অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মাঠে বামেরা, ছাত্র-যুবদের মন কি পেল ইনসাফ যাত্রা?

Insaf Yatra : ইনসাফ যাত্রা কেন হচ্ছে, সমস্ত মানুষ, বা নিদেন পক্ষে অর্ধেক সাধারণ মানুষের কাছেও তা স্পষ্ট নয়।

ইনসাফ চাই। কীসের ইনসাফ? কার থেকে ইনসাফ চাইতে হবে? এ প্রশ্ন গুলিয়ে গিয়েছে বহুকাল, গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু এ রাজ্যে নয়, সারা দেশে, বিশ্বে। কমিউনিস্ট পার্টি হকের কথা বলে, বলে ন্যায্য অধিকার আদায়ের কথা, অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার কথা। অন্যায় ঘটলে ইনসাফ চাওয়ার কথাই বলে। কিন্তু সেই কথার সুরে সুর মেলায় ক'জন? দেশের ডানপন্থী রাজনীতিতে বামপন্থার অবস্থান ঠিক কী, তা জানার জন্য এই রাজ্যে বামফ্রন্টের ইনসাফ যাত্রা দরকার ছিল। মানুষের ইনসাফের প্রশ্নের পাশাপাশি বামেদের নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা খোঁজার এক মাধ্যম ছিল এই যাত্রা। ইনসাফ যাত্রার শেষ দিনে এসে তাই এই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, ইনসাফের লক্ষ্যে লড়াইয়ে সামিল হলেন কারা? বামেদের এই যাত্রা কি ছাত্রযুবদের একজোট করতে পারল?

যুব সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় এই যাত্রায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ডিওয়াইএফআই সর্ব ভারতীয় সম্পাদক হিমঘ্নরাজ ভট্টাচার্য, রাজ্য সভাপতি ধ্রুবজ্যোতি সাহা বিভিন্ন স্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন মিছিলকে। বিভিন্ন জায়গাতে মানুষের জমায়েত ঘটেছে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। কীসের লক্ষ্যে? ইনসাফের লক্ষ্যে। কেন যোগ্য মানুষ চাকরি পাবে না, কেন চাকরি পেতে গেলে ঘুষ দিতেই হবে, কেন রাজনৈতিক নেতা মানেই দুর্নীতিবাজ - সমস্ত প্রশ্নই কিন্তু লুকিয়ে আছে ইনসাফের প্রশ্নে। চাকরি ও শিক্ষার অধিকার কেড়ে আনার দাবিতে, দুর্নীতিবাজ, দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে, বিজেপি এবং তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে হকের দাবিতে লড়াই করার আহ্বান জানিয়েছে ইনসাফ যাত্রা, কিন্তু ৪৭ দিনের এই ইনসাফ যাত্রা শেষমেশ এল কোথায়?

