপিয়ে সে কার্যত ত্রাস হয়ে ওঠে কলকাতা পুলিশের কাছে। ভদ্রবিত্তের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়।

নির্মলা যখন কলকাতায় আসে কলকাতার চেহারা ছিল এমনই

যে সময়টা জুড়ে নির্মলা দাসীর উত্থান সেই সময়ে শহর কলকাতার পাতালপুরী শাসন করছেন গোপাল পাঁঠা, ভানু বোস, রাম চ্যাটার্জিরা। রাজনৈতিক মদত এই সশস্ত্র গ্যাংগুলিকে এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল। সংগঠিত পাতালপুরী। সেই সময়, আগেই বলেছি, অস্ত্র ছিল সহজলভ্য। স্বপ্নভঙ্গের এক প্রলম্বিত অধ্যায় ছিল সেই সময় জুড়ে। হাত কাটা স্বাধীনতা এসেছে বাংলায়, চুরমার অর্থনীতি। অসংখ্য ছোট বড় গ্যাং গজিয়ে উঠছে। তেমনই এক গ্যাংয়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠল নির্মলার। কিন্তু এই সশস্ত্র দলটি কি ডাকাত দল? চার কিংবা পাঁচের দশকে হামেশাই দেখা যাচ্ছে এমন দল ইতস্তত গজিয়ে উঠছে। নির্মলা কি তেমন কোনও ডাকাত দলেরই গডমাদার? পুলিশের খাতায় তার নামে কোনও ডাকাতির ঘটনার উল্লেখ কিন্তু নেই, যদিও অস্ত্র পাচারের অভিযোগ আছে। তবে? নির্মলা কি কোনও চরমপন্থী বিপ্লবী দলে যোগ দিয়েছিলেন? তার প্রেমিক শৈলেন শীল আসলে কে? চরম পন্থায় বিশ্বাস রাখা কোনও যুবক? নাকি খতরনাক ক্রিমিনাল! এত অস্ত্র নিয়ে সে কোথায়, কার কাছে যেত নিয়ম করে? কেন পুলিশ দিনের পর দিন শৈলেন আর নির্মলার খোঁজে হন্যে হয়েছে?

পুলিশের খাতায় উল্লেখ আছে ১৯৫২ সালের একটি ঘটনার কথা। বহুদিন ধরে তক্কে তক্কে থেকে নির্মলার গাড়ির পিছু নেয় পুলিশ। ব্যক্তিগত গাড়ি নয়, ভাড়ার ট্যাক্সি। পুলিশের বহুদিন ধরেই নজর ছিল নির্মলার গতিবিধির উপর। বেশ্যাবৃত্তির আড়ালে যে সে আরও বড় কোনও দুষ্কর্মের প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সংবাদ পুলিশের টিকটিকিদের কাছে আগেই ছিল। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছিল লালবাজার। এইবার বেশ প্রস্তুতি নিয়েই মসজিদ বাড়ি স্ট্রিট থেকে রওনা হওয়া নির্মলার পিছু নিল পুলিশ। নির্মলার গাড়িতে সেদিন আরও দুই যুবক। একজন নিঃসন্দেহে শৈলেন। আরেকজন? ট্যাক্সি ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়াতেই ঘিরে ফেলে পুলিশ। পালাতে গিয়েও পালাতে পারে না নির্মলা। তার হাতে তখন আগ্নেয়াস্ত্র। আর তার প্রেমিক শৈলেনের সঙ্গে আরেক দুষ্কৃতী শেখ ইসমাইল। এটুকুতেই শেষ না। পুলিশের সন্দেহ আগে থেকেই ছিল। তাই তদন্তকারী অফিসাররা ট্যাক্সির ডিকি খুলতেই পেয়ে গেলেন আসল জিনিস! অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিপুল সম্ভার! এই এত অস্ত্র নিয়ে কোথায় যাচ্ছিল নির্মলা? কি উদ্দেশ্য ছিল তার? ডাকাতি? অন্য দলকে অস্ত্র সরবরাহ? আর্মস ডিলার ছিল গডমাদার নির্মলা? না কি স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গের পর নানা দিশায় ছড়িয়ে যাওয়া রাজনৈতিক দলের অংশ যারা বিশ্বাস করতো প্রকৃত স্বাধীনতা আসেনি। আরেকটা লড়াই লড়তে হবে। কী সেই পথ? সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা সবার ছিল না কিন্তু বিশ্বাস ছিল বদ্ধমূল যে লড়াই হবে সশস্ত্র পথেই। সত্যিই কে ছিলেন নির্মলা দাসী? বেশ্যা পরিচয়ের অন্তরালের মহিলাকে নিয়ে এই রহস্য এতদিন পরও থেকেই যায়।

