সরকারি বিজ্ঞাপনে বাংলা ভাষার দফারফা! বিজ্ঞাপন লিখিয়েদের কী কী শিখতেই হবে...

Bengali Mistakes in Govt Ads: রূপচাঁদ বলল, ‘এ-জন্যই লাল দাগ দিয়েছি। আর হর ঘর তিরঙ্গা এটা বাংলা ভাষায় খুব কানে লাগছে। কী করা যায় বল তো?’

রূপচাঁদকে বাংলা বানান শিখিয়ে যে কিছু ভুল করিনি তা টের পেলাম স্বাধীনতা দিবসের দিন। সকালে তার দেখা পাইনি। এমনিতে ছুটির দিন। তার স্কুলে জাতীয় পতাকা তোলা হয়েছে। তারপর সে মুক্ত। এই মুক্তির আনন্দ সে খেলার মাঠে উপভোগ করতে চেয়েছিল। সারা সকাল বল পিটিয়ে চমৎকার অপরাজিত নিরানব্বই করে বাড়ি ফিরল। এক রানের জন্য সেঞ্চুরি হয়নি। তার আগেই জিতে গেছে। রূপচাঁদ দুপুরে সোজা আমার ঘরে।

উত্তেজিত ভঙ্গিতে একটি বাংলা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে রূপচাঁদ বলছে, “ভুল ভুল। হাজার হাজার ভুল। আমাদের বাংলা ভাষায় স্বাধীনতার বার্তা প্রকাশের সময় এই সব ভুল শুধরে দেওয়া উচিত।” রূপচাঁদের এই কথা শুনে আমি অবাক – যাকে বলে হতবাক, একেবারে বাক্যিহারা। বললাম, “রূপচাঁদ। এ তো তোমার স্বাভাবিক বাংলা নয়। সাজানো-গোছানো সংলাপ।” রূপচাঁদ ফিক করে হেসে বলল, “তোমার বাংলা নকল করছিলাম। তবে যে কথাটা বলতে চাইছি সেটা একশো ভাগ সত্যি। তুমিই তো বলেছ এ দেশে অনেক ভাষা। প্রতিটি ভাষা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের সরকার প্রতিটি ভাষাকে সমান গুরুত্ব দেবে। তাহলে হঠাৎ বাংলা ভাষায় লেখা স্বাধীনতা দিবসের সরকারি বার্তায় এমন নানারকমের ভুল থাকবে কেন? এ কি দেশের একটি ভাষার প্রতি গভীর অমনোযোগের প্রকাশ নয়!”

মনে মনে বুঝতে পারলাম রূপচাঁদ সত্যি পরিণত হচ্ছে। স্কুল ছেড়ে কলেজে পড়বে যখন, যখন ভোট দেওয়ার অধিকার পাবে, তখন তার এই সব ভাবনা ব্যালট-বাক্সে প্রতিফলিত হবে বলেই মনে হয়। রূপচাঁদ ততক্ষণে খবরের কাগজের সরকারি বিজ্ঞাপনের পাতা খুলে ফেলেছে। যে বানান ও প্রয়োগ তার ভুল কিম্বা বাংলা ভাষায় বেমানান বলে মনে হয়েছে তার তলায় মোটা করে দাগ দেওয়া।

হিন্দি কিম্বা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনূদিত বিজ্ঞাপনের প্রথম বাক্য ‘আমাদের ৭৭তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে উত্তোলণ করুন হর ঘর তিরঙ্গা’।

রূপচাঁদের মোটা করে দাগ দেওয়ার ফলে তার চেহারা হয়েছে, ‘আমাদের ৭৭তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে উত্তোলণ করুন হর ঘর তিরঙ্গা

রূপচাঁদ বলল, ‘উত্তোলণ বানানের কী ছিরি! উত্তরণ কিন্তু উত্তোলন। তাই তো?’

আমি বললাম, ‘ঠিক বলেছ। তবে কেন তা ব্যাখ্যা করতে পারবে কি?’

