বাল্মীকির দায়সারা চরিত্র! যেভাবে রামের হাতে মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছিল অনার্য মারীচ

Maricha in Ramayan: মারীচ নিতান্ত বালকবয়সেই অনাথ হয়ে গেল, চোখের সামনে দেখল মায়ের নৃশংস মৃত্যু, তাঁর মনের অবস্থা কী হল?

মহাকাব্যের মহাকবি এক বিচিত্র চরিত্র। মহাকাব্যের বিরাট পটভূমিতে সব চরিত্রই যেন তাঁর হাতের ক্রীড়নক। তাঁদের ব্যবহারে মহাকবি কখনও ঢের বেশি উদার, কখনও একেবারেই কৃপণ। যে চরিত্র সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করার ছিল, সেখানে তিনি একেবারে নিশ্চুপ! আবার যে চরিত্র সম্পর্কে ততটা আলোকপাত না করলেও চলত, সেই বিষয়ে তিনি মুখর। আদিকবি বাল্মীকির মহাকাব্য রামায়ণ ঠিক সেই রকমই। বিচিত্র চরিত্রের বিচরণভূমি রামায়ণে এমন অনেক চরিত্র আছে যারা কবির খামখেয়ালের বশে নিজেদের প্রকাশ করতেই পারেনি। তেমনই একটি চরিত্র মারীচ। রামায়ণে তাঁর পরিচয় সে একজন রাক্ষস, মায়াবী। রাবণের সীতাহরণের ঘটনায় সোনার হরিণ সাজা মারীচের ভূমিকা কেই বা ভুলতে পারে। সীতা তো তাঁকে চিনতে পারেনইনি, এমনকী অবতারপুরুষ রামচন্দ্রও শেষ মুহূর্তে গিয়ে তাঁকে চিনেছেন, যখন সীতাহরণ হয়ে যাওয়ার জমি প্রস্তুত। কিন্তু এই যে মারীচকে কেন্দ্র করে এত প্রবাদ-প্রবচন-বাগধারা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, সোনার হরিণের অলীক স্বপ্ন, উভয়সংকটের মূর্তিমান প্রতীক হিসেবে মারীচ যেখানে সর্বদা আলোচিত, চর্চিত, তাঁর পরিণতিটুকুই কেবল বাল্মীকি দেখিয়েছেন, আগে পরে তিনি উদাসীন। তাই আমরাও মারীচ নামক চরিত্রটির খবর বিশেষ রাখি না। কিন্তু রামের জীবনের প্রায় প্রথমদিক থেকে বনবাসজীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া পর্ব সীতাহরণ পর্যন্ত একটি নামই সূক্ষ্মভাবে বিচরণ করে, মারীচ। কেন? কারণ অনুসন্ধান করা যাক।

রাম জীবনের প্রথম যুদ্ধ করেছিলেন যাঁর বিরুদ্ধে তাঁর নাম রামায়ণের পাঠকমাত্রই জানেন, তাড়কা রাক্ষসী। বিশ্বামিত্র মুনি এই তাড়কা রাক্ষসীর কবল থেকে তাঁর তপোবনকে রক্ষা করার জন্যই রাম আর লক্ষ্মণকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। রামায়ণের পাঠক এও জানেন যে, রামের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছিল দুইজন, তাড়কা আর তাঁর পুত্র মারীচ। সেখানেই আমরা মারীচকে প্রথম পাই। এই প্রসঙ্গেই মারীচের জীবনের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, এক অভূতপূর্ব ব্যাপার। এমনকী রাক্ষসী পরিচয়ধারিণী তাড়কারও জীবনের এক অজানা অধ্যায়। জানলে অবাক হতে হয় যে, জন্ম থেকেই তাড়কা 'রাক্ষসী' ছিলেন না। তিনি ছিলেন সুকেতু নামক এক সদাচারী যক্ষের একমাত্র কন্যা। নিঃসন্তান সুকেতু সন্তানকামনায় ব্রহ্মার আরাধনা করে সন্তান হিসেবে পেয়েছিলেন তাড়কাকে। উল্লেখ্য, তাড়কা কিন্তু তথাকথিত 'অবলা' ছিলেন না, ব্রহ্মা তাঁকে সহস্র হস্তীর বল দান করেছিলেন। এই বল শারীরিক না মানসিক তার উল্লেখ নেই কিন্তু বল যে শারীরিক বলের পাশাপাশি মনোবলেরও পরিচায়ক, তার পরিচয় একটু পরেই পাওয়া যাবে। সুকেতু তাড়কার বিবাহ দেন সুন্দ নামক যক্ষের সঙ্গে (তিনি কিন্তু স্বর্গের সুন্দরীশ্রেষ্ঠা তিলোত্তমার পাণিপ্রার্থী ভ্রাতৃদ্বয় সুন্দ-উপসুন্দের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নন)। এই সুন্দ ও তাড়কার পুত্রই হলো মারীচ।