আহিরিটোলার যে বেশ্যাপল্লীতে নির্মলা গ্রাম থেকে এসে উঠেছিল, পরে সে সেই পাড়া ছেড়ে দেয়। উঠে আসে মসজিদ বাড়ি লেনে। সবই সেই শৈলেনকে ভালোবেসে। আসলে নির্মলা সম্পর্কে অস্ত্র যোগ ছাড়া অন্য কোনও দুষ্কর্মের উল্লেখ পাওয়া যায় না। অথচ লালবাজারের হিস্ট্রি শিটে চল্লিশের দশকের দুর্দান্ত সব মস্তানদের মাঝে জ্বলজ্বল করছে একটিই মহিলা মস্তানের নাম, নির্মলা দাসী। আর এখানেই তাকে ঘিরে যাবতীয় উৎসাহ এবং একইসঙ্গে প্রবল ধন্দ।

কলকাতার এক যৌনপল্লী

আরও পড়ুন- গোপাল পাঁঠা : হিন্দুত্বের তাস না কি কলকাতা কাঁপানো মস্তান?

এবার পুলিশ প্রশাসনের সরকারি বয়ান ছেড়ে আসা যাক অন্য আখ্যানে, যে আখ্যানের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন কলকাতার বারাঙ্গনারা। অন্ধকার জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকেও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তারা। গবেষক লেখক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'অক্ষরমালায় বারবনিতা' বইতে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার বিপ্লবীদের সহায়ক হিসেবে কলকাতার বারবনিতাদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। সে ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লেখা নেই। ১৯২২ সালের অসহযোগ আন্দোলনে সারা দেশের সঙ্গেই বাংলায় আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন বারবনিতারা। মেদিনীপুরে, কলকাতায় আন্দোলনের অংশ হিসেবে রাস্তায় নেমে অর্থ সংগ্রহ করেছেন তারা। তারও বহু আগে ১৯০৭ সালে কলকাতায় ব্রিটিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিডন স্কোয়ারে যেবার জমায়েত হন বিপ্লবী যুবকরা, সেই সময় ব্রিটিশরা এক কালা আইন জারি করেছিল। সন্ধ্যার পর জমায়েত করা যাবে না। সেই আইনের বিরোধিতা করেই বিডন স্কোয়ারে যখন বিপ্লবীরা জমায়েত করেন তা ভাঙতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ। তুমুল লাঠিচার্জ শুরু হয়। বিপ্লবীরাও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন সাধ্যমতো। এমন সময় দেখা যায়, আশেপাশের ছাদের থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে শুরু হয়েছে প্রবল ইটবৃষ্টি। কোনও মধ্যবিত্ত, ভদ্রবিত্ত নয় বরং চিৎপুরের বারবনিতাদের সংগঠিত আক্রমণে সেদিন পিছু হটেছিল ব্রিটিশ পুলিশ। সেই দিন বিপ্লবীদের সহায়তা করতে শহরের কোনও ভদ্রবিত্ত এগিয়ে আসেননি । এসেছিলেন এই মেয়েরাই।

পরবর্তীকালে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ডাকে বন্যত্রাণে অংশ নেন কলকাতার বারবনিতারা। বিপুল সংখ্যক শাড়ি ও অর্থ সাহায্য নিয়ে তারা যখন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে পৌঁছন , তখন প্রফুল্ল চন্দ্র তাঁর অফিস ঘরে বসে। বারবনিতাদের দেখেই বলে ওঠেন, "এসো, এসো মা লক্ষ্মীরা"। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সেই মধুর সম্ভাষণ আপ্লুত করেছিল বারাঙ্গনাদের। যদিও 'মাতৃমুক্তি পণ'-এ বারবনিতাদের অংশগ্রহণ মোটেই ভালো চোখে নেয়নি তৎকালীন বাঙালি সমাজ। বহু পত্রপত্রিকায় সেদিন সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। যদিও এরপরেও স্বাধীনতার যুদ্ধে বারবনিতাদের অংশগ্রহণ থেমে থাকেনি। বারবনিতাদের নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন খোদ চিত্তরঞ্জন দাস। তারকেশ্বরের মোহন্তর ব্যভিচারের বিরুদ্ধে ও আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নেন কলকাতা তথা বাংলার বারবনিতারা। ১৯২২ সালে ভয়াবহ বন্যায় অর্থ সাহায্যে এগিয়ে আসেন কলকাতার বারবনিতারা। পাড়ায় পাড়ায় 'পতিতা সমিতি' তৈরি করে বিপুল অর্থ সাহায্য করেন তারা। এদের অংশগ্রহণ এক শ্রেণিরর বাঙালি নেতা ও নাগরিকদের পছন্দ না হলেও মহাত্মা গান্ধি থেকে চিত্তরঞ্জন দাস কিংবা প্রফুল্ল চন্দ্র রায়- সকলেই এই গোষ্ঠীকে স্বাধীনতার লড়াইয়ে শামিল করেছিলেন।