রূপচাঁদ বলল, ‘না-পারার কিছু নেই। উত্তরণ ণত্ব বিধানের নিয়ম মেনে ণ, কারণ আগে র আছে। উত্তোলন বানানে ণ হবে না, কারণ আগে ঋ, র, ষ নেই।’

আমি হাততালি দিয়ে উঠলাম। বললাম, ‘একশোয় একশো। তবে আর কয়েকটা কথা বলি। উত্তোলন নিখাদ সংস্কৃত শব্দ। নিত্য ণত্বের উদাহরণ নয়। উদ্‌ হচ্ছে উপসর্গ। তারপর তোলি ধাতুর সঙ্গে অন প্রত্যয় যোগ হয়েছে। সুতরাং উত্তোলণ এই বানান একেবারেই ভুল। জাতীয় পতাকা মাথা উঁচু করতে পারে, হাওয়ায় উড়তে পারে কিন্তু বানানে মাথা তোলা ণ লেখা চলবে না।’

রূপচাঁদ বলল, ‘এ-জন্যই লাল দাগ দিয়েছি। আর হর ঘর তিরঙ্গা এটা বাংলা ভাষায় খুব কানে লাগছে। কী করা যায় বল তো?’

বললাম, ‘ঘরে ঘরে তেরঙা করা যেতে পারে। বাংলা ভাষায় হর-কে উপসর্গ বা পূর্বপদ হিসেবে আমরা ব্যবহার করি। যেমন হরদম, হররোজ, হরঘড়ি, হরতাল। হর ফারসি থেকে এসেছে। এটি কিন্তু সংস্কৃত হর নয়। সংস্কৃত হর থেকে চেনা শব্দ হরণ। সংস্কৃত আর ফারসি রূপ দুটি দেখতে এক, উৎস আলাদা। এই ফারসি থেকে আসা হর-এর অর্থ প্রত্যেক। হরতাল শব্দের তাল এসেছে গুজরাতি তালু থেকে, তালু অর্থ কুলুপ বা তালা। প্রতিটি দোকানে তালা, বেচা-কেনা বন্ধ। তাই হরতাল। কিন্তু হর ঘর শুনতে খারাপ লাগছে – বাংলা ভাষার সঙ্গে ঠিক খাপ খাচ্ছে না। প্রতিটি ঘরে প্রত্যেক ঘরে বোঝাতে তাই ঘরে ঘরে ব্যবহার করা চলে।’

আরও পড়ুন- বিজ্ঞাপন লিখিয়েদের জন্য : জনস্বার্থে প্রচারিত

রূপচাঁদ আমার দিকে পরের বাক্যাংশ এগিয়ে দিয়েছে। সেখানে লেখা বাক্যটি একেবারেই স্বাভাবিক বাংলা নয়। লেখা হয়েছে:

আজ, আমি দেশের সকল নাগরিকগণের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, বিশেষত যুবসম্প্রদায়কে, যোগদান করার জন্য এবং ‘হর ঘর তিরঙ্গা’ র ভাবণাকে প্রচার করার নিমিত্ত

লালে লাল করে দেওয়া বাক্যটি দেখে একই সঙ্গে বিরক্ত ও খুশি হলাম। বিরক্ত হলাম বাক্যটি ঠিক মতো বাংলা বাক্য হয়নি বলে। আর খুশি হলাম রূপচাঁদ তা বুঝতে পেরেছে বলে।

রূপচাঁদ বলল, ‘ভাবণা ভুল। ণ অকারণ। ভাবনা হবে। কান্না, ভাবনা, রান্না। আচ্ছা ভাবনা শব্দটি ভাঙলে কী হবে?’

