রিলস দেখছেন সারাক্ষণ! ইনস্টাগ্রাম রিলসের ভয়াবহ দিক জেনে আঁতকে উঠছে বিশ্ব

Instagram Reels Addiction : ২০২৩ সালের জানুয়ারি নাগাদ, ভারতে ২৪ কোটি (২৪,৩৬,৭২,০০০) ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী ছিল, যা আমাদের দেশের জনসংখ্যার ১৬.৯ শতাংশ।

রোজের জীবনটাই যে আস্ত একখানা রিল নয় তা হলফ করে বলা যায় না বোধহয় আর। কিঞ্চিৎ সময় বের করে যদি হিসেব কষা হয় যে আমরা রোজ সোশ্যাল মিডিয়াতে রিলস দেখায় কতখানি সময় ব্যয় করি, অঙ্কটা খুব একটা সুখকর হবে না। ২০২০ সালের জুন মাসে ভারত সরকার এ দেশের সবচেয়ে প্রিয় শর্ট-ভিডিও প্ল্যাটফর্মগুলির মধ্যে অন্যতম TikTok নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ঠিক একমাস পরেই ইনস্টাগ্রাম নতুন একটি ফিচার নিয়ে আসে, ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ডের ভিডিও। তারপর চতুর্দিকে অনাবিল রিলস, অসংখ্য, অসীম, ইনফিনিটি রিলস। রিলসের মধ্যে ক্রমেই ডুবে যাচ্ছে আস্ত মানব সভ্যতা। বিনোদনের, শিক্ষার, স্বাস্থ্যের, প্রতিশোধের, প্রেমের সব কিছুর জন্য বরাদ্দ ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ড সময়! TikTok-এর রেখে যাওয়া শূন্যতা পূরণ করে ইনস্টাগ্রাম।

শুরুর প্রায় চার বছর পর অতিক্রান্ত। ইনস্টাগ্রাম রিলস এখন সর্বময়। অনেক লোকজন রাতারাতি বিখ্যাত হয়েছেন। অনেকে সর্বস্ব ছেড়ে একেই পেশা করে নিয়েছেন, অনেকে আবার মৃত্যুর দিকেও এগিয়ে গেছেন। গত রবিবার অর্থাৎ ৭ জানুয়ারি ঘটে যাওয়া একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা আমাদের এই কয়েক সেকেন্ডের বিনোদনের এক মর্মান্তিক দিক সামনে এনেছে।

মহেশ্বর কুমার রাই, বছর পঁচিশের যুবক। প্রায় সাত বছর আগে রানি কুমারীকে বিয়ে করেছিলেন। দম্পতি বিহারের বেগুসরাইতে সাদামাটা সাংসারিক জীবন কাটাতেন। মহেশ্বরই ছিলেন একমাত্র উপার্জনকারী, কলকাতায় পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করতেন তিনি। মহেশ্বর যখন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি ফিরে আসেন তখনই বিষয় জটিল হয়ে ওঠে, বলা ভালো কুৎসিত হয়ে ওঠে। তিক্ততার কারণ? ইনস্টাগ্রাম রিলস।

আরও পড়ুন- সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইক-কমেন্ট না পেলেই বিষণ্ণ! চরম আসক্তির দায় আসলে কার?

রানির রিল তৈরিতে আপত্তি মহেশ্বরের। রানি এদিকে রিল তৈরিতে মগ্ন। বিষয়টি পছন্দ হয়নি মহেশ্বরের। দু'জনের মধ্যে চরম ঝগড়া শুরু হয়। মহেশ্বরের বাবা জানান, মহম্মদ সাজ্জাদ নামে আরেক ব্যক্তির সঙ্গেও রানি কুমারীর অবৈধ সম্পর্ক ছিল। রবিবার ৭ জানুয়ারি রাত ৯টায়, যখন রানি মহেশ্বরকে তার বাবা-মায়ের বাড়িতে ডাকে, সেখানে সে তাঁর প্রেমিক এবং দুই বোন রোজি আর সোনালি কুমারীর মদতে মহেশ্বরকে খুন করে। মহেশ্বরের বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। রানিকে আটক করা হয়েছে এবং তাঁর দুই বোনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

