জ্বলছে মণিপুর, মরছে মানুষ! আর সিনেমাহলে দেখানো হচ্ছে 'উড়ি; দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক'?

Manipur Hindi Movie Uri: শেষ ১৯৯৮ সালে "কুছ কুছ হোতা হ্যায়" দেখানো হয়েছিল মণিপুরে।

নাটকে লোকশিক্ষা হতো। সে জমানা গত হয়েছে, এখন সিনেমায় জনগণের শিক্ষা হয়। শিক্ষাকে 'সবক' বলে ডাকলেও ভুল হবে না। বিভিন্ন ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা প্রচারের নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার এখন হিন্দি সিনেমা। 'জাতীয়তাবাদ' প্রচার, পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়ার মাহাত্ম্য প্রচার, দেশনেতার গুণাগুণ, অন্য রাজ্যের সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করে ফায়দা লোটা, রামরাজ্য গড়া- সবেতেই বেশ কিছুকাল ধরে হিন্দি সিনেমাকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে কেন্দ্রের শাসক দল। দেশের স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন শান্তি ফিরছে মণিপুরে। কীভাবে ফিরছে? ভিকি কৌশলের হাত ধরে! জলন্ত মণিপুরে, অশান্ত মণিপুরে হিংসা থামানোর স্থায়ী কোনও ব্যবস্থা চোখে না পড়লেও সেখানে দেখানো হচ্ছে উড়ি- দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক সিনেমাটি! মণিপুরকে স্বাধীনতা দিবসে দেশের উপহার? এখানেই রয়েছে হালকা ট্যুইস্ট!

২০ বছরেরও বেশি সময় পর কোনও হিন্দি সিনেমা এল মণিপুরে। জাতিসংঘর্ষ বিধ্বস্ত মণিপুরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের উপর নির্মিত বলিউডি সিনেমা প্রদর্শিত হলো চুরাচাঁদপুরের একটি অস্থায়ী ওপেন-এয়ার থিয়েটারে। ভিকি কৌশল অভিনীত উড়ি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক দেখতে মানুষও কম যাননি! এই ভয়াবহ সময়ে মানুষ নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে সিনেমা দেখবেন, বা সিনেমা দিয়ে কেন্দ্র যে আসলে এসব হিংসা দমনে কতখানি তৎপর তা প্রমাণ করা হবে, এমন ভাবলেনই বা কারা? উত্তর জানলে অবাক হতে হয়!

হামার স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (এইচএসএ) এই সিনেমার স্ক্রিনিংয়ের আয়োজন করে। শেষ ১৯৯৮ সালে "কুছ কুছ হোতা হ্যায়" দেখানো হয়েছিল মণিপুরে। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে নিষিদ্ধ পিপলস লিবারেশন আর্মির রাজনৈতিক শাখা দ্য রেভল্যুশনারি পিপলস ফ্রন্ট হিন্দি চলচ্চিত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ২০১৬ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের উড়িতে একটি সেনা ক্যাম্পে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী পরিচালিত 'সার্জিক্যাল স্ট্রাইক'-এর উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল উড়ি। মেইতেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর এই নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করতেই অস্থির মণিপুর রাজ্যে এই অবস্থাতেও উড়ি সিনেমা দেখানো হলো!

আদিবাসী উপজাতি নেতাদের ফোরামের মুখপাত্র গিঞ্জা ভুয়ালজং জানাচ্ছেন, তাদের শহরে শেষ হিন্দি সিনেমা দেখানো হয়েছে দুই দশকেরও বেশি আগে। মেইতিরা দীর্ঘদিন ধরে হিন্দি সিনেমাকে নিষিদ্ধ করেছে। ২০০০ সালে নিষেধাজ্ঞা জারির এক সপ্তাহের মধ্যে, রাজ্যের ভাষা ও সংস্কৃতিতে বলিউডের নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করেই নাকি বিদ্রোহীরা রাজ্যের বিভিন্ন সিনেমা হলে হিন্দি সিনেমার প্রায় ৬০০০ থেকে ৮০০০ ভিডিও এবং অডিও ক্যাসেট এবং কমপ্যাক্ট ডিস্ক পুড়িয়ে দেয়। মেইতি গোষ্ঠীগুলির দেশবিরোধী নীতিগুলিকে অস্বীকার করা এবং ভারতের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করতেই নাকি উড়ি সিনেমা দেখানোর সিদ্ধান্ত! সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, এই সংগঠনটি নিজেদের কুকি উপজাতিদের কণ্ঠস্বর মনে করে। সিনেমা দেখানোর আগে, রাজধানী শহর থেকে ৬৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ওপেন-এয়ার থিয়েটারে জাতীয় সঙ্গীতও বাজানো হয়।

