দশ বছরে দেশের বেকার, চাকরিপ্রার্থীদের কী দিলেন নরেন্দ্র মোদি?

Narendra Modi Unemployment:স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া ২০২৩-এর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পর্যাপ্ত বেতনের চাকরির অভাবের কারণেই মানুষ 'সেলফ-এমপ্লয়েড' হচ্ছেন।

২০১৪ সালে এদেশে ক্ষমতায় আসে ভারতীয় জনতা পার্টি, নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হন। ওই মসনদে ১০ টি বছর পার করে ফেললেন মোদি। আর জনতা? এই ১ দশকে সাধারণ মানুষ নরেন্দ্র মোদির থেকে কী কী পেল? ভারতীয় জনতা পার্টি মানে বিজেপি ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইস্তেহারে কর্মসংস্থান তৈরিকে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা ঢালাও করে প্রচার করে। বিজেপি বলেছিল, উত্পাদন, পরিকাঠামো এবং আবাসনকে ক্ষেত্র নিয়ে ব্যাপক উন্নতিসাধন করবে গেরুয়া দল। কীরকম উন্নতি হলো এই দশ বছরে?

ভারতে বেকারত্বের হার ২০১৭-১৮ সালে বেড়ে হয় ৬.১%, গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সরকারেরই পর্যায়ক্রমিক শ্রমশক্তি সমীক্ষায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন, ২০২০ সালের এপ্রিল-জুন মাসে দেশের বেকারত্ব আরও বেড়ে ২০.৮% হয়েছিল। ২০২২-২৩ সালে এই বেকারত্বের হার ৩.২% কমে। তবে, সরকারের তথ্যের বাইরে স্বাধীন সংস্থাগুলির মাসিক সমীক্ষায় কিন্তু ধারাবাহিকভাবে বেকারত্বের হার সরকারি পরিসংখ্যানের থেকে ঢের বেশি বাড়তে দেখা গেছে।

পর্যাপ্ত এবং সময়োপযোগী সরকারি তথ্যের অভাবের কারণেই অর্থনীতিবিদ এবং নীতি গবেষকরা CMIE তথ্যের উপর নির্ভর করেন। মোদি সরকার ২০১৭ সালে বার্ষিক কর্মসংস্থান-বেকারত্ব সমীক্ষা বাতিল করে দেয়। শুধু তাই নয়, ২০১৮ সালের মার্চ লেবার ব্যুরোর ত্রৈমাসিক সমীক্ষাও সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। অর্থনীতিবিদরাও বলছেন 'সেলফ-এমপ্লয়মেন্ট' বা স্ব-কর্মসংস্থানে নিযুক্ত কর্মশক্তির অংশ বৃদ্ধিকে সরকার যতই বড় করে দেখা, বিষয়টি চিন্তার। কীসের স্ব-কর্মসংস্থান? কী কাজ করছেন এই মানুষরা? কত টাকা পাচ্ছেন? কতটা শ্রমের বদলে টাকা পাচ্ছেন? কতটা নিশ্চিত তাঁদের কাজ? তারা তাঁদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাচ্ছেন তো?

আরও পড়ুন- গোমাংস রপ্তানিকারকদের থেকেও ইলেক্টোরাল বন্ডে কোটি কোটি টাকা! কে নিল?

ভারতের কর্মশক্তিতে স্ব-নিযুক্ত ব্যক্তিদের অংশ ২০১৩-১৪ সালে কংগ্রেসের আমলে ছিল ৪৯.৫%। সেখান থেকে তা বেড়ে ২০২২-২৩ সালে বিজেপির আমলে ৫৭.৩% হয়েছে৷ এই একই সময়ে, বেতনভোগী কর্মীদের অংশ ২৩.১% থেকে কমে হয়েছে ২০.৯%।

স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া ২০২৩-এর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পর্যাপ্ত বেতনের চাকরির অভাবের কারণেই মানুষ 'সেলফ-এমপ্লয়েড' হচ্ছেন। অর্থনৈতিক দুরবস্থাই বহু চাকরিপ্রার্থী ভারতীয়কে স্ব-কর্মসংস্থানে বাধ্য করেছে।

