আউআউ পাগল, রঙ-ওঠা কমলা চাঁদ আর গহিন জঙ্গলের সেই কান্না

Lost in the Jungle : সারথি একটু দূরে চোখ-মুখে জল দিতে দিতে কাকে যেন বলছেন যে, ভাগ্যিস একটা বাচ্চা মেয়ের কান্না শুনতে পেয়েছিলেন

দনা দাদা হেঁটে ফিরত যে গ্রামে, সেখানে পৌঁছতে নিশ্চিতভাবেই রাত হয়ে যেত। আমরাও একবার হুট করে সেখানে গিয়ে পড়েছিলাম। সে বার রাত আরও কড়া। ঠিক মনে নেই, বোধহয় রাউরকেল্লা থেকে ফিরছিলাম। ধুলোমাটি, জঙ্গল, তীরভাঙা হাওয়া, ওই ঘুরঘুট্টিতে এই এদেরই যা দহরম মহরম তখন। আমাদের লক্ষ্যভ্রষ্ট গাড়ি সে আবহে ঘোরতর ইন্ট্রুডার, খানিক পরেই বোধ হলো। নয়তো একবার পথ হারিয়ে ফেলা জন কোন ছলনায় হারায় আরও ভিটেমাটি? নির্ঘাৎ তা ওই ভ্রুকুটি তোলা ধুলো-মাটি-হাওয়া-জঙ্গলের সঙ্ঘবদ্ধ চাহনির ফল। ততদিনে চরাচরে শীত ভালোই নামতে শুরু করেছে। ৮/৯ তো হেসেখেলে। সেলসিয়াস। তখন ওপরচালাকি কাকে বলে জানতাম না কিন্তু বাবাকে কিছুক্ষণ পর থেকে অস্বাভাবিকরকম চুপ করে থাকতে দেখে বুঝেছিলাম, সারথি ওপরচালাকি করতে গিয়ে কমপ্লিট রসাতলে নিয়ে গিয়েছেন ব্যাপারখানি। তখন ও তল্লাটে কোথায়ই বা আর মাওবাদী আতঙ্ক, তা বলে ডাকাতি আবিষ্কার হয়নি এমন তো না! বা ওসব নয় ছেড়েই দিলাম, খামখা ৭৫% ঠিক রাস্তায় এসে যদি সহসা পথ হারিয়ে অতীব অন্ধকারের ঠেলায় চোখে নিথর জাগে প্রবল, কেমন লাগে, বলুন? আমি বসেছিলাম, জিপ গাড়ির পেছনে, মা-বাবা সামনে। আমি ওদের সিট আঁকড়ে বসেছিলাম, কারণ পেছনে তাকালেই তো নির্ঘাৎ দেখব, উল্টোদিকে হাসি মুখে বসা ভূত, বা না বসে পড়লেও অন্তত দূর থেকে গাড়ি ফলো করছে ওরা। (নাকি চন্দ্রবিন্দু লাগিয়ে উড়িষ্যার ভূতকেও ওঁরা বলতে হবে!) আরও মুশকিল হলো, গাড়ির হেডলাইট তো সামনে থাকে, ফলে নিকষ ঘন কালোর আচ্ছাদনের মাঝে ওটুকুই যা সম্বল। এক-একটা করে হাটিং পেরিয়ে যায়, কখন যে পিচের রাস্তা ছেড়ে কাঁচায় নেমে এসেছে গাড়ি খেয়াল নেই। আর আমি শেষ বারের জন্যেও পেছনে তাকাই না।

খানিক তন্দ্রা এসেছিল বোধহয়, নিজে থেকেই দেখি গুটিসুটি হয়ে অতলে সেঁধিয়ে গেল। গাড়ি থেমেছে। বা বলা ভালো, থামানো হয়েছে। বাবা আর চুপ করে থাকতে পারেনি। নেমে পড়েছে গাড়ি থেকে। মা সারথির সঙ্গে একবার বোধহয় লাস্ট (বৃথা!) চেষ্টা করছে, কোনওভাবে স্যালভেজ করা যায় কি না অবস্থা। কল বন্ধ করার পর বেসিনের বাকি জল যেমন গোঁত্তা খেয়ে প্রাথমিকভাবে একজোট হয়, তেমনই অন্ধকার ক্রমে জমাট বাঁধতে এল গাড়ির কাছে। ভারি উৎসুক তারা। আমার নামতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কখন পিঠে গুদুম খেয়ে যাব, বিশেষত ওই পরিস্থিতিতে, ভরসা নেই, তাই সিটের ধারে এসে খামোখাই আকাশে তাকিয়েছি। এখন হলে, তারাভরা আকাশের অবস্থা দেখে গড়িয়ে পড়েই যেতাম কিন্তু ’৮৭-’৮৮ সাল নাগাদের আকাশ তো আমাদের গা-সওয়া। বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানকে নামিয়ে দিলেও, কী অন কী অফ, তারাদের ভেতর এক ফোঁটাও যদি গ্যাপ বের করতে পারে, কান কেটে ফেলব।