আরও পড়ুন- ‘সংখ‍্যালঘুরা আজও শাসকের কাছে শুধুই ভোটব‍্যাঙ্ক’: নৌশাদ সিদ্দিকি

ডিওয়াইএফআইয়ের ৪৪তম প্রতিষ্ঠা দিবস ছিল ৩ নভেম্বর। সে দিনই কোচবিহার থেকে সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের ‘ইনসাফ যাত্রা’ শুরু হয়। কোচবিহার থেকে হাঁটতে হাঁটতে দিনাজপুর, মালদহ, বর্ধমান, পুরুলিয়া হয়ে, সমস্ত জেলায় জেলায় কর্মসূচি পালন করে বাম যুবকর্মীরা আগামী ৭ জানুয়ারি পৌঁছবেন কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে। ৭ জানুয়ারি ব্রিগেড সমাবেশ রয়েছে বামেদের। এই ব্রিগেড রাজ্যে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে নিজেদের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার এক মঞ্চ তো বটেই। সকলের জন্য কাজের দাবির কথা বলেছিল এই যাত্রা। নিজের ন্যায্য চাকরি পাওয়ার দাবি আদায়ে লড়াইয়ের কথা বলেছিল ইনসাফ যাত্রা। পাশাপাশি রাজ্যের শিল্পায়ন, দুর্নীতির মতো বিষয়ও উঠে এসেছে। ডিওয়াইএফআই নেতৃত্ব জানিয়েছিল এই মুহূর্তে রাজ্যে তাঁদের চার হাজার ইউনিট আছে। প্রতি ইউনিটের তরফে বাড়ি বাড়ি কৌটো দিয়ে আসা হবে। এক মাস পরে ওই কৌটো ফেরত নিয়ে আসা হবে। মানুষের কাছ থেকে যে টাকা পয়সা উঠবে তাতেই ব্রিগেড সমাবেশ হবে। সেই সমাবেশে ফের উঠে আসবে কাজ ও শিক্ষার দাবি। উঠে আসবে রাজ্যের বেকার যুব সম্প্রদায়ের আত্মহত্যার কথা। উঠে আসবে তৃণমূল নেতাদের কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি, খাটের তলায় টাকা লুকিয়ে রাখা, চুরি করে জেলে যাওয়া। তাতে কি আগামী বিধানসভা নির্বাচনে হালে পানি পাবে সিপিআইএম? কোনওভাবেই ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে কি বিজেপি বিরোধী জোট মানুষের ভরসা পাবে?

রাহুল গান্ধিও কিঞ্চিৎ এমনই উদ্দেশ্যে ভারত জোড়ো যাত্রা করেছিলেন, আবারও করার কথা ভাবছেন। রাহুল ও কংগ্রেসের লক্ষ্য ছিল ঘৃণায় বিভক্ত দেশকে ভালোবাসা দিয়ে জোড়া। ভারত জুড়তে গিয়ে, দক্ষিণ থেকে উত্তর হেঁটে ২০২৩ সালের পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস একটি মাত্র রাজ্যে সরকার গড়েছে, তেলঙ্গানা। ‘নফরত কে বাজার মে মহব্বত কা দুকান' খুলতে গিয়ে কংগ্রেস দেশে নিজেদের অবস্থান হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে সন্দেহ নেই। সিপিএমের যুব সংগঠন ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন এই যে কোচবিহার থেকে কলকাতা পর্যন্ত পদযাত্রার ডাক দিল তাতে রাজ্যের নাগরিক-ভোটাররা, নিদেনপক্ষে ছাত্র-যুবরাও কি কোনও লক্ষ্য খুঁজে পেল?

আরও পড়ুন- আনিস কাণ্ড মনে করাচ্ছে রিজওয়ান স্মৃতি, সুবিচার পেয়েছিলেন প্রিয়াঙ্কার স্বামী?

দুই সরকারের বিরুদ্ধেই কথা বলা হয়েছে ইনসাফ যাত্রায়। মনে রাখতে হবে, রাজ্যের তৃণমূলের সঙ্গেই বিজেপি বিরোধী ইন্ডিয়া জোটে শরিক বামেরা। রাজ্য ভাগের হুমকি, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চেষ্টা, মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন বাম নেতৃত্বরা। চা বাগানের শ্রমিকদের সমস্যার কথা উঠে আসছে, পথচলতি সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা হচ্ছে। বাংলার যুব বাম রাজনীতির নেতৃত্ব হিসেবে মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের হাতে অলিখিতভাবেই ব্যাটন তুলে দিয়েছেন নেতারা। মীনাক্ষীও ইনসাফের লড়াইয়ে জমি ছাড়ছেন না, একথা স্বীকার করতেই হয়। স্বীকার করতেই হয়, বাম রাজনীতি নিজের শিকড়ের সঙ্গে সবটুকু যোগাযোগ ছিন্ন করেনি। তাই আটপৌরে মিছিল, তাই সমর্থকদের ঘরে ঘরে বা কোনও রকম একটা ঠাঁইয়ে রাত কাটানো, একসঙ্গে সামান্য কিছু খাওয়াদাওয়া – যেমনটা অতীতের বাম আন্দোলনের প্রাণ ছিল তেমনই। একদিকে প্রবল ক্ষমতাশালী শাসক, অন্যদিকে খেটে খাওয়া মানুষের দল। খেটে খাওয়াদের লড়াই এমনই ছিল বরাবর। কিন্তু 'খেটে খাওয়া' শব্দটিই খেই হারিয়েছে। খেটে খেতে গেলে রাজ্যে কী কী পরিস্থিতি পোহাতে হয় মানুষ জানেন।  কিন্তু এই প্রাণের আঁচ কতখানি ছুঁল মানুষকে?

