ইরানকে হামলার জবাব ইজরায়েলের, নেতানিয়াহুর হাতে রাফাহ দিয়ে যুদ্ধ থামাতে পারবেন বাইডেন?

Iran-Israel Conflict: সূত্রের খবর, ইরান-ইজরায়েলের মধ্যে বড়সড় সংঘাত বা যুদ্ধপরিস্থিতি এড়াতে রাফাহ শহরের রফা করছে আমেরিকা। ইরানে হামলা এড়াতে শোনা যাচ্ছে রাফাহ আক্রমণের অনুমোদন দিয়েছে আমেরিকা।

আশঙ্কা ছিলই। আশঙ্কা সত্যি করে ইরানকে জবাব দিয়েই দিল ইজরায়েল। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাল নেতানিয়াহু সরকার। গত কয়েক দিনে লাগাতার বৈঠক করে গিয়েছে ইজরায়েলের ওয়ার ক্যাবিনেট। বুধবারই হুঁশিয়ারি দিয়েছিল ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। যে কোনও ভাবেই দেশের সুরক্ষায় পদক্ষেপ করবেই ইজরায়েল। ইরানের হামলার জবাব না দিতে পারলে তা যে হবে তাদের দুর্বলতার প্রমাণ, তা-ও পরিষ্কার করে দিয়েছিল ইজরায়েলের সরকার।

হাজার বারণ, মিত্র দেশের প্রতি অখণ্ড আস্থা- সবটাই জলে গিয়েছে আমেরিকার। আমেরিকার বিশ্বাস ছিল, হিজবুল্লাহ, হাউথির মতো ইরানের মদতদাতা গোষ্ঠী অর্থাৎ প্রক্সি গ্রুপগুলির উপরে হামলা চালাতে পারে ইজরায়েল। কিন্তু আমেরিকার সেই ভবিষ্যদ্বাণী ফলেননি শেষপর্যন্ত। শুক্রবার ভোরে বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ইরানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ইসফাহান। তবে সেখানকার পরমাণু স্থাপনা কেন্দ্রটি নিরাপদ বলেই জানানো হয়েছে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের তরফে। যদিও ইরান বা ইজরায়েল, কোনও সরকারই হামলার ব্যাপারটি নিশ্চিত করেনি।

গত শনিবার মধ্যরাতে ইজরায়েলে হামলা চালায় ইরান। ইজরায়েলের আকাশপথে ধেয়ে আসে প্রায় তিনশোটির কাছাকাছি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র। সেই সবগুলিকেই অবশ্য আকাশপথেই ধ্বংস করে ইজরায়েল। সেই কাজে সাহায্য করেছিল ব্রিটেন, আমেরিকার মতো মিত্র দেশগুলোও। গত ১ অক্টোবরে ইরানের দামাস্কাসে হামলা চালায় ইজরায়েল। যাতে বেশ কয়েকজন সেনা আধিকারিকের মৃত্যু হয় বলে খবর। সেই হামলার প্রতিশোধ নিতেই ইজরায়েলে হামলা বলে জানিয়েছিল তেহরান। তার পর থেকেই ইজরায়েলের পাল্টা হামলার আশঙ্কা ছিল। এক সপ্তাহের মধ্যেই বদলা নিল ইজরায়েল। ইরানের বড়সড় শহরে চলল হামলা।

ইজরায়েলের বর্তমান সরকারের আগ্রাসন নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। সেই আগ্রাসন গত ৬ মাসে টের পেয়েছে গাজা। ইতিমধ্যেই ৩৪ হাজার বাসিন্দার মৃত্যু হয়েছে গাজায়। এক লক্ষ মানুষ জখম। তার পরেও গাজায় হিংসা তো বন্ধ করেইনি ইজরায়েল, বরং উত্তরোত্তর তা বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। এরই মধ্যে ইজরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে জড়ায় ইরান। ইরানকে মদত দিয়েছে লেবাননের জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল্লা, ইয়েমেনের জঙ্গিগোষ্ঠী হাউথি ও অবশ্যই প্রচ্ছন্ন ভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী হামাস।

আরও পড়ুন: নেতানিয়াহুর হুমকির পরেই ইরানে জারি রেড অ্যালার্ট! কোন দিকে যাচ্ছে ইজরায়েল-ইরান অশান্তি?

