থ্রিলার দেখে কিলার! যেভাবে কলকাতার ত্রাস হয়ে উঠেছিল ভোঁদা মস্তান

Kolkata Vonda Mastan : লালবাজারের হিস্ট্রি শিট বসন্ত সম্পর্কে জানাচ্ছে, নানা দুষ্কর্ম করতে গিয়ে ক্রাইম থ্রিলার দেখত সে। কীভাবে হচ্ছে খুন, কীভাবে অপহরণ করা হচ্ছে।

গভীর রাতে উঁচু বাড়িটার ছাদে কী যেন হয়! সাদা আলো জ্বলে থাকে। দূর থেকে দেখা যায়। যদিও বাড়িটার পাশেই কোনও উঁচু নির্মাণ নেই। রাস্তার ওপারে বাবুদের বিডন স্ট্রিট। আর এপারে নতুন বাজার। কিছু এলোমেলো বস্তি। বাজার আর কিছু অতি পুরাতন বনেদি মহল। অদূরে, চিৎপুরের এক চিলতে বেশ্যালয়ে কিছু খদ্দের সস্তার মদ খেয়ে টলোমলো পায়ে রাস্তায় হাঁটে। আর এরকম একটা সময়েই গভীর রাত ভেদ করে সাদা আলো জ্বলে ওঠে উচুঁ বাড়িটার ছাদে, যে বাড়িতে সদ্য এক ব্যক্তি ভাড়া এসেছে। কিছুটা সন্দেহজনক। স্থানীয় মানুষজনের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। খানিকটা আড়ালও করে রাখে হয়তো বা। লোকটার বাড়িতে কিছু বাছাই করা মানুষজন ঢোকে এবং বের হয়, রাত বিরেতে। মাঝে মাঝে কালো রঙের বেবি অস্টিন আসে। কিছু মালপত্র ঢোকে কালো লোহার বড় বাক্সে। আর ... আর গভীর রাতের ওই সাদা আলো।

রহস্য ভেদ করতে একদিন দূরের এক বাড়ির চিলেকোঠার ছাদে ডেরা বাঁধে পাড়ার কিছু বেপরোয়া ছোঁড়া। রাত পর্যন্ত ঘাপটি মেরে থাকে তারা। নতুন বাজার অঞ্চলের এলোমেলো ছেলে ছোকরার দল ওরা। কী এক সন্দেহে না কি স্রেফ আমোদের বশে ওরা সাদা আলোর রহস্য ভেদ করতে চায়! অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে। ছাদের আলো তখনও জ্বলে ওঠেনি। অন্ধকারে চোখ রেখে রেখে ততক্ষণে দৃষ্টি অনেকটা ধাতস্থ হয়ে উঠেছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর ওরা দেখছে ছাদে একটা সাদা পর্দা মতো টাঙানো হলো। সাদা একটা পর্দা আর ছাদ জুড়ে অন্ধকার। আর তারপরই একটা আলো যেন আছড়ে পড়ছে ওই সাদা পর্দায়। কী হয়, কী হয় ভাবছে ওরা, এমন সময়ই পর্দা জুড়ে সিনেমা শুরু হলো। ছেলে ছোকরার দল তো অবাক, এ কোন বিলাসী বাবু! দুপুরবেলা ধর্মতলায় সিনেমা হলে না গিয়ে মাঝরাতে বাড়ির ছাদে পর্দা টাঙিয়ে সিনেমা দেখে! কৌতুকই হলো ওদের। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই দেখা গেল সিনেমায় কোনও নায়ক-নায়িকা-গান, কিছুই নেই। শুধু যুদ্ধ আর যুদ্ধ। গোলা, বারুদ, কামান, বন্দুক। এ কেমন সিনেমা? কারা দেখে এসব? ভাবতে ভাবতেই ওদের চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। এতক্ষণ ওরা প্রজেক্টরের আলোয় সিনেমা দেখছিল, এবার চোখ গেল একটি লোকের উপর, সে এই ছাদে একলা দর্শক। আর একজন তার সহযোগী, পর্দার পাশে বসে আছে। কিন্তু ওই লোকটা? ওই একলা দর্শক? পর্দায় যুদ্ধরত সৈন্যরা যে ভঙ্গিতে বন্দুক হাতে যুদ্ধ করছে, লোকটাও হুবহু একই ভঙ্গিতে তা নকল করে চলেছে। তবে কি ওর হাতেও ওটা বন্দুক? ভাবতেই শিউরে উঠছিল ছোকরার দল। হাতে একটা বন্দুক, যুদ্ধের ফুটেজ দেখে দেখে নকল করে চলেছে। এ কেমন লোক, কী চায় সে? একটা বন্দুক হাতে, পাশে ছাদের মেঝেতে রাখা আরও বেশ কয়েকটি। ছোকরার দলের সন্দেহ থাকে না, তল্লাটে এক ডেঞ্জারাস লোক ঢুকেছে। খুবই অন্যরকম কোনও কাণ্ড ঘটাতে চায় সে।