বললাম, ‘ভাবনা শব্দের মূলে আছে ভাবন, তার অর্থ চিন্তা বা ধ্যান। বাংলা ভাষায় কিন্তু ভাবন শব্দে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, ভয় বোঝান হয়। পুরনো বাংলা কবিতায় পাবে অকারণ নরপতি করহ ভাবন। এই ভাবন থেকেই ভাবনা – স্ত্রীলিঙ্গের রূপ। গীতায় আছে ন চাযুক্তস্য ভাবনা। এখানে ভাবনা শব্দটিকে শুধু ভুল বানানেই লেখা হয়নি, বাংলা ভাষায় ভাবনা শব্দের যে প্রচলিত প্রয়োগ তাকেও খানিকটা বিচলিত করা হয়েছে। তবে দেশভাবনা, কর্মভাবনা, ধর্মভাবনা এ-জাতীয় সমাসবদ্ধ পদ আমরা বাংলায় ব্যবহার করি। তবে শুধু ভাবনাকে সংস্কৃত শব্দের অর্থে সচরাচর ব্যবহার করি না। তবে করা যেতেও পারে, করলে চলবে কি না তা নিয়ে অবশ্য ভাবনা-চিন্তা করা দরকার। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের দু’টি গানের কথা এই সূত্রে মনে পড়ছে। গান দু’টিকে আমি বলি জোড়া গান – একটার সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কিত। একটি খুবই চেনা। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।’ এ গানটা শুনলেই মহাত্মা গান্ধীর কথা মনে পড়ে। পরম সাহসে একা চলেছেন। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা আটকাতে পথে নেমেছেন। নির্ভীক মানুষটিকে দাঙ্গাবাজেরা হত্যা করেছিল, গুলি করে। রবীন্দ্রনাথ এই গানটির দোসর হিসেবে আরেকটি গান লিখেছিলেন। ‘যদি তোর ভাবনা থাকে ফিরে যা-না। তবে তুই ফিরে যা-না।’ এখানে এই গানে ভাবনা শব্দটি প্রচলিত বাংলা অর্থে ব্যবহৃত। ভাবনা মানে এখানে উদ্বেগ, ভয়, দুশ্চিন্তা। যদি স্বদেশের পথে একা চলতে ভয় করে তাহলে ফিরে যাওয়াই ভাল। স্বদেশের ব্রতে ভয় পেলে চলে না – বিপ্লবীদের মধ্যে যারা ভয় পেতেন তাঁদের নিয়ে নানা সমস্যা। কখনও তাঁরা সাহেবদের গোপনে খবর দিতেন, কখনও মুচলেকা দিয়ে নিজের স্বার্থ বজায় রাখতেন।

রূপচাঁদ বলল, ‘এই সব ভাবনার কথা, মনে থাকবে। রবীন্দ্রনাথের এ-গানটা শুনিনি। একদিন শুনিও তো।’

বললাম, ‘রবীন্দ্রনাথের এ-গান খুবই কম শিল্পী করেছেন। ইউটিউবে যে ক’জনের রেকর্ড পাবি তার মধ্যে অমিতেশ সরকারের গাওয়া গানটাই সবচেয়ে ভালো। এ-গান নিয়ে ওঁর নানা ভাবনা আছে। এখানে ভাবনার অর্থ কিন্তু উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা আছে। নানা ভাবনা মানে নানা চিন্তা, অভিমত। কাজেই মনে রাখতে হবে এ-শব্দটা এ-অর্থে চলবেই না এ-কথা নিশ্চিত করে আগে থেকে কিন্তু বলা যাবে না। একটা শব্দ ভাষায় নানা সময়ে নানা অর্থে গৃহীত ও বর্জিত হয়। ভাষা যে কখন কী নেয়, কী নেয় না তা একবাক্যে বলা কঠিন। তবে যা নিয়েছে, যেভাবে নিয়েছে তার দিকে তাকিয়ে ভাষার সচল ব্যাকরণের কথা ভাবতে পারা চাই। ভাষার বাঁক বদলায়, ব্যাকরণের নিয়মও সেই বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তনের স্বরূপ বুঝতে চেষ্টা করে। এ-জাতীয় ব্যাকরণকে বলে descriptive grammar।’

রূপচাঁদ শুনে খুশি হলো। সে মোটেই কপিবুক ক্রিকেট খেলে না, কাজেই আমার কথা শুনে তার খুশি হওয়ারই কথা। আমি সুযোগ পেয়ে আরও দু’কথা বলতে শুরু করলাম।

বললাম, “আগেই বলেছি হর ঘর তিরঙ্গা লেখা চলবে না। তাও যদি কেউ কথা না শুনে লেখে তাহলে ‘হর ঘর তিরঙ্গা’-র এভাবে লেখা উচিত। র-এর আগে হাইফেন দিলে ভালো। র এই বিভক্তি তো স্বাভাবিক ভাবে এখানে যোগ করা যাবে না, তাই হাইফেন। এখানে অবশ্য ‘র’ এই বিভক্তি না দিলেও চলে। সেখানে বাক্যটি হওয়া উচিত ‘হর ঘর তিরঙ্গা’ ভাবনা প্রচার করার জন্য। বিভক্তি বাংলায় খুবই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোন পদে কী বিভক্তি যোগ হবে কিম্বা বিভক্তি যোগ করার দরকার হবে না তা জানা চাই।”

হাতের কাছে একটা খাতা ছিল। রূপচাঁদের জন্য সেখানে একটা ছক কেটে ‘যা-ছাপা হয়েছে’ আর ‘যা-লিখলে বাংলা বলে মনে হবে’ তা স্পষ্ট করে লিখে দেখালাম।