বহু ভারতীয়ের দুর্ঘটনা, মারামারি, এমনকী হত্যার কারণ হয়ে উঠেছে রিলস। উপরের ঘটনাটি যদি মনে হয় নেহাতই ব্যতিক্রম তাহলে আরও উদাহরণও রয়েছে। রিলস আসার পর থেকে মানুষের জীবন বদলে গেছে। আইফোন কেনার জন্য কিডনি বিক্রি নিয়ে প্রচলিত জোকস রয়েছে। কিন্তু গত জুন মাসে, পশ্চিমবঙ্গেরই এক দম্পতি তাদের আট মাস বয়সি ছেলেকে বিক্রি করে দেয় আইফোন ১৪ কেনার জন্য।

 

 
 
 
 
 
View this post on Instagram
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

A post shared by tiktok cringe pop (@tiktokcringe.pop)

কেন? কারণ জানার আগে ভারতীয়দের মধ্যে ইনস্টাগ্রামের ব্যবহার বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া যাক। ২০২০ সালের জুন থেকে, ভারতে ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীর সংখ্যা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। napoleoncat.com এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি নাগাদ, ভারতে ২৪ কোটি (২৪,৩৬,৭২,০০০) ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী ছিল, যা আমাদের দেশের জনসংখ্যার ১৬.৯ শতাংশ। ভারতেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী রয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে অর্থাৎ রিলস আসার ছয় মাস আগে, ভারতে মাত্র ৮ কোটি ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী ছিল (৮০,৫৯০,০০০), যা আমাদের জনসংখ্যার ৫.৬ শতাংশ। ২০২০ সালের জুন মাসে তা হয় ৭.১ শতাংশে।

ইনস্টাগ্রাম রিলস ভারতে আসার ৩.৫ বছরের মধ্যে, ইনস্টাগ্রামের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ শতাংশ বা ১৬ কোটি বেড়েছে। ব্রাজিলের বৃহত্তম শহর সাও পাওলোর জনসংখ্যার চেয়েও বেশি লোক আমাদের দেশে ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করে, এমনকী রাজধানী দিল্লির জনসংখ্যার চেয়েও বেশি লোক ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করে।

এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মূলত দু'টি জিনিসকে তুলে ধরছেন।

১। TikTok বন্ধ হয়ে যাওয়া
২। কোভিড-১৯ মহামারী

মনোবিদরা বলছেন, ঘরে বসেই সহজে খ্যাতি অর্জন করার রাস্তা খুলে দিয়েছে ইনস্টাগ্রাম। মানুষের বিভিন্ন প্রতিভা বিনামূল্যে বিশ্বের কাছে প্রদর্শন করার জন্য দুর্দান্ত প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে রিলস। সহজে খ্যাতি অর্জনের তাগিদেই মানুষের রিলস আসক্তি। 'ভিউ পাওয়া'-ই এখন ধ্যান-জ্ঞান। গত ৫ জানুয়ারি, জয়সলমিরে একটি গাড়িতে চার যুবক মাতাল হয়ে ইনস্টাগ্রাম রিল তৈরি করছিল। গাড়ির গতি তখন উত্তুঙ্গে। সেই গাড়ি ১৩ বছর বয়সি একটি ছেলে এবং তার মাকে পিষে দিয়ে চলে যায়। শুধু তাই নয়, ওই গাড়িটি অন্য একটি গাড়ি ও একটি গরুকে ধাক্কা দিলে সেই গাড়ির দুই আরোহীও মারা যায়। কুছ পরোয়া নেই। 'ভিউ' চাই কেবল।

মানুষের স্বভাবই হচ্ছে বিখ্যাত হতে চাওয়া। মানুষ চায় তার একগুচ্ছ অনুগামী থাকুক, মানুষ সহজে টাকা উপার্জনও করতে চায়। এবং মানুষ চায় তাঁকে অন্য মানুষ দেখুক। আজকে সিনেমার পর্দায় এমন অনেকজনকেই দেখা যায় যারা সোশ্যাল মিডিয়াতেই প্রথম কাজ শুরু করেছিলেন। সেই মানুষরা যদি পারে, আমরা কেন নই? ফলে সকলেই তারকা নিজস্ব ফোনে। রিলস তাত্ক্ষণিক তৃপ্তির নীতিকেই মাথায় রাখে। চটজলদি সুখ, তাৎক্ষণিক আরাম। যখন আমরা রিলস ব্রাউজ করি বা আমাদের তৈরি রিলসে লোকজন কমেন্ট করে তখন আমাদের মস্তিষ্কে খুব অল্প সময়ে ডোপামিন ক্ষরণ ঘটে।