আরও পড়ুন- চক্রব্যূহে একা কিশোর, কর্ণ নন, কেন মহাভারতের আসল ট্র্যাজিক হিরো অভিমন্যু!

আগেই বলেছি, যে বিষয়ে মহাকাব্যে আলোকপাত করা প্রয়োজন, সেই বিষয়েই আদিকবি আশ্চর্যজনক উদাসীন। তাই কিছুকাল পরেই সুন্দের অজ্ঞাত কারণে অগস্ত্যমুনির অভিশাপে মৃত্যু হলো, সেই কারণ বাল্মীকি উল্লেখ করেননি। আর সেই শোকে তাড়কা পুত্র মারীচকে সঙ্গী করে আক্রমণ করলেন অগস্ত্যমুনিকে। আগেই বলেছি, তাড়কা বলহীনা ছিলেন না। অগস্ত্যমুনি তাড়কাকে ভীষণদর্শনা রাক্ষসীতে পরিণত হওয়ার অভিশাপ দিলেন। রেহাই পেল না মারীচও! সে-ও শাপগ্রস্ত হয়ে রাক্ষসে পরিণত হল। এই ঘটনা সূক্ষ্মভাবে হলেও সমাজের একটি দিককে নির্দেশ করে। তখন সমাজে আর্য-অনার্যের স্পষ্ট বিভাজন ছিল। অগস্ত্যমুনি আর্যদের প্রতিনিধি আর রাক্ষস-অসুর-যক্ষ নামধারীরা সকলেই অনার্যের প্রতিনিধি। আর্যসভ্যতার প্রসারের আলোর নীচে জমাট অন্ধকারের মতো কত যে অনার্যের জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অগস্ত্যশাপে সুন্দের মৃত্যু, তাড়কার রাক্ষসীতে পরিণত হওয়া আর আর্যসভ্যতার আরেক প্রতিনিধি রামের তাঁকে হত্যা করার বিষয়টিও একসূত্রে গাঁথা।

যাই হোক, বালক রামের সঙ্গে যুদ্ধে রাম তাড়কাকে হত্যা করলেন , আর মারীচ কিন্তু আহত হয়েও বেঁচে রইল। হয়তো রাম তাঁকে হত্যা করেননি বালক ভেবেই বা আদিকবি রামকে দিয়ে মারীচকে তখনই হত্যা করাননি, সীতাহরণে তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা হতে পারে এই কথা স্মরণে রেখে। কিন্তু এই যে মারীচ নিতান্ত বালকবয়সেই অনাথ হয়ে গেল, চোখের সামনে দেখল মায়ের নৃশংস মৃত্যু, তাঁর মনের অবস্থা কী হল? সেই কথা ভাবার সময় পাঠকের নেই, এমনকী কবিরও নেই, কারণ মহাকাব্যের বিরাট অরণ্যে মারীচের ঘটনা হারিয়ে গেছে, নতুন ঘটনার ঘনঘটা শুরু হয়েছে।

রামের বাণে আহত হয়ে সেই যে মারীচ পালিয়ে গেল, তারপর তাঁর আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না। কবি তাঁকে আবার স্মরণ করেছেন, যখন রাম এসেছেন বনবাসে। মারীচ তখন পূর্ণবয়স্ক এক রাক্ষস যে বনের মধ্যে মুনিদের যজ্ঞ পণ্ড করে আর মুনিদের হত্যা করে। সেখানে ঘটনাচক্রে আবার রাম আর প্রতিশোধকামী মারীচ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় আর যেই রাম ধনুকে বাণ যোজনা করলেন, সেই বালকবয়সের যুদ্ধের যন্ত্রণাবিদ্ধ স্মৃতি মারীচকে আবার আঘাত করল। প্রাণভয়ে পলায়ন করল মারীচ।