মোদি সরকার ২০১৪ সালে 'মেক ইন ইন্ডিয়া' এবং ২০২০ সালে 'আত্মনির্ভর ভারত' শুরু করে দেশজ উত্পাদনকে উত্সাহিত করার জন্য। ২০১৪ এবং ২০১৯- এই দুই বছরের নির্বাচনী ইস্তেহারেই বিজেপি বলেছিল উৎপাদন ক্ষেত্রে ব্যাপক কাজের সুযোগ রয়েছে। দেশে উৎপাদন বাড়াতেই মেক ইন ইন্ডিয়ার মতো উদ্যোগ। তাহলে তো এই ক্ষেত্রে প্রচুর কর্মসংস্থান হওয়ার কথা? উত্পাদন খাতে চাকরি ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে অর্ধেকে গিয়ে ঠেকেছে। অনেকেই বলবেন এই সময় তো কোভিড মহামারী চলেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কোভিড-১৯ আসার আগেও এই খাতে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছিল।

২০১৮ সালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে, ভারতে বেশিরভাগ উত্পাদন ক্ষেত্রের চাকরিই কম বেতনের এবং যোগ্যতার চেয়ে অনেক কম মানের।

পরিকাঠামো খাতে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সম্ভাবনার কথা, ২০১৪ সালের ইস্তেহারে বিজেপি উল্লেখ করেছিল। এই ক্ষেত্রে তাহলে কত মানুষ কাজ পেলেন? ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-১২ সালে পরিকাঠামো, আবাসন নির্মাণে নিযুক্ত ভারতের কর্মীবাহিনীর অংশ ছিল ১০.৬%৷ সর্বশেষ পর্যায়ক্রমিক শ্রম শক্তি সমীক্ষা অনুসারে এটি ২০২২-২৩ সালে ১৩% হয়েছে।

বর্তমানে সাত কোটিরও বেশি ভারতীয় নির্মাণ খাতে কাজ করেন এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যে ৩ শতাংশ শ্রমশক্তি বেড়েছে, অর্থাৎ নির্মাণ খাতে নিযুক্ত লোকের সংখ্যা বাড়ছে মানেই দিনে দিনে আরও বেশি মানুষ বাধ্য হচ্ছেন নিম্নমানের চাকরি করতে। নিম্নমান অর্থাৎ রোজগার কম, যোগ্যতার তুলনায় মান কম। শ্রম সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, নির্মাণ খাতের শ্রমশক্তির ৮৩% এর বেশি মানুষই দিনমজুর এবং ১১% মানুষ স্ব-নিযুক্ত।

২০১৪ সালের বিজেপির ইস্তেহারে 'কৃষি ও সংশ্লিষ্ট খাতের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির' কথা বলা হয়। কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন শহর থেকে গ্রামীণ এলাকায় বিপরীত অভিবাসনের কারণে কৃষিতে কর্মসংস্থান বেড়েছে।

আরও পড়ুন- ১% ধনীর হাতেই কুক্ষিগত ভারতের সমস্ত সম্পদ! যে ভয়াবহ অসাম্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ

কৃষিতে ভারতের কর্মশক্তির অংশর এই বৃদ্ধি কিন্তু অর্থনীতিবিদদের মতে একটি খারাপ লক্ষণ। ২০০৪-০৫ থেকে ২০১১-১২ সালের মধ্যে, যখন কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল, তখন কৃষিতে শ্রমশক্তির অংশ ৫৮.৫% থেকে হ্রাস পেয়ে হয় ৪৮.৯%। ২০১৮-১৯ সালে কৃষিতে শ্রমশক্তির হার ছিল ৪২.৫%, তারপর থেকে কৃষিতে কর্মসংস্থান বেড়ে ২০২১-২২ সালে হয়েছে ৪৫.৫%।

জিনিসের দাম বেড়েছে পাল্লা দিয়ে কিন্তু বেতন বেড়েছে কি? ২০১৪-১৫ এবং ২০২১-২২ সালের মধ্যে ভারতের শ্রমশক্তির মজুরি কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাড়েনি, বেড়েছে মাত্র ১%-এরও কম। বিজেপির ইস্তেহারে যে দু'টি ক্ষেত্রের কর্মসংস্থান বাড়ার কথা বলা হয়েছিল, সেই দুই খাত অর্থাৎ কৃষি এবং নির্মাণে মজুরি বেড়েছে মাত্র ০.৯% এবং ০.২%।

২০২০ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় ২০০৪-০৫ থেকে ২০১১-১২ আর ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮ সময়কালের মধ্যে আয় বৃদ্ধির তুলনা করা হয়েছে। দেখা গেছে ২০০৪-০৫ এর তুলনায় মজুরি বৃদ্ধি মারাত্মক কমে গেছে। বৃদ্ধি তো দূর অস্ত কিছু কিছু ক্ষেত্রে আগের থেকেও কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ। ২০২২-২৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় কেন্দ্র সরকারও স্বীকার করে যে গ্রামীণ এলাকায় এই সময়কালে মজুরির পরিমাণ আগের থেকেও কমেছে।

More Articles