আরও পড়ুন- দার্জিলিংয়ের অনাথ শিশুই ছিল কলকাতার ত্রাস! কে এই ‘চাইনিজ ডন’?

কথাটা একটু একটু করে রটে যায় বিডন স্ট্রিট লাগোয়া বস্তি অঞ্চলে। বড় বড় বাড়ির স্যাঁতস্যাঁতে ছায়ার অন্ধকারে কিলবিল করছে অসংখ্য নিচুতলার মানুষ। ঘেমে নেয়ে, খেটে, মারপিট করে যারা বেঁচে থাকে। লোকটাকে ঘিরে ওদের ভয় জাগে। ছোটখাতো সাদামাটা লোক অথচ কী তার অভিসন্ধি? বোঝা দায়। এমন লোক এর আগে দেখেনি তারা। এই সব নিয়ে কথা বলতেও ভয়! না জানি কী ক্ষতি হয়ে যায়।

গভীর রাতে নতুন বাজারের ছোকরার দল সেদিন যাকে দেখেছিল, যেটুকু দেখেছিল তা নিতান্তই ঝাঁকি দর্শন বলা যায়। সে লোক বাস্তবে তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। গভীর তার চলার পথ। কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ডের সে এমন এক রঙিন চরিত্র, যার তুলনা আর কারও সঙ্গেই করা সম্ভব না। সে এক এবং অদ্বিতীয় বসন্ত কুমার সাহা। সমাজেতিহাস যারা চর্চা করেন, তারা বসন্ত কুমারকে জানেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন সৈন্যদের থেকে পেট্রোল কিনে পেট্রোল ব্ল্যাক করার জন্য। এই পরিচয় বসন্ত কুমার সাহার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই মার্কিন সেনা আর বসন্ত কুমার সাহার জীবন নানা গল্পের ঠাস বুনোটে বাঁধা। তবে সে গল্পেরও এক শুরুর শুরু আছে। আর সেই শুরুর শুরু গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে, হাওড়ায়।

ভোঁদা তখনও বসন্ত কুমার সাহা হয়ে ওঠেনি। হাওড়া স্টেশন চত্বর জুড়ে তখন মালবাহী গোরুর গাড়ির ভিড়। খালাসি আর মুটেদের দুপুরের খাবার জোগান দিতে ছোটখাটো একটা হোটেল খুলে বসে ভোঁদার বাবা। ছোট ভোঁদা বাবাকে সাহায্য করতে এসে জুটেছে দোকানে। থালা ধোয়, খাবার বেড়ে দেয়। ভালোই চলে স্টেশন লাগোয়া ছোট দোকান। বেশ কয়েক বছর কাটে। শহরের হাওয়ায় বড় হতে থাকে ভোঁদা। গঙ্গা পেরিয়ে যে বড় শহর কলকাতা দেখা যায়, তার হাতছানি যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে থাকে দিন দিন। গাড়োয়ানদের হোটেল নিয়ে পড়ে থাকতে আদৌ ইচ্ছা করছিল না ভোঁদার। সে তো উড়ান দিতে চায়। খাবার হোটেল সামলায় আর বিকেলে গঙ্গা পেরিয়ে কলকাতা চলে আসে। খোঁজ করে নতুন কাজের। শুধু একটা কাজ না, এমন একটা বিদ্যা, দক্ষতা যা দিয়ে স্বপ্নের পথে লম্বা দৌড় দেওয়া যায়।

