একে একে নিভিছে দেউটি, এবার বন্ধ হল কলকাতার প্রথম মোমো ঠেক 'টিবেটিয়ান ডিলাইট'

Tibetan Delight Shuts Down: এ সকলই ছিল। কারণ 'টিবেটিয়ান ডিলাইট' আর নেই। বাঙালির স্বাদের তিব্বতি স্বর্গে তালা পড়ে গিয়েছে বৃহস্পতিবার।

তখনও মোবাইলের বোতাম টিপলেই খাবার এসে হাজির হত না বাড়ির দরজায়। তখনও শহরের আনাচে কানাচে গড়ে ওঠেনি 'ওয়াও মোমো' বা 'মোমো আই অ্যাম'-এর বেসাতি। সেসময় কলেজ পড়ুয়া থেকে ভোজনবিলাসীদের কাছে তিব্বতি খাবারের ওয়ান স্টপ সলিউশন ছিল 'টিবেটিয়ান ডিলাইট'।  কার্যত কলকাতার সঙ্গে সেদিন মোমোর  পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সে-ই। ক্রমে মানুষ জানতে শুরু করল মোমো আর থুকপা ছাড়াও শত সহস্র সুস্বাদু তিব্বতি খাবারের অস্তিত্ব পৃথিবীতে আছে। আর এই সত্যের মালুম বেশ পাওয়া যেত চৌরঙ্গির এই একফালি আস্তানায় ঢুকলেই।

চারদিকে সোনা-রূপো গহনার দোকান। যেদিকেই চোখ রাখবেন, দেখবেন লক্ষ্মীবাবুর সোনার দোকান। আসল লক্ষ্মী কোন জন ঠাহর করা কঠিন! কিন্তু কলকাতার আসল তিব্বতি খাবারের ঠিকানার খোঁজ কিন্তু ঠিক ততটা কঠিন ছিল না। সরু অন্ধকার একফালি গলি, সেই গলি ধরে হাঁটতে শুরু করলেই মিলত সেই খানা খাজানা। পুরনো কলকাতার ঐতিহ্যবাহী তিব্বতি খাবারের সেরা ঠিকানা টিবেটিয়ান ডিলাইট। অন্ধকার ঘর, একটা দু'টো চিনে লণ্ঠের মিনিমালাইজ সাজসজ্জা। দু'টো-তিনটে চেয়ার। কিন্তু রবিগানের মতো 'টিবেটিয়ান ডিলাইট'-ও 'রূপে তোমায়' ভোলাতো না। চিনে খাবার, কিন্তু গড়পরতা মোমোর স্বাদের থেকে এ ছিল যেন আকাশ-পাতাল আলাদা।

আরও পড়ুন: ৬০০ বছরের ঐতিহাসিক পাহাড়ি খাবার! মোমো কীভাবে ভারতে এল জানলে চমকে যাবেন…

এ সকলই ছিল। কারণ 'টিবেটিয়ান ডিলাইট' আর নেই। ৬৬/১, চৌরঙ্গী রোডের বাঙালির সেই সাধের তিব্বতি স্বর্গে তালা পড়ে গিয়েছে বৃহস্পতিবার। পুরনো কলকাতার সমস্ত চিহ্ন যেন একে একে খসে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেই শোনা গেল, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কলকাতার পুরনো নিলামখানা। এবার পালা 'টিবেটিয়ান ডিলাইট'-এর। রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রন বোর্ডের চিঠি এসেছে। এবার চিরতরে ঝাঁপ পড়ার পালা। একে একে কেটে দেওয়া হয়েছে রেস্তরাঁর বিদ্যুৎ ও জলসংযোগ। একাধিক বার চিঠি দিয়ে রেস্তরাঁর চিমনির উচ্চতা কাছের উঁচু বহুতলগুলি থেকে বাড়াতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সে কাজে ব্যর্থ হয় 'টিবেটিয়ান ডিলাইটস' কর্তৃপক্ষ।

A popular Tibetan eatery in Kolkata, known as Tibetan Delight, has been forced to shut down due to non-compliance with pollution regulations