মারীচের কাহিনি এখানেই শেষ হয়ে যেত যদি না লঙ্কেশ্বর রাবণ সীতাহরণ করার জন্য মারীচের ছদ্মবেশ ধারণের অসাধারণ ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে তাঁর কাছে আসতেন। রাবণ যখন তাঁর কাছে গেলেন, তখন মারীচ সম্পূর্ণ অন্যরূপ। সে আশ্রম করে তপস্বীর জীবন যাপন করছে। রাবণের প্রস্তাবে প্রথমেই না করে দিল মারীচ। রামের বীরত্ব সম্পর্কে সচেতন করে দিল রাবণকে। কিন্তু উগ্রতেজা রাবণ রীতিমতো আদেশ দিলেন স্বর্ণমৃগের ছদ্মবেশ ধরার। এই কাজ করতে পারলে মারীচ পাবে অর্ধেক লঙ্কারাজ্য আর না পারলে রাবণের হাতে নিশ্চিত মৃত্যু। এই এক সময় অদ্ভুত টানাপড়েনে হয়তো ভুগেছিল মারীচ। আশ্চর্যের বিষয়, রাবণ যখন মারীচের কাছে এই প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন তখন রামের ভূয়সী প্রশংসা করেছিল মারীচ- "রামো বিগ্রহবান্‌ ধর্মঃ সাধুঃ সত্যপরাক্রমঃ"। রাম সাধুপুরুষ, রাম বীর। সেই রামের বিরুদ্ধে এই কাজ করলে মারীচের মৃত্যু নিশ্চিত। আবার না করলে রাবণের হাতেও মৃত্যু নিশ্চিত। মৃত্যুই যেন একমাত্র অমোঘ মারীচের কাছে।

আরও পড়ুন- স্বামীশ্রেষ্ঠ, পুরুষোত্তম নন, রামায়ণে রামকে আসলে যেভাবে এঁকেছেন মহিলারা…

কিন্তু আমরা রামায়ণের পাঠকেরা জানি, মারীচ রামের বিরুদ্ধেই গিয়েছিল। মহামতি লক্ষ্মণ তাঁর স্বরূপ কিছুটা বুঝতে পারলেও অবতারপুরুষ রামচন্দ্র বুঝতে পারেননি সোনার হরিণরূপী মারীচের স্বরূপ। আসলে মারীচের তৎকালীন মনোভাব হয়তো ছিল আত্মঘাতী। ছোটবেলা থেকে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে মারীচের বাস। পিতার অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু, চোখের সামনে মাতার মৃত্যু কি কোনও সন্তানকে স্বাভাবিক রাখতে পারে? সে তো প্রতিশোধকামী তথা রাক্ষসমনোভাবাপন্ন হবেই। আসলে রাক্ষস তো একটা মানসিক অবস্থা বা স্বভাব মাত্র, আমাদের চারপাশে আজও তো কত নররূপী রাক্ষস বাস করে।

তবে একটা কথা বিচার্য, রামের এত প্রশংসা করেও সেই রামের জীবনে এত বড় সর্বনাশ মারীচ ডেকে এনেছিল কেন? মৃত্যু তো তাঁর রাবণের হাতেও হতে পারত! এখানেই হয়তো সেই আত্মঘাতী মানসিকতা! হয়তো জীবন-মরণের এই সন্ধিক্ষণে এসে মারীচের মনে পড়েছিল মা তাড়কার কথা, শেষ বারের মতো, নিজেকে শেষ করেও প্রতিশোধ নেওয়ার কথা। যতই তাড়কা সমাজের চোখে, রামের চোখে বিকটদর্শনা রাক্ষসী হোক না কেন, মারীচের কাছে সে মা! যে মারীচ রামের প্রতি ভীতিতে বিপর্যস্ত হয়ে স্বপ্নেও রামের মুখ দেখে ভয় পেত, সেই এমন অকুতোভয় হয়ে শেষ মুহূর্তে হয়তো মাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিল। তার পরের ঘটনাবলী তো সর্বজনবিদিত। এই প্রতিশোধেই মারীচ বিজয়ী, রামও নয়, রাবণও নয়।

তথ্যঋণ-

১) বাল্মীকির রামায়ণে নেই- রাজা ভট্টাচার্য

২) শাশ্বতী রামায়ণী- ডঃ অমৃতা ঘোষ

 

More Articles