আরও একটা দিক ছিল। বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রেও বারাঙ্গনাদের ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। অল্প বয়সি বিপ্লবীদের সঙ্গে অনেক সময়ই প্রেমের বন্ধনে জড়িয়ে পড়তেন ও পাড়ার বহু কম বয়সি মেয়ে। পতিতাপল্লী থেকে বেরিয়ে গিয়ে কেউ কেউ পেতেছিলেন সংসার। কেউ বা উপেক্ষিতই থেকে গেছেন। আক্ষেপের বিষয় একটাই, বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনে যে সব মহিলাদের উল্লেখ রয়েছে তাতে স্থান পাননি এই সব বারাঙ্গনারা। কলকাতার পাতালপুরী আর কিছু মুখে মুখে ফেরা গল্পে আবছা হয়েই বেঁচে আছেন তারা।

আরও পড়ুন- থ্রিলার দেখে কিলার! যেভাবে কলকাতার ত্রাস হয়ে উঠেছিল ভোঁদা মস্তান

বারাঙ্গনাদের আন্দোলনে শামিল করেছিলেন দেশবন্ধু

নির্মলা এদেরই কেউ কিনা একথা স্পষ্ট করে জানে না কেউ। তবে তার অস্ত্র কারবারের বহর দেখে মনে হয়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্মলার সঙ্গে চরম পন্থায় আস্থা রাখা মানুষজনের একটা যোগ ছিল। কলকাতার প্রথম সংগঠিত আন্ডারওয়ার্ল্ডের কাছে অস্ত্রের একটা বড় সম্ভার এসে পৌঁছেছিল রাজনৈতিক সূত্রেই। পরে আরও নানা সূত্রে অস্ত্র রমরমা হয় শহরে।

অস্ত্রপাচার করার ক্ষেত্রে বেশ্যালয়গুলির একটা ভূমিকা ছিল। বিপ্লবী যুগ, বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলন কিংবা ছেচল্লিশ সালের দাঙ্গার পর বেশ্যালয়গুলির অস্ত্র যোগ নিঃসন্দেহে দুষ্কৃতীদের হাত ধরেই থেকে গেল। দাঙ্গায় বারবনিতাদের যোগদান নিয়ে তেমন কোনও উল্লেখ পাওয়া না গেলেও বিয়াল্লিশ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বউবাজারের বারবনিতারা যোগ দিয়েছিলেন। দেশপ্রেম তো ছিলই, ছিল আরও এক বড় কারণ। গল্প শোনা যায়, মার্কিন নিগ্রো সেনারা এইসব বেশ্যালয়গুলিতে যেত। যৌনকর্মের নামে প্রবল পাশবিক নিগ্রহের মুখে পড়ে এই গরিব বাঙালি বারবনিতারা। ভারত ছাড়ো আন্দোলন তাদের কাছে ছিল সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তির একমাত্র রাস্তা। কলকাতা সেদিন অচল হয়ে গিয়েছিল সশস্ত্র হুংকারে। সব ধর্ম, সব বর্ণ, সব শ্রেণি, সব বর্গের মানুষ সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েন। জাতীয় কংগ্রেসের ডাকা আন্দোলন রূপ পায় প্রকৃত গণ প্রতিরোধের। নির্মলা দাসীর জীবনের রহস্যে মোড়া কুহকগুলির মধ্যে এই সবেরই উত্তাধিকার ছিল কিনা, কে বলবে!

লালবাজারের হিস্ট্রি শিটে নির্মলা দাসীর নম্বর CRO-HS-29317 OF 1952। নির্মলা ও তার প্রেমিক শৈলেন পুলিশের জালে শেষবারের মতো ধরা পড়ে ১৯৫৪ সালে। পুলিশ যখন তাদের ঘিরে ফেলে, শেষ মুহূর্তেও পুলিশের জাল ভেঙে বেরোতে চেষ্টা করেছিল দু'জন। চাকু, পিস্তল, ডেগার নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করেছিল পুলিশকে। এতটাই আক্রমণাত্মক ছিল এই 'দুষ্কৃতী' প্রেমিক যুগল যে, নির্মলার হাতে থাকা পিস্তলের গুলি যখন ফুরিয়ে যায়, প্রেমিকাকে অস্ত্র যুগিয়ে দিতে হাওয়ায় ডেগার ছুঁড়ে দেয় শৈলেন। অনেকটা ফ্লাইং সসারের মতো। শৈলেনের ছোড়া সেই ডেগার দিয়েই খণ্ড যুদ্ধ চালিয়ে যায় নির্মলা।
লালবাজারের খাতায় সেই শেষ উল্লেখ নির্মলার। তারপর? তার আর পর নেই। নেই কোনও ঠিকানা। শুধু শহরের অন্ধকার জগতের হাল হদিশ করতে গিয়ে বহু পুরুষ মস্তানের মধ্যেও জ্বলজ্বল করতে থাকে নির্মলা দাসীর নাম। কিছুটা প্রকাশ্য আর বাকিটা অনন্ত রহস্য।

More Articles