জারি ১৪৪ ধারা, ভোটের আগে দিল্লির পারদ চড়াছে কৃষক বিক্ষোভের আঁচ

Farmers' protest: সেই আন্দোলনের আঁচ রাজধানীতে পড়ার আগে সোমবারই রাজ্যজুড়ে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। একদিন-দু'দিনের জন্য নয়। একমাসের জন্য জারি করা হয়েছে কার্ফু।

বেশ কিছুদিন ধরেই ধিকি ধিকি করে জ্বলছে কৃষক আন্দোলনের আঁচ। সামনেই লোকসভা ভোট। দেশ জুড়ে তার দামামা বেজে গিয়েছে। তার ঠিক আগে ফের উস্কে উঠল কৃষক আন্দোলনের ঢেউ। মঙ্গলবার থেকে দিল্লি জুড়ে ফের পথে নেমেছেন কৃষকেরা। অবশ্য এই আন্দোলন আজকের নয়। তিন কৃষি আইন বাতিল ও কৃষির ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে ২০২০ সালেই পথে নেমেছিলেন কৃষকদের একাংশ। আন্দোলনের জেরে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিল নরেন্দ্র মোদী সরকারকে। চার বছর পর ফের রাজপথে কৃষকেরা। এবার লখিমপুর খেরিতে কৃষক খুনের তদন্ত-সহ একগুচ্ছ দাবি নিয়ে দিল্লিতে জড়ো হয়েছেন তাঁরা।

সেই আন্দোলনের আঁচ রাজধানীতে পড়ার আগে সোমবারই রাজ্যজুড়ে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। একদিন-দু'দিনের জন্য নয়। একমাসের জন্য জারি করা হয়েছে কার্ফু। যে কোনও বড় জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনে গ্রেফতার করা হবে বলেও জানানো হয়েছে। দিল্লির ঐতিহাসিক লালকেল্লা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ব্যারিকেড ও কন্টেনার দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে আশপাশ। সিরসার চৌধুরী দলবীর সিং স্টেডিয়াম ও ডাবওয়ালি গুরু গোবিন্দ সিং স্টেডিয়ামকে অস্থায়ী জেলে পরিণত হয়েছে। মঙ্গলবার কৃষকদের দিল্লি চলো মিছিলের কারণে সব সীমান্ত সিল করে দেওয়া হয়েছে। সোমবার গভীর রাত পর্যন্ত কৃষকনেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা। তবে আন্দোলনে অনড় কৃষকদের বোঝানোর সমস্ত চেষ্টাই কার্যত ব্যার্থ হয়েছে। কৃষকরা আন্দোলন থেকে পিছু হটতে নারাজ।

আরও পড়ুন: হু হু করে বাড়ছে কৃষক আত্মহত্যা! দেশজুড়ে অন্নদাতাদের দুর্দশার দায় কার

এদিকে আন্দোলন ঠেকাতে তৎপর পুলিশ। গাজীপুর, সিংগু, শম্ভু, টিকরি-সহ সমস্ত সীমানা সেনানিবাসে রূপান্তরিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশ এ-ও জানিয়েছে কৃষকদের ছদ্মবেশে দুষ্কৃতীরা যদি আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দিল্লির সীমান্তে জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্য়বস্থা। কৃষকদের আন্দোলন রুখতে পাঞ্জাব-হরিয়ানা সীমানায় শম্ভু এলাকায় কৃষক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়ায়।  বিক্ষোভকারী কৃষকরা ব্যারিকেডগুলি সরিয়ে ফেলতে শুরু করলে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে হরিয়ানা পুলিশ  কাঁদানে গ্যাসের ছোড়া শুরু করে। এর আগে, কৃষক ইউনিয়নগুলি 'দিল্লি চলো' পদযাত্রা শুরু করার পরেই সীমান্তে বেশ কয়েকজন কৃষককে আটক করে হরিয়ানা পুলিশ। বাজেয়াপ্ত করা হয় তাঁদের গাড়িগুলিও। সব মিলিয়ে কৃষক আন্দোলনের জেরে ব্যাপক যানজট তৈরি হয়েছে একাধিক জায়গায়। গাজীপুর সীমানায় যান চলাচল করছে ধীরগতিতে। রাস্তায় ব্যারিকেড থাকায় নিত্যযাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ছে। দিল্লির বিভিন্ন সীমান্তে মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া কৃষকদের প্রত্যাশিত বিক্ষোভের কারণে যান চলাচল ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গতকাল থেকে বাণিজ্যিক যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ও ডাইভারশন কার্যকর করা হয়েছে।

Delhi Chalo 2.0 Why are the farmers protesting again and what are their key demands?