হাওড়া স্টেশনে মুটে, খালাসিদের ভিড়

ভোঁদা দেখল, সাহেব পাড়ার পাশে বিভিন্ন গাড়ি মেরামতির দোকান রয়েছে। কত গাড়ি আসে, ছোটখাটো মেরামতি থেকে বড় টাকার কাজ। নানা কাজের সুযোগ। দোকানগুলোর দিকে ঘুর ঘুর করতে থাকে ভোঁদা, প্রায় প্রতিদিন। যদি একটা কাজ শেখার সুযোগ ঘটে। একদিন মিলেও যায় সুযোগ। এক দোকানে গাড়ি মেরামতির কাজ শিখতে শুরু করে ভোঁদা। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি মেরামতির খুঁটিনাটি শিখে নেয় সে। ভোঁদা ভেবেছিল, সাহেব বা ধনীদের গাড়ি সারিয়ে অনেক টাকা উপার্জন করবে কিন্তু তার জন্য আরও বড় সুযোগ অপেক্ষা করছিল।

আরও পড়ুন- ধোঁয়াটে ক্রিক রো-র ঝলমলে জলসা! কলকাতা কাঁপাত মস্তান ভানু বোসের কালীপুজো

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই কলকাতায় মার্কিন সেনারা আসতে শুরু করে। মিত্রশক্তির শরিক হিসেবে ব্রিটিশ সেনার সঙ্গী মার্কিন সৈন্যরা এল কলকাতায়। মার্কিন সেনাদের জন্য ধর্মতলার আশেপাশে তৈরি হলো বিশাল পরিকাঠামো। সেনা বাহিনীর অস্থায়ী হেড কোয়ার্টার, কারনানি হোটেল, সুবিশাল সেনা ক্যান্টিন। এই সব বিশাল পরিকাঠামো এখনও কলকাতা শহর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। মার্কিন সেনা এসেছিল ১৯৪২ সাল নাগাদ, যে সময় জুড়ে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে উত্তাল হয়েছে কলকাতা। ভয়ে কুঁকড়ে থেকেছে হোয়াইট কলকাতা। এরকম এক সময়েই কলকাতায় এল মার্কিন সেনা। কলকাতার আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে গেল তারা। সে গল্পে পরে আসছি। এই মার্কিন উদ্যোগেই রিষড়ায় ইউনাইটেড স্টেটস এয়ার বেস তৈরি হয়েছিল। কপাল জোরেই হোক বা কাজের দক্ষতায়, হাওড়ার ভোঁদা সেই মার্কিন কারখানায় কাজ পেল। ভালোই চলছিল দিন কিন্তু সুখ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। ভোঁদার দ্রুত সফল হওয়ার উদগ্র ইচ্ছা তাকে স্বাভাবিক কাজকর্মে থিতু হতে দিচ্ছিল না। কাজের ফাঁকেই মার্কিন বাহিনীর গাড়ি থেকে তেল চুরি করছিল ভোঁদা, খোলা বাজারে তা বিক্রি করে দিচ্ছিল। এ কাজে সেনা বাহিনীর একাংশের যোগসাজসে একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল ভোঁদা। একদিন কারখানার সাহেবরা তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলল। কাজটা থাকল না। কিন্তু ততদিনে কাঁচা পয়সার লোভ তাকে খেয়ে ফেলেছে। তরল সোনার কারবার যে তাকে রাতারাতি বড়লোক করে দিতে পারে, ততদিনে সেকথা বিলক্ষণ মনে বসে গিয়েছে ভোঁদার। কাজ চলে গেলেও সেনা জওয়ানদের একাংশের সঙ্গে দিব্যি যোগাযোগ রেখে চলছিল সে। বড় কিছু করার পরিকল্পনা তখন মাথায়।

