নোটবন্দির স্মৃতি উস্কে দেশ জুড়ে চালু সিএএ আইন, কতটা ছাপ পড়বে ভোটবাক্সে?

CAA implemented: লোকসভা ভোটের ঠিক আগে আগে দেশ জুড়ে চালু হয়ে গেল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)। সোমবার রাত ১০ টা থেকেই কার্যকর হতে পারে সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। শোনা যাচ্ছে তেমনটাই।

কোনও এক রাতে এভাবেই দেশের উপর নেমে এসেছিল নোটবাতিলের সিদ্ধান্ত। দেশজোড়া লকডাউনের সিদ্ধান্তও নেমেছিল এমনই এক রাতে। ঠিক তেমন ভাবেই লোকসভা ভোটের ঠিক আগে আগে দেশ জুড়ে চালু হয়ে গেল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে দাবি করা হয়েছে তার বিজ্ঞপ্তিও। সোমবার রাত ১০ টা থেকেই কার্যকর হতে পারে সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। তেমনটাই শোনা যাচ্ছে আপাতত।

এনআরসি-র পর সিএএ নিয়ে তোলপাড় হয়ে উঠেছিল দেশ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতবার বাংলায় এসেছেন, ততবারই সিএএ কার্যকর কথা বলেছেন। বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরও বলেছিলেন, চালু হতে চলেছে সিএএ। তবে তা যে সত্যিই এত শিগগিরই হতে চলেছে, তা বোধহয় প্রত্যাশা ছিল না। যদিও কানাঘুষো শোনা গিয়েছিল আগেই।

বিল পাশ হয়েছিল বছর চারেক আগেই। তবে সাড়ে চার বছর ধরেই এই সিএএ-র ধারা-উপধারা যুক্ত হয়নি বলে জানা গিয়েছে। ফলে আইন তৈরি হলেও তা কার্যকর হয়নি। নিয়ম অনুসারে রাষ্ট্রপতি সই করার ছয় মাসের মধ্যে আইনের নির্দিষ্ট ধারা-উপধারা যুক্ত করতে হয়। অন্যথায় লোকসভা কিংবা রাজ্যসভার নির্দিষ্ট কমিটিগুলির কাছে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ২০২০ সাল থেকে আইন কার্যকর করার সময়সীমা বৃদ্ধির আবেদন জানিয়ে আসছিল। এই বিলম্ব নিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে কটাক্ষও করছিল বিরোধী দলগুলি।

আরও পড়ুন: নির্বাচনী বন্ড: কে কত টাকা দিয়েছে কোন দলকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই জানবে দেশ?

ইতিমধ্যেই জোর বেজে গিয়েছে ভোটের দামামা। বেশ কয়েকটি রাজ্যে কয়েক দফার প্রার্থীতালিকাও ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। আর ঠিক এ সময়েই দেশের উপর নামল সিএএ-কোপ। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর সিএএ পাশ করিয়েছিল কেন্দ্রের মোদী সরকার। ওই আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো মুসলিম ধর্মাবলম্বী দেশ থেকে যদি সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে এ দেশে আশ্রয় চান, তা হলে তা দেবে ভারত। সংসদের দু’কক্ষে পাশ হওয়ার পরে দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দও অনুমোদন দিয়েছিলেন সিএএ বিলে। কিন্তু এত দিন ধরে সিএএ কার্যকর করা নিয়ে কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়নি।

সম্প্রতি ফের সিএএ নিয়ে আলোচনা শোনা যাচ্ছে বিজেপির অন্দরে। গত ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছিলেন, লোকসভা নির্বাচনের আগেই দেশে সিএএ কার্যকর হবে। শুধু তা-ই নয়, শাহ এ-ও বলেছিলেন, শীঘ্রই সিএএ কার্যকরের বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়ে যাবে। যদিও মতুয়া অধ্যুষিত নদিয়া এবং উত্তর ২৪ পরগনার সভায় এসে সিএএ নিয়ে তেমন ভাবে কিছু বলতে চাননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বনগাঁর বিজেপি প্রার্থী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর অবশ্য় বারবার বলেছিলেন, ‘‘ভোটের আগে সিএএ কার্যকর হচ্ছেই। ভোট ঘোষণার এক-দু’দিন বা তিন দিন আগে হলেও সিএএ কার্যকর হবে। এমনকী, নির্বাচন বিধি চালু হওয়ার এক ঘণ্টা আগেও সিএএ কার্যকর হতে পারে।’’ তবে সে কথায় তেমন কান দেয়নি বিরোধীরা। তৃণমূল বিষয়টিকে ‘উদ্বাস্তু মানুষদের ভাঁওতা দেওয়ার চেষ্টা’ বলেই কটাক্ষ করেছিল। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিএএ-কে ‘ক্যা ক্যা’ বলে তোপ দেগেছিলেন। তৃণমূল নেতৃত্ব বরাবরই সিএএ প্রসঙ্গে দাবি করে আসছেন, যে নাগরিকেরা ভোট দেন, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড আছে, তাঁরাই এ দেশের নাগরিক। তাই তাঁদের নতুন করে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

