আইনজীবী থেকে উপরাষ্ট্রপতি প্রার্থী- যে ভাবে ধাপে ধাপে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেছেন ধনকড়

তিনি যে পুরস্কার পেলেন তা কিন্তু সহজে আসেনি। তাঁর কেরিয়ারের দিকে তাকালে দেখা যায়, তিনি কোনও দিনই ঝোড়ো ব্যাটিং করেননি। বরং ধীর গতিতে রান তুলেছেন।

বাংলা থেকে দিল্লি। রাজ্যপাল থেকে উপরাষ্ট্রপতি (প্রার্থী)। সামনেই দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদের হাতছানি। প্রোমোশন তো বটেই। জগদীপ ধনকড় বেঙ্কাইয়া নাইডুর উত্তরসূরি হচ্ছেন কি না, তা জানা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। তবে তাঁকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে।

তাঁকে বিজেপি যে পুরস্কার দিল, তা নিয়ে চর্চা চলছে, কারণ বিজেপি সর্বভারতী সভাপতি জে পি নাড্ডা এই খবর মিডিয়াকে দেওয়ার সময়, বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে তিনি 'কৃষকপুত্র’। রাজনীতিতে চর্চা শুরু হয়ে গেছে যে, কৃষক বিক্ষোভ নিয়ে কীভাবে মোদি সরকার ল্যাজেগোবরে হয়েছে, তা ভালোভাবেই মনে রেখেছে দেশ। তাই কি কৃষক ক্ষতে প্রলেপ দিতে তাঁকে এই উপহার? সেই আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়, তিনি যে পুরস্কার পেলেন তা কিন্তু সহজে আসেনি। তাঁর কেরিয়ারের দিকে তাকালে দেখা যায়, তিনি কোনও দিনই ঝোড়ো ব্যাটিং করেননি। বরং ধীর গতিতে রান তুলেছেন।

কোথা থেকে শুরু করেছিলেন জগদীপ ধনকড়?

রাজস্থানের অজ পাড়া গাঁয়ের ছেলে জগদীপ ধনকড়। আজ তাঁর সামনে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদের ডাক। বেঙ্কাইয়ার উত্তরসূরি হয়ে তাঁর চেয়ারে বসছেন কিনা তার উত্তর পেতে অবশ্য অপেক্ষা করতে হবে আর কিছুদিন। রাজনীতিতে তিনি কিন্তু ঝড়ের গতিতে রান তোলেননি। বরং ধীর লয়ে তাঁর এই উত্থান। সবাইকে চমকে দিয়ে উপরাষ্ট্রপতি ভোটের টিকিট পেলেন তিনি।

লেখাপড়া ও আইনের পেশা

১৯৫১ সালের রাজস্থানের কিথানায় জন্ম জগদীপ ধনকড়ের। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামের স্কুলে পড়াশুনো করেন তিনি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে সরকারি স্কুলে ভর্তি হন তিনি। সেসময় গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেতেন। ১৯৬২ তে এখান থেকে স্কুল জীবন শেষ করেন তিনি। এরপর জয়পুরের মহারাজা কলেজ থেকে পদার্থ বিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ধনকড়। ১৯৭৯ তে রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান আইনের ডিগ্রি। এরপর রাজস্থান হাইকোর্টে কর্মজীবন শুরু করেন। ৯’র দশকে সুপ্রিম কোর্টে চলে আসেন তিনি। এখানেও আইনজীবী হিসেবে সুনাম অর্জন করেন তিনি। তবে স্থায়ীভাবে সেই পেশায় থাকেন না, কারণ তিনি চলে আসেন রাজনীতিতে।

রাজনীতিতে সক্রিয় পদচারণা

১৯৮৯ সালে সংসদীয় রাজনীতিতে পা রাখেন জগদীপ ধনকড়। জনতা দলের হয়ে রাজস্থানের ঝুনঝুনি থেকে সংসদে যান তিনি। পরের বছর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটির সদস্য হন ধনকড়। ১৯৯৩ থেকে ৯৮ পর্যন্ত ছিলেন বিধায়ক। কিষানগড় থেকে জিতে রাজস্থান বিধানসভায় গিয়েছিলেন তিনি। পরে দল বদল করে চলে আসেন বিজেপিতে। ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই বাংলার রাজ্যপাল হিসেবে শপথ নেন তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে রাজ্য সরকারের সঙ্গে বারবার সংঘাতে জড়িয়েছেন এই দুঁদে আইনজীবী।