এবার আসা যাক কলকাতায় মার্কিন সেনাদের কাণ্ড কারখানার প্রসঙ্গে। বর্ণ বিদ্বেষ মার্কিন সমাজে এক গভীর রোগ। সে রোগের বাইরে ছিল না মার্কিন সেনারাও। কলকাতায় আসার পর মার্কিন সেনারা এক সাজানো গোছানো বিনোদনের বহু আয়োজনে ঠাসা সাহেব পাড়া পেয়েছিল। পেয়েছিল জমজমাট ধর্মতলা চত্বর। রাস্তার পাশে ইংরেজি বইয়ের দোকান, যেখানে কামশাস্ত্র কিনতে পাওয়া যেত। ছিল বন্দুক, নেপালি, ভোজালির রকমারি দোকান। ছিল বার, নাইট ক্লাব, ক্যাবারে ডান্সার। এক জমজমাট শহর, উঁচু উঁচু নির্মাণে ইওরোপের ছায়া। জমে গেল মার্কিন সেনাদের জীবন। তবে এই স্বাদের ভাগ পেত শুধু গোরা সৈন্য বাহিনী। মার্কিন রেজিমেন্টের নিগ্রো সৈন্যরা এই আনন্দ আয়োজন থেকে ছিল দূরে। তাদের প্রবেশ অধিকার নেই। তারা মিশে গেল কলকাতার অলিগলিতে। ভোঁদা এবং ভোঁদার মতো অসংখ্য কলকাতার উচ্চাকাঙ্খী যুবক হলো তাদের বিনোদনের নানা রাস্তার পথ প্রদর্শক। এই পর্যায়েই ভোঁদা বসন্ত কুমার সাহা হয়ে উঠল। এই নিগ্রো সেনাদের সাহায্যেই পেট্রোল ব্ল্যাক শুরু করেছিল ভোঁদা ওরফে বসন্ত। আর চাকরি হারিয়ে নিগ্রো সেনারাই ভরসা দিল তাকে। পেট্রোল ব্ল্যাক করার মাত্রা বেড়ে গেল, চটজলদি রোজগার। কাঁচা পয়সার নেশা পেয়ে বসল বসন্তকে। সাদা চামড়ার মার্কিন সেনারা সন্ধ্যা নামলেই যেত ক্যাবারের আসরে। সম্ভ্রান্ত বারবণিতা পল্লীতে। আর নিগ্রো সেনারা? বসন্তের হাত ধরে তারা চলল বউবাজার, চিৎপুরের নিভু নিভু অন্ধকারে ঢাকা বেশ্যাপল্লীতে। সেখানে টাঙা গাড়ি আর কুপি জ্বালিয়ে পথে অপেক্ষা করতো নিচুতলার বেশ্যার দল। বসন্তের মতো অনেকেই তখন এই কাজ করত। বিনিময়ে পেত মোটা টাকা টিপস।

পুরনো কলকাতার বেশ্যালয়

বসন্ত বেশ কিছু টাকা জমিয়ে ফেলল। তার লক্ষ্য আরও বড়। নিগ্রো সেনাদের কাছ থেকে দেড়-দুশো টাকার বিনিময়ে বন্দুক কিনতে শুরু করল সে। তার ক্ষিদে যেন মেটে না। বন্দুক তো কেনা হলো কিন্তু চালানো হবে কীভাবে? পথ বাতলে দিল নিগ্রো সেনারাই। বসন্তর হাতে তারা পৌঁছে দিল, বলা ভালো বিক্রি করে দিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওয়ার ফুটেজ, নিউজ রিল। তাই দেখে বসন্ত প্র্যাকটিস করবে আগ্নেয়াস্ত্র চালনা। কলকাতা তখন আন্তর্জাতিক কেন্দ্র। সদ্য মুক্তি পাওয়া ইংরেজি ছবি, ইওরোপের বাজারে পাওয়া যায় এমন বহু কিছুই পাওয়া যেত ধর্মতলা চত্বরে। একটা ষোলো মিলিমিটার ফিল্ম প্রজেক্টর, স্ক্রিন ট্রাইপড কিনে ফেলল বসন্ত। তারপর বাবুদের পাড়া বিডন স্ট্রিট লাগোয়া একটা উঁচু বাড়ি ভাড়া নিল সে। আর গভীর রাতে শুরু হলো ওয়ার ফুটেজ দেখে দেখে আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর ক্রিয়া কৌশল। রোজ রাতে সাদা চাদরে একফালি আলো আছড়ে পড়তে থাকল।