২৭ জানুয়ারিই রেস্তরাঁ বন্ধের নির্দেশ এসেছিল। কাছাকাছি বহুতলগুলির থেকে অন্তত ৩.৫ মিটার বাড়াতে হবে চিমনির উচ্চতা। আকাশ ছোঁয়া কি আর মুখের কথা! অগত্যা ঝাঁপ পড়ল ঐতিহ্যশালী তিব্বতি খাবারের চিরন্তন আস্তানায়। কীভাবে যেন ইতিহাসের পাতায় চলে গেল কলকাতা শহরের একটা আস্ত নস্টালজিয়া। এ অবশ্য প্রথম বার নয়। এর আগেও দু'বার ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল ও দূষণ নিয়ন্ত্রন বোর্ডের লাল চোখে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রেস্তরাঁ। আড়াই বছর আগে একবার, আর একবার মাস ছয়েক আগে। তার পরেও কলকাতাবাসীর কথা ভেবে ফের খুলেছে তিব্বতি খাবারের ঠেক।

১৯৮১ সালে জন্ম 'টিবেটিয়ান ডিলাইট'-এর। জিৎবাদল মুখিয়া এবং তাঁর পুত্র উদয় মুখিয়ার হাত ধরে শুরু হল ব্যবসা। উদয়ের প্রপিতামহ দার্জিলিং-এর মানুষ। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম-র জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা এই শহরেই। এখন দোকানের দায়ভার জিৎবাদলের পুত্রবধূ নিমা মুখিয়ার হাতেই। নাতনি, অমৃতাও দেখেন মাঝে মাঝে। নিমা সমস্ত অভিযোগই মেনেছেন। কিন্তু তেমন কিছু করতে পারেননি এ নিয়ে। সিভিক বডির লাইসেন্স তাদের কাছে ছিল। কিন্তু রেস্তরাঁ চালাতে গেলে যে পরিবেশ দূষণ বোর্ডের অনুমতি ও ফায়ার লাইসেন্স লাগে, তা জানতেনই না বৃদ্ধ নিমা। আশপাশের অধিকাংশ রেস্তরাঁরই তো সেইসব লাইসেন্স নেই। তার জন্য ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও দিয়েছিল রেস্তরাঁ কর্তৃপক্ষ। এমনকী এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বা ইটিপি-চিমনিও বসায় তারা। এমনকী চিমনির দৈর্ঘ্য বাড়ানোর চেষ্টাও যে একেবারে করেননি তা নয়, কিন্তু তার জন্য তো বিদ্যুৎ লাগে ওয়েল্ডিংয়ের জন্য। সেটা যে অনেকদিন ধরেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তাদের রেস্তরাঁয়।

এর পিছনে ওই জায়গাটির মালিক অর্থাৎ বাড়িওয়ালা এবং প্রোমোটারদের হাত রয়েছে বলেই অভিযোগ করেছেন নিমারা। বারবার তাদের বিরুদ্ধে নালিশ ঠুকে ঠুকে রেস্তরাঁ বন্ধের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। অন্য কিছু নয়, এত বছর ধরে ক্রেতাদের মন ভরিয়েই টিকে থেকেছে 'টিবেটিয়ান ডিলাইট'। তবে গত দিন কয়েকে অসংখ্য অতিথি তাঁদের রেস্তরাঁয় এসে ফিরে গিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে, কোনও ভাবে চিমনির উচ্চতা বাড়িয়ে ফের পারিবারিক এই ব্যবসাকে চালু করতে চান বলেই জানিয়েছেন নিমার পুত্রবধূ রিকি।

আরও পড়ুন: মন তার মরে গেছে কবেই

সুস্বাদু রোস্ট চিলি পর্ক, বা দুর্দান্ত সেই চিকেন কোথে বা স্বর্গীয় সেই মোমোর স্বাদ কি আর কলকাতার মানুষ পাবেন? আকাল কাটিয়ে ফিরতে পারবে প্রিয় 'টিবেটিয়ান ডিলাইট'? আপাতত সেই প্রত্যাশাই বোধহয় প্রার্থনার মতো ফিরছে কলকাতার খাদ্যপ্রিয় সমস্ত বাসিন্দার ঠোঁটে ঠোঁটে। ইতিহাসের পাতা থেকে ফের 'জিয়া নস্টাল' করতে ফিরে আসুক তিব্বতি খাবারের জনপ্রিয় এই ঠেক।

More Articles