যা-ছাপা হয়েছে যা-লিখলে বাংলা বলে মনে হবে
আজ, আমি দেশের সকল নাগরিকগণের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, বিশেষত যুবসম্প্রদায়কে, যোগদান করার জন্য এবং ‘হর ঘর তিরঙ্গা’ র ভাবণাকে প্রচার করার নিমিত্ত আমি আজ দেশের নাগরিকদের কাছে, বিশেষত যুবসম্প্রদায়ের কাছে, আবেদন করছি তাঁরা যেন ‘ঘরে ঘরে তেরঙা’ এই ভাবনা প্রচার করার কাজে যোগদান করেন।

আরও পড়ুন- ফেসবুকে বাংলা লেখেন? যে যে বানানগুলি ভুল করছেন রোজ…

বললাম, “আজকাল প্রযুক্তির কল্যাণে অনেকেই যন্ত্রে অনুবাদ করেন। কালে-দিনে যন্ত্রের করা অনুবাদ হয়তো ভালো হলেও হতে পারে। এখনও পর্যন্ত যন্ত্রের অনুবাদ খারাপ – যে ভাষায় অনুবাদ করতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে সে ভাষায় স্বাভাবিকভাবে অনুবাদ করতে যন্ত্র অক্ষম। সকল নাগরিকগণ ভুল। দু’বার বহুবচন করার দরকার নেই। সকল আবার গণ – একই সঙ্গে ব্যবহার করা যাবে না। বাংলা ভাষায় ‘সকল নাগরিক’ শুনতে খারাপ। ইংরেজি all people, all citizen বাংলায় কীভাবে অনুবাদ করলে শুনতে বেশ লাগবে? একটা বাক্য নেওয়া যাক। All people are nothing but tools. এখানে এমনিতে all এর বাংলা সকল, সব, সমস্ত। এই ইংরেজি বাক্যটির অনুবাদ হিসেবে নানা বাক্য লেখা যেতে পারে। তেমনই দুটো। প্রথম অনুবাদ, সমস্ত মানুষই যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। দ্বিতীয় অনুবাদ, মানুষেরা যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। All people-এর বাংলা ‘সমস্ত মানুষ’ কিম্বা ‘মানুষেরা’। বহুবচনের চিহ্ন হিসেবে আগে সমস্ত যোগ করতে হবে অথবা পরে বহুবচন বোধক বিভক্তি যোগ করা চাই। কানে কোনটা শুনতে বেশ, কোন পরিপ্রেক্ষিতে কোনটা ভাল যাবে তা বিচার করতে হবে।”

রূপচাঁদ বলল, “ভারতে এতগুলি ভাষা। সরকার প্রতিটি ভাষার জন্য কি সময় দেবে?”

বললাম, “দেওয়া তো উচিত। এই যে নতুন শিক্ষানীতি নিয়ে আজকাল সরকারের পক্ষে নানা কথা বলা হচ্ছে, তাতে তো প্রতিটি প্রদেশের ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়ার নীতি নেওয়া হয়েছে। যদি সত্যি তাই হয় তাহলে সরকারি বিজ্ঞাপন ও বার্তার অনুবাদে মন দিতে হবে। মন দেওয়া মানে যান্ত্রিকভাবে অনুবাদ নয়। মন দেওয়া মানে অনুবাদের সময় প্রতিটি ভাষার নিজস্বতাকে মনে রাখা। প্রয়োজনে অনুবাদের জন্য আলাদা দপ্তরের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাষা-বিভাগগুলিকে কাজে লাগান যেতে পারে। আমাদের দেশ মানে একভাষা কিন্তু নয়। একদেশ একভাষা একধর্ম এ-আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী। আমাদের দেশ মানে একদেশ নানাভাষা নানাধর্ম। ভাষার এই নানাত্ব সরকারের কাজে প্রতিফলিত হলে তবেই দেশ বাঁচবে।”
রূপচাঁদ কী বুঝল কে জানে? দেখি গান গাইছে, ‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান/ বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।’

রূপচাঁদের গান শুনে পরম উৎসাহে আমি খাতায় নানা রঙের কালিতে লিখলাম,

আমার কথা আমার ভাষায়
আমার ভাষা আমার মতো
আমার ভাষা স্বাধীন ভাষা
আমার বাংলা আমার মর্যাদা
আমার বাংলা আমার বাংলায়

More Articles