বসন্ত কুমার সাহা কলকাতার আন্ডার ওয়ার্ল্ডের এক রঙিন চরিত্র। শুধু পেট্রোল ব্ল্যাক করে সে যা অর্থ উপার্জন করেছিল, তাই ছিল যথেষ্ট। তবে শুধুই বিত্তবান হওয়া বসন্তের লক্ষ্য ছিল না। বিডন স্ট্রিট লাগোয়া যে অঞ্চলের ছাদে স্ক্রিন টাঙিয়ে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু করেছিল বসন্ত সেই শিবিরে একদিন নাম লেখাল বহু শিক্ষানবিশ। সবই ওই বিডন স্ট্রিট লাগোয়া অঞ্চলের। এদের মধ্যে ছোটখাটো ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত লোকজন ছিল। ছিল আরও নানা ধরনের টাউট। বসন্ত ছিল এ লাইনে রীতিমতো শিল্পী মানুষ! গাড়ি মেরামতির কাজ আগেই সে জানত, এবার যুক্ত হলো নম্বর প্লেট জালি করার বিদ্যা।সমঝদাররা বোঝেন দুষ্কর্ম সংগঠিত করতে এ বিদ্যার জুড়ি মেলা ভার। আর ছিল অস্ত্র সম্ভার। তার মধ্যে অবশ্যই স্টেনগান! সেই কারণেই ভোঁদা ওরফে বসন্ত কুমার সাহার নাম ছড়িয়ে পড়ল কলকাতার পাতাল প্রদেশে।

পাতাল পুরীর সর্বাধিনায়ক গোপাল পাঁঠাও তার খোঁজ করছিলেন। বিশেষত বসন্তর গাড়ির নম্বর প্লেট জাল করবার বিদ্যা তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। বসন্তকে নিয়ে গোপাল পাঁঠার মুগ্ধতা বেড়েই চলেছিল, এমন সময়েই দাঙ্গা লাগল শহরে। কলকাতা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে এমন সম্ভাবনা অগ্নিগর্ভ করে তুলল পরিস্থিতি। প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্টতা আগেই ছিল। আফগান ডনদের দাপাদাপি ছিল, অস্ত্র সহজলভ্য ছিল। ধর্মীয় পরিচয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক আড়াআড়ি বিভাজন তৈরি করেছিল। এরই মধ্যে দাঙ্গা লাগল।

রাস্তার ধারে কামসূত্র সহ উত্তেজক বইয়ের সারি

গোপাল পাঁঠার মতোই বসন্তও একটা রেজিস্ট্যান্স গ্রুপ তৈরি করেছিল তার দলবল নিয়ে। কিন্তু সেই সময় গোপাল পাঁঠার নাম কলকাতা জুড়ে বিশাল ছড়িয়ে পড়েছিল। বসন্ত ভাবল, উদ্দেশ্য যখন একই তখন আলাদা লড়ে কী হবে? শত হলেও প্রশাসন যখন পক্ষ নিয়েই রয়েছে তখন একজোট হওয়াই বসন্তের কাছে হয়ে উঠেছিল বাঞ্ছনীয়। আর গোপালও খুঁজছিল বসন্তকে। চুম্বক যেমন লোহাকে টানে, সেভাবেই বসন্তকে টেনে নিল গোপাল পাঁঠা। গোপালের ভারত জাতীয় বাহিনীতে সদলবলে যোগ দিল ভোঁদা ওরফে বসন্ত কুমার সাহা। গোপালের সঙ্গে বহুদিন সুসম্পর্ক বজায় ছিল বসন্তের। নিজ গুণে গোপাল বাহিনীতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে নিয়েছিল বসন্ত। বুদ্ধি, সাহস, আধুনিক অস্ত্র, গাড়ির নম্বর প্লেট জাল করার অসামান্য দক্ষতা- সব মিলিয়ে গোপালের বাহিনীতে ধারে এবং ভারে দ্বিতীয় নাম হিসেবে উচ্চারিত হতে থাকে বসন্তের নাম।

আরও পড়ুন- গোপাল পাঁঠা : হিন্দুত্বের তাস না কি কলকাতা কাঁপানো মস্তান?