আরও পড়ুন- সোশ্যাল মিডিয়ায় নিম্নমানের কাজকেই এখন দারুণ কাজ বলে মনে করা হয়: ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়

ইনস্টাগ্রাম নিয়ে অল্প নাড়াঘাঁটা করলেই 'ক্রিঞ্জ রিলস' শব্দটার সঙ্গে ওয়াকিবহাল হবেন। ক্রিঞ্জ রিলস আমরা হেসে উড়িয়ে দিই আর স্ক্রোল করে এড়িয়ে যাই। অথচ ধীরে ধীরে প্রত্যেকের ইনস্টাগ্রাম অ্যালগরিদমে আসছে এই রিলস। যেমন ধরা যাক পুনীত সুপারস্টার বলে উত্তরের একজন মানুষ, তিনি লোক হাসানোর জন্য যা খুশি করেন, পচা পানাপুকুরে ডুব দিলেন হয়তো, অকারণ! বা দক্ষিণের সঞ্জয় শাম, লেটেস্ট হলিউড পপ গান গেয়ে যা তা কাণ্ড করেন। এই রিলসগুলি কোথায় আলাদা? দেখবেন, খুব ভালো মানের ফোনে এই ভিডিও করা হয় না। সাধারণত গ্রামাঞ্চলে কোথাও ভিডিও করা হয়, একটু গ্রামীণ মানুষরাই করেন। অথচ এর ভিউ মিলিয়ন মিলিয়ন। কেন এমন? যা আমাদের কাছে 'জঘন্য' বা 'হাস্যকর' এবং অপছন্দের তা সবচেয়ে বেশি ভিউ পায়। ফলে ইনস্টাগ্রামও আমাদের কাছে এই জাতীয় 'ক্রিঞ্জ রিলস' পাঠায়। এই সঞ্জয় শাম মাত্র ৩৭টি পোস্ট করেছেন কিন্তু এক মাসের মধ্যে তার ইনস্টাগ্রামের ফলোয়ার ৩১২K!

 

 
 
 
 
 
View this post on Instagram
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

A post shared by Sanjay sham (@sham__6)

ক্রিঞ্জ রিলস দেখতে যারা পছন্দ করেন তারা নিশ্চয়ই দিল্লি মেট্রোর নানা ভাইরাল ভিডিও দেখেছেন। মেট্রোয় উঠে সিট নিয়ে লড়াই হোক বা ভরা মেট্রোয় চরম প্রেম নিয়ে আপত্তি! এই ভিডিওগুলি জলদিই ভাইরাল হতে শুরু করে। দিল্লি মেট্রো রেল কর্পোরেশন বারবার এর বিরুদ্ধে কড়া নির্দেশ দিলেও দিল্লি মেট্রোতে রিল তৈরি চলছেই। মেট্রোতে নাচা, দুম করে লাফ দেওয়া এবং রিল তৈরি করায় কোনও খামতি নেই। ভাইরাল হওয়ার আনন্দে যে ডোপামিন ক্ষরণ হয় এবং লাইক ও ভিউয়ারশিপের মাধ্যমে অন্যদের কাছ থেকে পাওয়া 'গুরুত্ব' রিলে আসক্ত করে তোলে মানুষকে। আমাদের মনোযোগও তাই কমে এখন ১৫ সেকেন্ডের! আমরা ইনস্টাগ্রামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করি, একের পর এক ১৫-সেকেন্ডের রিলস দেখেই। চিরকালের জন্য এতে আমাদের মনোযোগের সময়কাল কমে যাচ্ছে।

এই ধরনের ঘটনা বৃদ্ধির আরেকটি কারণ অবশ্যই শিক্ষার অভাব। যে দেশে বড় অংশের মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে সেখানে মানুষ প্রাথমিক শিক্ষার থেকেও বেশি জরুরি মনে করে মোবাইল ফোনকে। এই ধরনের বেশিরভাগ খুন এবং দুর্ঘটনা গ্রামীণ এলাকায় ঘটছে যেখানে মানুষের হাতে বই নেই অথচ মোবাইল আছে। খুব সুচারুভাবেই ভারতকে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় জনসংখ্যার দেশকে ইনস্টা আসক্ত করে তোলা হচ্ছে। মানুষকে আসক্ত করে রাখলে পভাব অভিযোগ সেভাবে মাথা তোলবার সুযোগ পায় না। আর তাতে আখেরে কাদের সুবিধা, এই প্রশ্নের উত্তর সকলেই জানেন। 

More Articles