ইজরায়েল পাল্টা কোনও পদক্ষেপ না করলে ইরান যুদ্ধ এগিয়ে নিয়ে যাবে না বলেই সতর্ক করেছিল তেহরান। এমনকী যে যে দেশ ইজরায়েলের হয়ে ইরানের সঙ্গে শত্রুতা করবে, তাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধঘোষণা করার কথা জানিয়ে দিয়েছিল তারা। প্রমাদ গুনে যুদ্ধশান্তির পক্ষেই ছিল আমেরিকা। বন্ধুদেশ ইজরায়েলকে নিয়ত বোঝানোর চেষ্টা করেছে, যাতে তেমন কোনও পদক্ষেপ না করে নেতানিয়াহু সরকার। বরঞ্চ প্রক্সি গ্রুপগুলোকে দমন করার পরামর্শও পরোক্ষভাবে ইজরায়েলকে দিয়ে গিয়েছে আমেরিকা। কিন্তু জো বাইডেনের পরামর্শ যে নেয়নি ইজরায়েল, তার প্রমাণ শুক্রবারের হামলা।

অনেকেই মনে করেছিল, ইরানের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে আঘাত হেনে বদলা নিতে পারে ইজরায়েল। আশঙ্কা ছিল, সাইবার হানারও। এর আগেও ইরানের বহু বিজ্ঞানীকে ইজরায়েল হত্যা করেছে বলে অভিযোগ। এমনকী ইরানের সেনাঘাঁটিতে হামলার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। তবে সেই সব চেনা পথে হাঁটল না ইজরায়েলের ওয়ার ক্যাবিনেট। বরং তারা হামলা করল ইরানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ইসফাহানে। ইসফাহানেও অবশ্য বেশ কয়েকটি সেনা ঘাঁটি ও ফেসিলিটি রয়েছে। তাছাড়া প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের বাস এই শহরটিতে। ব্লুমবার্গকে দুই মার্কিন কর্তা আগেই জানিয়েছিল, ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পাল্টা হামলা করে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে ইজরায়েল। আর হলও তেমনটাই।

ইজরায়েলের হামলার উত্তরে জবাব দিয়েছিল গত শনিবার রাতে ইরান। তার উত্তরে শুক্রবার ভোরে হামলা চালাল ইজরায়েল। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, বল এবার ইরানের কোর্টে। এবার কি পাল্টা হামলার পালা তেহরানের? এবার কি সরাসরি যুদ্ধের পথেই হাঁটতে চলেছে পশ্চিমের এই দেশটি। শুক্রবারের হামলার পর সেই আশঙ্কাই চওড়া হয়েছে আরও।

US official says Israel launches strike on Iran

ইরান জানিয়েছে, তারা তিনটি কোয়াডকপ্টারকে নিজেদের ভূখণ্ডে গুলি করে নামিয়েছে। বেশ কয়েকটা বিস্ফোরণ ঘটেছে সিরিয়ার কয়েকটি সেনা ঘাঁটিতেও। যা ইজরায়েলের জবাব হিসেবেই দেখছে তেহরান। যদিও এই হামলায় ইরানের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রের ক্ষতি হয়নি বলেই জানিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (IAEA)। আমেরিকার তরফে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা বলা হলেও ইরানের দাবি কোনও ক্ষেপণাস্ত্র ছিল না। ছোট বিমান নিয়ে হামলা চালানো হয়, যা গুলি করে নামিয়েছে ইরানি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। তবে দুই দেশই হামলাকে বিশ্বের সামনে ছোট করে তুলে দেখাতে চাইছে বলে দাবি বিশেষজ্ঞমহলের।

ইরান অপরিশোধিত তেল আমদানির অন্যতম বড় কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত গোটা বিশ্বে। আমেরিকা, চিন-সহ একাধিক দেশে তেল সরবরাহ করে ইরান। ইরানে যুদ্ধ লাগার প্রভাব যে সেই বাজারে বড় প্রভাব ফেলবে, তা একবাক্যে মানেন সকলেই। সে জন্য ইরানের হামলাকে সমর্থন না করলেও সে দেশের সঙ্গে সরাসরি বৈরিতায় যেতে চায় না কোনও দেশই। বিশেষত আমেরিকা তো নয়ই। চলতি বছরেই আমেরিকায় ভোট। ইরানের তেল রফতানির উপর যে কোনও ধরনের কঠোর সিদ্ধান্ত চিনকে আমেরিকার উপর ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে বলেও বিশেষজ্ঞদের মত। ফলে ভোটের আগে সেই সংঘাতে জড়াতে চান না মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