আরও পড়ুন- বুনো গন্ধের ঝোঁক ধরিয়েছিলেন গুহমশাই

তো সেই তারাদের ঝাঁক নীচে আমাদের দেখছে। অন্ধকার আরও কিছুটা কাঁধ ঝুঁকিয়ে জানতে উদগ্রীব, পরবর্তী পদক্ষেপ। কিন্তু পদক্ষেপের জন্যে তো লাগে একটা দিশা, আর আমাদের অবস্থান সে মুহূর্তে দিশাহীনতার ভ্যাকিউম। আরও কিছুটা আনতাবড়ি গেলাম। নতুন ভেসপা স্কুটার নিয়ে পাড়ায় ঢুকলে যেমন পেছন পেছন আসত মুগ্ধ/আশ্চর্যে হাঁ কচিকাঁচা, তেমনই অন্ধকারের পাল এগোল গাড়ির সঙ্গে। রাতের পাখি অনেকক্ষণ আগেই নিদ্রা গিয়েছে, সবেমাত্র ঝিঁঝিঁগুলোও শো শেষ করল। যাঁরা এই অবধি পড়লেন, অনেকেই হয়তো ভাবছেন, কী রে বাবা, কিছুই তো ঘটে না, একটা কিছু ড্রামাটিক বা সামথিং লাইক দ্যাট। দুঃখিত, কিছুই বোধহয় সে কালে ঘটত না, জাস্ট এমনিই বইত। ছোট ছোট বাঁক ম্যাক্সিমাম।

তার উপর আবার ওখান থেকে কীভাবে দনা দাদার গ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম, সেও গেছি ভুলে। নিশ্চয়ই এটা ওটা হাতড়াতে হাতড়াতে এক সময়ে। রাত তখন আড়াইটের কাছাকাছি, ছোট ছোট গাছের ডাল-টাল জোগাড় করে গ্রামের কয়েকজন আগুন জ্বালিয়েছেন। মা আর আমি হাটিংয়ের একটা গোবর দিয়ে নিকনো দাওয়া মতো জায়গায় বসে, হতভম্ব। মায়ের কোলে আচমকা ঘুম ভাঙা আরও হতভম্ব দু’এক জন বাচ্চা আমাদের দেখছে। বাবা একটা হিল্লে করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ একজন বাবাকে চিনে সামনে এসে নমস্কার-টমস্কার করে পরিচয় দিল, সে দনা দাদার এক তুতো ভাই। তারপরই অন্যদের কীসব ইশারা করায়, যত্নআত্তি যেন দু’ডিগ্রি গেল বেড়ে। আসলে দনা দাদা ওই গ্রামের মোড়ল আর তিনি যেখানে কাজ করেন, সে অফিসের মাথা হলো গিয়ে বাবা, অতএব। বাবা হাসিমুখে মায়ের কাছে এসে বলল, দেখো দনা কতবার বলেছিল এখানে আসতে, হয়ে উঠল না। আর আজ এ কী কাণ্ড! মা-ও হিন্দিতে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করছে, তো দনা দাদা কই, কত দূর ওর হাটিং। ওই তুতো ভাই আর বাকিরা দেখি চুপ।

সারথি একটু দূরে চোখ-মুখে জল দিতে দিতে কাকে যেন বলছেন যে, ভাগ্যিস একটা বাচ্চা মেয়ের কান্না শুনতে পেয়েছিলেন, না হলে ওই জঙ্গলের মধ্যে কী করে যে এই অবধির পথ খুঁজে পেতেন, ভাবতেই পারছেন না। বাবা ওই তুতো ভাইকে জিজ্ঞেস করছে যে, দনা তিন-চার দিন কেন অফিস আসেনি, শরীর ঠিক আছে তো? তার পর বলছেন, এখন ওকে জাগানো উচিত হবে না, এই সব। আর আমি দেখছি সেই তুতো ভাই বাবাকে ঠায় দাঁড়ি করিয়ে সারথির কাছে চলে যাচ্ছেন। পিঠে হাত রেখে প্রশ্ন করছেন, কোথায় শুনলে মেয়ের কান্না। সারথি খুব ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট ভাবে বলছেন, ওই তো জঙ্গলের ওইখানটায়, যেখান থেকে হঠাৎ করে বাঁ দিকে ঘুরেই এই গ্রাম দেখতে পাওয়া গেল। আমি ভাবছি কই আমি তো শুনতে পেলাম না। মা-বাবা-ও চোখ চাওয়াচাওয়ি করছে, কারণ এমন কিছুই সত্যি শোনা যায়নি।