ছেচল্লিশ সালের দাঙ্গায় বহু ধরনের লোকই অংশ নিয়েছিল অস্ত্র হাতে। চরমপন্থী বিপ্লবী পরিবার থেকে আসা গোপাল পাঁঠা যেমন ছিল, তেমনই নৌ বিদ্রোহে অংশ নেওয়া প্রাক্তন সেনা অনিল কুমার বসুও ছিলেন। অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, হাতে লেগেছিল দাঙ্গার রক্ত। দাঙ্গা থামলে এরা অনেকেই কলকাতার সংগঠিত আন্ডারওয়ার্ল্ডের এক একটি নাম হয়ে উঠেছিল। এদের সঙ্গে বসন্তের কিন্তু একটা মূলগত ফারাক ছিল। বসন্ত দাঙ্গা পরিস্থিতিতে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়নি। কোনও বিপ্লবী কর্মসূচিকে সামনে রেখেও অস্ত্র হাতে নেয়নি। সে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল অস্ত্র হাতে তুলবে বলেই, দুষ্কর্মের টানেই। কিংবা তার মনের গভীরে হয়তো কোনও প্রতিশোধ স্পৃহা ছিল! তা না হলে ওয়ার ফুটেজ, ক্রাইম থ্রিলার দেখে কেউ সশস্ত্র ডাকাত বাহিনী গড়ে তুলছে এ উদাহরণ খুব কমই মেলে।

গোপাল পাঁঠার ভারত জাতীয় বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে ও পরে বসন্ত একের পর এক দুষ্কর্ম করেছে। এ শহরের পেট্রোল স্মাগলিং চক্র বসন্তের হাতেই গড়া। স্টেনগান সহ অস্ত্রের সম্ভার মলঙ্গা লেন কানেকশনের বাইরে একমাত্র বসন্তেরই ছিল। বহু দুষ্কর্মের জন্য অস্ত্রের জোগান, গাড়ির নম্বর প্লেট জালি করা- এইসব কাজে বহু গ্যাংয়ের ভরসা ছিল বসন্ত। সে-ই একমাত্র লোক যে গোপাল বাহিনীতে যোগদান করেও নিজের দল অটুট রাখতে পেরেছিল। তা অবশ্যই নিজের অর্থ জোগানের কারণে অনেকটাই।

লালবাজারের হিস্ট্রি শিট বসন্ত সম্পর্কে জানাচ্ছে, নানা দুষ্কর্ম করতে গিয়ে ক্রাইম থ্রিলার দেখত সে। কীভাবে হচ্ছে খুন, কীভাবে অপহরণ করা হচ্ছে। ডাকাত দল হামলা চালাচ্ছে কী পদ্ধতিতে, সিনেমা দেখেই এসব তালিম নিত বসন্ত। আর তারপর সেই বিদ্যা সে প্রয়োগ করত নানা অপকর্মে। গড়িয়াহাটের ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ক ডাকাতি তার মধ্যে অন্যতম। ভারত জাতীয় বাহিনীতে গোপালের লেফটেন্যান্ট হয়ে উঠেছিল বসন্ত। কিন্তু এই বাহিনীই তার একমাত্র পরিচয় নয়। গোপালয়ের ছায়াতে সে বড় হয়নি। বসন্ত কলকাতার আন্ডার ওয়ার্ল্ডে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল নিজের ধকে। মার্কিন সেনারা কলকাতা ছেড়ে গেলে জৌলুস কমেছিল বসন্তের জীবনে। তবু বসন্ত ছিল বসন্তই, যাকে ঈর্ষা করত, খানিক সমীহও করত খোদ গোপাল পাঁঠা।

More Articles