US official says Israel launches strike on Iran

প্যালেস্টাইনের সঙ্গে ইজরায়েলের দ্বন্দ্বে গোড়া থেকেই নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়িয়েছে আমেরিকা। গোটা বিশ্বের তাবড় দেশ ইজরায়েলকে গাজায় যুদ্ধের তীব্রতা কমানোর অনুরোধ করলেও, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিল আমেরিকা। অতি সম্প্রতি নিজের অবস্থান থেকে সামান্য সরে আমেরিকা। গাজায় ৩৪ হাজার মৃত্যু ঘটার পর ইজরায়েলের কাছে গাজায় যুদ্ধশান্তির প্রস্তাব দেয় আমেরিকা। এমনকী হামাসের সঙ্গে সমঝোতার জন্যেও ইজরায়েলকে বুঝিয়েছিল জো বাইডেন সরকার। রমজান থেকে ইদ চলাকালীন একাধিক বার আমেরিকা ইজরায়েলকে যুদ্ধবিরতি ডাকার আহ্বান জানিয়েছে। এমনকী রাফাহ শহর উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তেও ইজরায়েলের পাশে ছিল না আমেরিকা। বরঞ্চ আমেরিকার থেকে সবুজ সংকেত পায়নি বলেই থমকে ছিল ইজরায়েল।

তবে ইরানের সঙ্গে আমেরিকার স্বার্থ অনেক বেশি জড়িয়ে। গাজার রাফাহ শহর বাঁচানোর ক্ষেত্রে তা ততটা জড়িয়ে ছিল না কোনও কালেই। মানবাধিকার রক্ষার প্রয়োজনেই আমেরিকা শান্তির পক্ষে সওয়াল করেছিল। কোনও কোনও সূত্রের খবর, ইরান-ইজরায়েলের মধ্যে বড়সড় সংঘাত বা যুদ্ধপরিস্থিতি এড়াতে এবার রাফাহ শহরের রফা করছে আমেরিকা। ইরানে বড় হামলা এড়াতে শোনা যাচ্ছে রাফাহ আক্রমণের অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে আমেরিকা। ইরান থেকে ইজরায়েলের মন ঘোরাতে রাফাহ অস্ত্রকেই কি ব্যবহার করতে চাইছে আমেরিকা? জানা গিয়েছে, ইজরায়েল নাকি নতুন করে রাফাহ আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এমনকী অস্ত্র মোতায়েন করাও রাফাহে শুরু করে দিয়েছে ইজরায়েল।

আরও পড়ুন: ইরানকে ‘সবক’ শেখাতে কতদূর যাবে ইজরায়েল? ভারতকেও ভুগতে হবে ফল?

এদিকে ইরানের সঙ্গে ইজরায়েলি যুদ্ধের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। ইরান ইজরায়েলে হামলা করার পর থেকেই পড়তে শুরু করে শেয়ারবাজার। তাতে ক্ষতির মুখে পড়েছে ভারতও। এবার ইরানে ইজরায়েলের হামলার পরেই এয়ার ইন্ডিয়া বন্ধ করে দিল তেল আভিভ থেকে সমস্ত বিমান পরিষেবা। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ থাকবে পরিষেবা। দুবাই থেকে পর্যন্ত সমস্ত উড়ান বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে টাটা গোষ্ঠীর মালিকানাধীন এই বিমানসংস্থাটি।

এদিকে এখনও যুদ্ধের পথ থেকে সরে আসতে রাজি ইরান। হামলা-পাল্টা হামলার এই ধারাবাহিকতা বন্ধ করতে চায় তেহরান। তবে ইজরায়েল যদি তাদের আগ্রাসন কমায়, তবেই আলোচনার পথে শান্তি সম্ভব বলে জানিয়ে দিয়েছে ইরান। আদৌ কি সেই কথা শুনবে ইজরায়েল। রাফাহ ধ্বংসের রিমোট হাতে তুলে দিয়ে কি সত্যিই ইরানের দিক থেকে ইজরায়েলের মুখ ঘোরাতে পারবে আমেরিকা? একটা শহরের বিনিময়ে একটা দেশের রফা আদৌ কি কার্যকরী? ইজরায়েলের নতুন এই হামলার পর একাধিক আশঙ্কা ভাসছে হাওয়ায়।

More Articles