রাজ্যের বেহাল শিক্ষাব্যবস্থা, স্কুল বন্ধ হওয়া, সরকারি চাকরি না পাওয়া, সাংস্কৃতিক অদ্ভুত মোড় বদল, মানুষকে ক্রমেই ধর্মে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার চেষ্টা, মানুষকে নিজের কথা বলতে ভুলিয়ে দেওয়া বা সামান্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দূরের সমস্যা দেখতে না দেওয়া কি মানুষকে ভাবায়? এই রাজ্যের মহিলাদের ব্যাপক ভোট পেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর সরকার। নেপথ্যে উঠে আসে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্পের কথা। সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি যে আসলে সুবিধা ঠিক পাইয়ে দিচ্ছে না উল্টে কেড়ে নিচ্ছে বাঁচার ভালো সুযোগ এই প্রশ্ন কি ইনসাফ যাত্রা জাগাতে পেরেছে মানুষের মধ্যে? এই রাজ্যের বিজেপির বাড়বাড়ন্ত এবং আরএসএসের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি একদিনে হয়নি। ইনসাফ যাত্রা কোচবিহার থেকে কলকাতা এসেছে ঠিকই। কিন্তু বছরের বাকি সমস্ত দিন বাম আন্দোলন যাদবপুর-কলকাতা এলাকা ছেড়ে কেন বেরোতে পারেনি এই প্রশ্নের উত্তর মেলে না ঠিক। এই প্রশ্নের গোড়াতেই রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তরে দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি বসে থাকে। নীরবে, নিরুচ্চারে নিজেদের কাজ করে যায় তারা। সেই ফল এতদিনে মিলছেও।

ইনসাফ যাত্রা কেন হচ্ছে, সমস্ত মানুষ, বা নিদেন পক্ষে অর্ধেক সাধারণ মানুষের কাছেও তা স্পষ্ট নয়। আনিস খানের মৃত্যুর কথা কি মানুষের মনে নতুন চিন্তা জাগাল? ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে যাওয়ার মাশুল গুনতে হয়েছে যে দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষদের, বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে শাসক দলের ছত্রছায়ায় সেই মানুষদের ভরসায় জায়গায় কি আসতে পারবে বামেরা? ভোটের রাজনীতি আর মাঠের রাজনীতি এই রাজ্যে আলাদা হয়ে গিয়েছে। বামেদের ব্রিগেডের ভিড় দেখে তাই ভোটের হিসেব করতে বসা একেবারেই কাম্য না। কিন্তু একেবারেই কি ব্যর্থ ইনসাফের লড়াই? এমন অস্থির সময়ে ছাত্রদের, যুবদের কাছে কোনও ঢেউই কি তোলেনি এই যাত্রা? মাঝে মাঝে নিজের পাশে অন্যকে দেখলে ভরসা বাড়ে। মিছিলে সমমনস্ক মানুষের পাশে যখন আরও সমমনস্করা এসে জোটেন, লড়াইয়ের বীজ তাতে জল পায়, সার পায়। প্রতিনিয়ত হেরে যাওয়া মানুষ জানে একা বলে কিছু হয় না। অন্ধকার আলোর অভাব মাত্র, আলো নেই তা নয়। এই আলোদের জোট বাঁধানোর লড়াই যদি বামেরা করতে পারেন, একদিনে না হোক একদিন হবেই। 

More Articles