২০২০ সালে কৃষির ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও, সরকার এ ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ। এর ফলে চরম সমস্যায় পড়েছেন কৃষকরা। এবারও কৃষকদের দাবিগুলির মধ্যে কৃষি সহায়ক মূল্য নির্ধারণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট আইন প্রণয়নেরও দাবি করা হয়েছে। এ ছাড়া, বিদ্যুৎ আইন, ২০২০ বাতিল, কৃষিঋণ মুকুব, লখিমপুর খেরিতে কৃষক হত্যাকাণ্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনির শাস্তিরও দাবি করেছে কৃষক সংগঠনগুলি। একই সঙ্গে মৃত কৃষকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের দাবিতেও সরব হয়েছে তারা। এছাড়া, চার বছর আগে আন্দোলনের সময় বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। সেই সব মামলা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিলেও, সরকার কথা রাখেনি বলেই অভিযোগ। সেই সমস্ত কিছু নিয়েই এবার পথে নেমেছেন কৃষকেরা। আর সেই ঢেউকে ঠেকাতে কোনও রকম তৎপরতার বাকি রাখছে না দিল্লির প্রশাসন।

কিন্তু কেন এত কড়া নিরাপত্তা? কৃষক আন্দোলন কেন ভাবাচ্ছে প্রশাসনকে। ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি একই রকম দৃশ্যের সাক্ষী ছিল রাজধানী দিল্লি। সেবার লালকেল্লায় পৌঁছনোর জন্য ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে কৃষকদের ঢেউ। পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক খণ্ডযুদ্ধ লেগে যায় কৃষকদের। পুলিশ বাধ্য হয় লাঠি চালাতে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। বছর দু'য়েক আগে পঞ্জাব-হরিয়ানা সীমান্তে কৃষকদের ঠেকাতে কাঁদানো গ্যাস ছুড়তে হয় পুলিশকে। সে সময় চাপের মুখে কৃষকদের দাবি মেনে তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় মোদী সরকার। এবার তাই কৃষকদের দিল্লির সীমানায় আসতে দিতেই রাজি নয় সরকার। 

হরিয়ানার বেশ কয়েকটি জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত করা এবং কৃষকদের মিছিলের পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্ত সিল করার বিরুদ্ধে আবেদন করা হয়েছিল পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টে । মঙ্গলবার হাইকোর্ট  বিশেষ কয়েকটি এলাকায় কৃষকদের আন্দোলনের অনুমতি দিয়েছে। পাশাপাশি পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এ সংক্রান্ত স্ট্যাটাস রিপোর্ট জমা করার নির্দেশ দিয়েছে। আপাতত ওই মামলার শুনানি ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।

Delhi Chalo 2.0 Why are the farmers protesting again and what are their key demands?

চার বছর আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে নরেন্দ্র মোদী সরকার ব্যর্থ বলে দাবি করেছেন সম্মিলিত কিষাণ মোর্চার নেতা জগজিৎ সিং ডাল্লেওয়াল এবং কিষাণ মজদুর সংগ্রাম কমিটির সদস্য সারওয়ান সিং। সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি আদৌও পূরণ হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন তাঁরা। কৃষিঋণ মুকুব এবং স্বামীনাথ কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা কতখানি আদৌ, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কৃষকদের সংগঠন। সম্মিলিত কিষাণ মোর্চা (অ-রাজনৈতিক) এবং কিষাণ মজদুর মোর্চা ঘোষণা করেছে যে তারা সম্মিলিত ভাবে কৃষকদের দাবি পূরণের জন্য সরকারের উপর চাপ তৈরি করবে। আর সেই কর্মসূচীরই অঙ্গ হিসেবে কৃষিঋণ মকুব, কৃষির ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সহ একাধিক দাবিতে মঙ্গলবার বেশ কয়েকটি কৃষক সংগঠনের পক্ষ থেকে দিল্লি অভিযানের ডাক দেওয়া হয়েছে। পঞ্জাব ও হরিয়ানার হাজার হাজার কৃষক এই অভিযানে সামিল হয়েছেন। কৃষকদের রুখতে কড়া প্রশাসনও। কৃষকদের রাজধানীতে ঢোকা রুখতে জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। সেই সঙ্গে বসানো হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া এবং কংক্রিটের দেওয়াল।

আরও পড়ুন: কেন তিন তিনটি কৃষি আইন বাতিল করলেন মোদি? কৃষক স্বার্থ নাকি ভোট চরিতার্থ?

এদিকে, আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি ভারত বনধের ডাক দিয়েছে কৃষকদের সংগঠন সংযুক্ত মুক্তি মোর্চা। বনধে সামিল হতে চলেছে সিটু সহ দেশের সমস্ত ট্রেড ইউনিয়নগুলি। বনধের সমর্থনে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়েছে সংগঠগুলির পক্ষ থেকে। এই বনধে বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোটের শরিক দলগুলিকে সামিল হওয়ার জন্য করা হয়েছে আবেদন। এদিকে কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের এক্স হ্যান্ডেলে বার্তা দিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একই সঙ্গে কৃষকদের উপর কাঁদানে গ্যাস নিয়ে প্রশাসনের হামলার ঘটনার কড়া নিন্দাও করেন তিনি। ২০২০-২১ সালে কৃষক আন্দোলন নিয়ে বিরাট চাপের মুখে পড়ে গিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। ২০২৪ ভোটের আগে কৃষকদের ফের জেগে ওঠা অস্বস্তির মুখে ফেলতে পারে কি মোদি সরকারকে? সে কারণেই কি এত বজ্র আঁটুনি। যাঁরা গোটা দেশের মুখে অন্ন তুলে দেন, সেই কৃষকদের কথা কেন ভাবছে না বিজেপি সরকার। স্বাভাবিক ভাবেই উঠেছে একাধিক প্রশ্ন।

More Articles