তুতো ভাই বাবাকে তারপর এসে বলেছিলেন, দনা দাদার এক মেয়ের সদ্য বিয়ে হয়েছিল। দিন তিন আগে খবর আসে, সে শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে, আর পাওয়া যাচ্ছে না। শ্বশুরবাড়ি দূর না, ওই জঙ্গলের ও পারে। মানে বাপের-শ্বশুরবাড়ির মাঝে ওই জঙ্গলটা। দনা দাদা সেই থেকে জঙ্গলে মেয়েকে খুঁজে চলেছে…

দনা দাদা ফিরেছিল। মেয়ে ফেরেনি। একদিন হঠাৎ আমাদের বাড়ি এসে, বাবাকে অনেকটা আশীর্বাদ করে হাউহাউ করে কেঁদেছিল। আগের এক পর্বে লিখেছিলাম এ মুহূর্তের কথা। আমি ভেবেছিলাম বোধহয়, দিন কিছু পর এই ডিসেম্বর মাসেই বাবা সাংঘাতিক অসুস্থ হয়ে পড়বে আর আমার নিকনো উঠোনে বসে ডাকবে দাঁড়কাক-রূপী অশনি সংকেত, সেটি দনা দাদা আগেভাগে জেনে ফেলেছিল। হয়তো ভুল ভাবিনি। হয়তো দনা দাদা শুনে ফেলেছিল নিরুদ্দেশ সম্পর্কে সে অমোঘ ঘোষণা!

আরও পড়ুন- মফস্সলের শানু-সন্ধ্যা এবং এক গিটারবাজিয়ের গল্প

এই যে লস্, মানে এক খণ্ড করে চিরতরে শূন্য হয়ে যাওয়া, প্রিয় জনের, প্রিয় ক্ষণের, সেটি বোধহয় অনেক বেটার বুঝতেন যাঁরা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন। দনা দাদা যেমন, বিরোশমনি যেমন। গুড়াকু ছাড়া চলত না বিরোশমনির। আমাদের বাড়ি কাজ করতেন। মা বলত, কাজের সময় ওসব না খেতে, তাও বিরোশমনি লুকিয়ে খেতেন (না এতই কাছের ছিল যে খেত বলি, খেতেন পারছি না), তার পর ধরা পড়ে গেলে, সে কী হাসি! আমায় খুব ভালোবাসত, খুব ছোট ছিলাম যখন, আমায় কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে গান গাইত। ‘রঙ্গবতী ও রঙ্গবতী’, তার পর ‘বড় লোকের বিটি লো, লম্বা লম্বা চুল…’। এক বার আমার জ্বর হল, সারেঙ্গী ডাক্তার, কালো কোট ও ব্রিফকেস নিয়ে দেখতে এলেন। বিচ্ছিরি খেতে ক্রোসিন সিরাপ দিলেন, কিছুতেই কিছু হয় না। বিরোশমনি বাড়ি গেল না। মায়ের শত বলাতেও না। খাটের পায়ার কাছে বসে জলপট্টি করে। আর খানিক পর পর, বাইরে গিয়ে অদ্ভুত একটা গোঙানির মতো কান্না কাঁদে।
রাউরকেল্লা থেকে ফেরার সময় যে গাড়ির সারথি ছিলেন, তাঁর সঙ্গে তারপর দেখা হয়নি, তিনি থাকলে জিজ্ঞেস করা যেত, বিরোশমনির ওই কান্না আর জঙ্গলের সেই কান্না কি একদম এক?

নিভে যাওয়ার ব্যথা আর বুঝতে পারছি নিভে যাব/যাবে’র ব্যথার তফাতটা ওদের থেকে বুঝে এলে এ কালে কাজ দিত।

এখন যখন বাড়ি ফিরি, মা ফ্লাইওভার দিয়ে, গড়িয়ার দিকে যেতে গেলে, বাঁ হাতে ম্যারিয়ট, আইটিসি রেখে যখন নামি, পাই মাঝেমাঝে রঙ-উঠে যাওয়া কমলা চাঁদকে। কেন জানি বারেবারে আউআউ পাগলের কথা খুব মনে পড়ে। সারেঙ্গী ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকার দরজায় চুপ করে বসে থাকত। কেউ বলত, অঙ্ক করতে করতে পাগল হয়ে গেছে, কেউ বলত, ভালোবাসা হারিয়ে, চেনা টেম্প্লেট সব, আমি জানি না, কেন সে পাগল হলো। শোনা যেত, অন্যদের পাথর ছুঁড়ত, কতটা সত্যি জানি না। আমার দিকে অদ্ভুতভাবে শুধু তাকাত। আমি ভয়ে আড় চোখে সেটুকু বুঝতাম। কিন্তু তখন জিজ্ঞেস করা হয়নি, কেন, কেন তাকাত?

এখন ওই চাঁদটা উঠলে খুব মনে পড়ে। দনা দাদা, বিরোশমনি, আউআউ পাগল…

More Articles