মণিপুরে গত ৩ মে থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতি এবং উপজাতি কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক জাতিগত সংঘর্ষ চলছে। এ পর্যন্ত সরকারি হিসেবে ১৬০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। কম করে ৬০,০০০ মানুষ ঘরছাড়া!

ছাত্র সংগঠনটি একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, "এটি মেইতেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং মেইতিপন্থী মণিপুর রাজ্য সরকারের প্রতি আমাদের অনাস্থা এবং বিরোধিতা দেখানোর জন্যই আয়োজিত। কয়েক দশক ধরে আদিবাসীদের পরাধীন করে রেখেছে মেইতেইরা।" মণিপুরের জঙ্গি গোষ্ঠী, বেশিরভাগই মেইতেই, স্বাধীনতা দিবস বয়কটের ডাক দেয়। মেইতেই অধ্যুষিত ইম্ফল উপত্যকার বেশিরভাগ অংশই বন্ধ ছিল এবং সকলে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনও করেননি। কুকি-অধ্যুষিত পাহাড়ে কিন্তু অনেকেই মেইতেই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির ডাকা বয়কটের বিরোধিতা করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। আদিবাসী সংগঠন বলছে, দেশবিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলি থেকে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে এবং কুকি-জোমি-হামার-মিজো আদিবাসীদের উপর নজরদারি চালানো মেইতেইপন্থী মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের বিরোধিতা করতেই সিনেমা দেখানোর বন্দোবস্ত।

মেইতেইদের প্রতি কেন্দ্র সরকার 'নরম' বলেই বীরেন সিংয়ের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বা মণিপুরের এই হিংসাও থামানোর চেষ্টা হচ্ছে না- এই অভিযোগের ঠিক উল্টোপ্রান্তে গিয়ে আদিবাসীরাই যে আসলে দেশকে ভালোবাসেন তার প্রমাণ দিতে হচ্ছে? মেইতেইদের সন্ত্রাসের রূপ সামনে আনতেই কি আদিবাসীদের এই জাতীয়তাবাদের ভাবের ঘরে 'সার্জিক্যাল স্ট্রাইক'? নাহলে, যে পাহাড়ি কুকি-মিজো-নাগা গোষ্ঠীদের সঙ্গে উপত্যকার মেইতেইদের মূল জাতিগত সমস্যা, সেখানে নিজেদের সত্ত্বা বাঁচাতে হিন্দি সিনেমাকেই, তাও 'দেশাত্মবোধক' সিনেমাকেই কেন বেছে নিতে হচ্ছে? মণিপুর যে দেশেরই অংশ, তা প্রমাণ করতে হচ্ছে আদিবাসীদের! বিচ্ছিন্নতা বা সন্ত্রাস নয়, আসলে সীমান্তের আদিবাসীরাও দেশের 'সঙ্গে'ই আছে- এই প্রমাণ করেই যদি জাতীয়তাবাদের গীত চরমে গাইতে হয়- প্রশ্ন তো উঠবেই। না কি, এও আসলে সরকারেরই এক নীতি, মণিপুরের আদিবাসীদের মধ্যে গেরুয়া শিকড় ছড়াতেই কি উড়িকে হাতিয়ার করতে হচ্ছে? উত্তর আশা করা যায় ২০২৪-এর আগে মিলবেই!

 

More Articles