নবান্ন-রাজভবন সংঘাত

কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর রাজ্যপাল হিসেবে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাঁর জায়গায় আসেন জগদীপ ধনকড়। প্রথম থেকেই তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সঙ্গে বিরোধে জড়ান। সংঘাত চরমে ওঠে।

একাধিক ইস্যুতে নবান্ন ও রাজভবন সংঘাত মাত্রাছাড়া আকার নিয়েছে। বারবার রাজ্য সরকারের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা শোনা গেছে তাঁর মুখে। রাজ্যপালের ভূমিকায় অবশ্য শুরু থেকে ক্ষুব্ধ ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ধনকড়কে `পদ্মপাল’ আখ্যা দিয়েও কটাক্ষ করেছিল রাজ্যের শাসকদল। বিজেপির প্রতিনিধি হয়ে ধনকড় এ রাজ্যে এসেছেন বলে বারবার অভিযোগ করেছে তৃণমূল। এই পরিস্থিতিতেই উপরাষ্ট্রপতি পদে ধনকড়কে প্রার্থী করল বিজেপি।

২০১৯ সালের জুলাই মাসে রাজ্যপালের দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সংঘাত জড়িয়ে বারবার শিরোনামে এসেছেন। রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারের বিরুদ্ধে ``সাম্প্রদায়িক পৃষ্ঠপোষকতা এবং মাফিয়া সিন্ডিকেটের তোলাবাজি’’র অভিযোগ এনেছেন জগদীপ ধনকড়। পাল্টা রাজ্যের শাসক দল ধনকড়কে সাম্প্রদায়িক বলে অভিযোগ তুলেছেন। এই মাসের শুরুতেই রাজ্যের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে বাংলার বুদ্ধিজীবীদের `নীরবতা ভাঙার’ অনুরোধ করেন ধনকড়।

সময়ের অপেক্ষা

ভারতের উপরাষ্ট্রপতি পদের জন্য ক্ষমতাসীন এনডিএ-এর প্রার্থী হচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। শনিবার এই ঘোষণা করেছেন বিজেপি প্রধান জে পি নাড্ডা। তিনি বলেন, ``সমস্ত বিবেচনা এবং পরামর্শের পর আমরা কিষাণপুত্র জগদীপ ধনকড়কেই বিজেপি এবং এনডিএ-এর উপরাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।‘’ সাংবাদিক সম্মেলনে নাড্ডা বলেন, ধনকড় নিজেকে `জনগণের রাজ্যপাল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নাড্ডার কথায় এই ইঙ্গিত স্পষ্ট তাঁর জন্য পুরস্কার অপেক্ষা করছিল আগে থেকেই।

২০১৭ সালে বিজেপি উপরাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন ক্যাবিনেট মন্ত্রী তথা প্রাক্তন বিজেপি সভাপতির এম বেঙ্কাইয়া নাইডুর নাম ঘোষণা করেছিল। দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে নির্বাচনে জয়লাভ করেন নাইডু। তারপর এতগুলো বছর সেই চেয়ারে থাকেন। তাঁর মেয়াদ শেষ হচ্ছে ১০ অগাস্ট। সংসদের বর্তমান সংখ্যা ৭৮০-এর মধ্যে শুধু বিজেপিরই ৩৯৪ জন সাংসদ রয়েছেন। যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার সংখ্যা ৩৯০ এর চেয়ে বেশি। উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ১৯ জুলাই। এবং নির্বাচন হবে ৬ অগাস্ট।

তাহলে বোঝাই যাচ্ছে বাংলা থেকে দিল্লি এখন খুব খুব বেশি দূরে নয়। রাজস্থানের গাঁ গঞ্জ অলি গলি পেরিয়ে যে পথ হাঁটা শুরু করেছিলেন ধনকড়, এখন তাঁর সামনে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদের হাতছানি। বিতর্ক তাঁকে ছুঁয়েছে, নবান্নের সঙ্গে সংঘাতের জল অনেক দূর গড়িয়েছে, আজ দেশের উপরাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসা শুধু সময়ের অপেক্ষা। এতকিছুর পরেও বলাই যায় জার্নিটা কিন্তু অনেক লম্বা।

More Articles