তবে তৃণমূলের সেই সমস্ত আশায় জল ঢেলে ভোটের ঠিক আগেই কার্যকর হচ্ছে সিএএ বিল। গত মাসেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে কর্মরত এক আধিকারিক সংবাদ সংস্থাকে জানান, সিএএ কার্যকরের বিজ্ঞপ্তি লোকসভা নির্বাচনের অনেক আগেই জারি হয়ে যাবে। এই আইনের নিয়ম বা ধারা তৈরি হয়ে গিয়েছে। নাম নথিভুক্তকরণের জন্য অনলাইন পোর্টালও প্রস্তুত। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘সিএএ-র গোটা প্রক্রিয়াই অনলাইনে হবে। সেখানে আবেদনকারীদের শুধু জানাতে হবে তাঁরা কবে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন।" এদিকে, কিছু দিন আগেই বাংলার বেশ কয়েকটি জায়গায় হঠাৎ করেই বাসিন্দাদের আধার বিকল হয়ে যাওয়া শুরু হয়। সেই নিয়ে বেশ হইচইও শুরু হয়েছিল। অনেকেই ওই ঘটনার সঙ্গে অনেকেই সিএএ-আইন রূপায়ণের যোগ খুঁজে পেয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী সেই ঘটনায় বাসিন্দাদের আশ্বাসও দেন।

 

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ (২০১৯)-কে চ্যালেঞ্জ করে একাধিক জনস্বার্থ মামলা হয়েছে দেশের বিভিন্ন আদালতে। ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর সিএএ-র বিরুদ্ধে আর্জির প্রথম শুনানি শুরু হয়েছিল শীর্ষ আদালতে। ওই বছরেরই ১১ ডিসেম্বর সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হওয়ার পর দেশ জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। সারা দেশে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে প্রাণ যায় প্রায় ১০০ জনের। বিজেপি বিরোধী দলগুলিই এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মতো বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলি ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সিএএ কার্যকরের বিরোধী। এখনও পর্যন্ত লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করেনি নির্বাচন কমিশন। তার আগেই গোটা দেশে চালু হয়ে গেল সিএএ।

আরও পড়ুন:প্রচারে মাত! বাস্তবে দুর্নীতি রোধ বা মহিলাদের সুরক্ষা দেওয়ার উদাহরণ কোথায় মোদির?

কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তের নিন্দা করেছেন বিরোধীদের একাংশ। এক্স হ্যান্ডেলে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ লিখেছেন, চার বছর তিন মাস লেগে গেল সিএএ লাগু করতে! যে আইন সংসদে পাশ হয়েছিল ২০১৯ সালে। প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন, তাঁর সরকার কর্পোরেট সংস্থার মতো সময় মেনে কাজ করে। সিএএ লাগু করতে এতখানি সময় নেওয়াতে বোঝা গেল, প্রধানমন্ত্রী কত বড় মিথ্যুক। কংগ্রেস আরও দাবি করেছে, গেরুয়া শিবির আসলে সঠিক সময়ে ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ প্রয়োগের জন্য অপেক্ষা করছিল। নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের কঠোর নির্দেশ ধামা চাপা দেওয়াও হঠাৎ সিএএ লাগু করার অন্যতম উদ্দেশ্য। পাশাপাশি আসন্ন নির্বাচনের ঠিক আগেঅ মেরুকরণের রাজনীতিতেও হাওয়া দিল বিজেপি সরকার। বিশেষত বাংলা এবং অসমে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনারের হঠাৎ পদত্যাগেও অস্বস্তিতে ছিল কেন্দ্র। সিএএ নিয়ে ডামাডোলে সেই অস্বস্তিও কি ঝেড়ে ফেলতে চলেছে বিজেপি সরকার। ভোটের ঠিক আগে আগে সিএএ-র মতো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত কি প্রভাব ফেলতে চলেছে ব্যালট বাক্সে? নাকি মানুষ পুরনো স্মৃতি ভুলে সিএএ কার্যকর করার সিদ্ধান্তকে ভালো মনেই মেনে নেবে? লোকসভা ভোটের এই চূড়ান্ত মুহূর্তে সেটাই কিন্তু দেখার।

More Articles