কলকাতার কেবিনে আজও কান পাতলে শোনা যাবে বিপ্লবীদের নিঃশ্বাস

খিদের তাড়নায় মানুষের আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছে ভারতবর্ষ। কিন্তু খাবাবের দোকানের সঙ্গে আন্দোলনের সম্পর্ক খানিক অদ্ভুত ঠেকতে পারে পাঠকদের কাছে। তাও আবার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন। ভারতে ব্রিটিশ রাজত্বের প্রায় অর্ধেক সময় কলকাতা রাজধানী থাকার সুবাদে আজও শহরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে রয়েছে ইংরেজ শাসনের প্রমাণ। তেমনই শহরের হৃদয়ে খোদাই করা আছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত বহু বিপ্লবীর নাম, তাদের অবদান। ১৯ বছরের তরুণ ক্ষুদিরাম থেকে সুভাষচন্দ্র- প্রাণের পরোয়া না করেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে। আন্দোলনের রূপরেখা নির্ধারণ ও দলের কাজ করতে গিয়ে ধরাও পড়েছেন পেয়াদাদের হাতে এসব কথা সকলেরই জানা।   

পুলিশের চোখ এড়াতেই তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন এমন জায়গা যেখানে সহজেই সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যাওয়া যায় বা খানিক নিরালায় কথা বলা যায় দু'দন্ড।এমন জায়গার নাম বলতেই শহরের একাধিক কেবিনের কথা উঠে আসবে । এমনকী নকশাল আন্দোলনের সাথে জড়িত নেতারাও গোপন সাক্ষাৎকারের জন্য বেছে নিয়েছিলেন এইসব কেবিনগুলিকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অলোক কুমারের মতে, ‘সেইসময় কেবিনগুলি স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। একান্তে কথা বলার সুবিধা থাকার জন্যই এই জায়গাগুলিকে বিপ্লবীরা বেছে নিয়েছিলেন। অস্ত্রের আদানপ্রদানের পাশাপাশি বইপত্রও বিনিময় করত সেখানে বিপ্লবীরা।'

কেবিন বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোট ছোট পর্দা ঘেরা খোপ বা কিউবিকলের কথা। শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে ছড়িয়ে রয়েছে এমন একাধিক কেবিন। বিধান সরণী ধরে এগোতে থাকলে চোখে পড়বে দিলখুশা ও বসন্ত কেবিন। তেমনি দক্ষিণে রয়েছে আপনজন, সাঙ্গু ভ্যালি। এদের কোনোটির বয়স ১০০ আবার কোনোটি প্রায় শতবর্ষের দোরগোঁড়ায়। কথিত আছে, আশি – নব্বইয়ের দশকে বাড়ির মহিলারাও নাকি আসতেন এই কেবিনগুলিতে। মূলত তাঁদের জন্যই নাকি পর্দাঘেরা এমন ছোট ছোট খোপ বা কিউবিকলের ব্যবস্থা। খুব বেশি হলে এই কিউবিকলগুলিতে ঠাঁই হবে চার জনের। সস্তায় চায়ের সাথে ডিমের ডেভিল, ফিশ ফ্রাই , ডিম টোস্টের এর মত আইটেমগুলি পাওয়া যেত কেবিনে আর সাথে জমে উঠত আড্ডা  । ফিরে দেখা যাক কলকাতার সেইসব কেবিনগুলির  ঐতিহ্য ও  স্বাধীনতা গ্রামের ইতিহাসে তাদের ভূমিকা -

ফেভারিট কেবিন

১৯১৮ সালে পথচলা শুরু ফেভারিট কেবিনের। একদা চট্টগ্রামের বাসিন্দা নতুনচন্দ্র বড়ুয়া ভাই গৌরকে সঙ্গে নিয়ে ৬৯, সূর্য সেন স্ট্রিটের এক আয়তাকার ঘরে শুরু করেছিলেন এই দোকান। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বড়ুয়া ভ্রাতৃদ্বয়ের এই কেবিনে ডিম,মাছ বা মাংসের প্রবেশ ছিল নিষেধ। নিরামিষ খাবারেও সকলের 'ফেভারিট' ছিল এই কেবিন। এমনকী এঁরা এখনও নিরামিষ কেক বিক্রি করেন। ভিতরের শ্বেত পাথরের টেবিল ও কাঠের চেয়ারগুলি আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে শুরুর দিনগুলিতে। এর মধ্যে চার নম্বর টেবিলে নাকি বসতেন কাজী নুজ্রুল ইসলাম। চা সহযোগে সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে কথা বলতেন তাঁর লেখা গান ও কবিতা নিয়ে। প্রেসিডেন্সিতে পড়াকালীন সুভাষের নিত্য যাতায়াত ছিল ফেভারিটে। স্বয়ং সূর্য সেনও আসতেন এখানে। শুধু বিপ্লবীদের আনাগোনা নয় তাঁদের একাধিক বার পুলিশের হাত থেকেও বাঁচিয়েছেন বড়ুয়া ভাইয়েরা। বিপদের সময় পালিয়ে যাবার জন্য ছিল গোপন রাস্তাও। পরবর্তীকালে শক্তি-সুনীল, প্রেমেন্দ্র মিত্র, ঋত্বিক ঘটক, শিবরাম চক্রবর্তী,বিজন ভট্টাচার্য, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এমন বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব ফেভারিটের প্রতিদিনের খরিদ্দার ছিলেন।

অন্তরঙ্গ আড্ডায় ফেবারিট কেবিন। ছবি ট্যুইটার থেকে নেওয়া।

বসন্ত কেবিন

১৩০ বছর আগে বসন্তকুমার রায়ের হাত ধরে কলেজ স্ট্রিটে চত্বরে শুরু হয় এই কেবিন। আজ তাঁর তৃতীয় প্রজন্মের হাতে রয়েছে এর দ্বায়িত্ব। শিল্পী গনেশ পাইন একসময় প্রতিদিন আসতেন এই কেবিনে। তবে স্বাধীনতার সময় থেকে বিপ্লবীদের আনাগোনা ছিল এই কেবিনে। পাশাপাশি নকশাল আন্দোলনের সময় বসন্ত কেবিন হয়ে উঠেছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ডেরা। কবিরাজী এখানকার মূল আকর্ষণ। চালু গল্পে শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে খুশি করার জন্য বসন্ত কেবিনের প্রধান রাঁধুনি বিস্কুটের গুঁড়োর বদলে ডিম ব্যবহার করে তৈরি করেছিলেন কবিরাজী। তবে এ নিয়ে মতান্তরও রয়েছে।

দিলখুসা কেবিন

বিপ্লবীদের গোপন পরিকল্পনার অন্যতম আঁতুড়ঘর ছিল দিলখুশা।অনেকেই মনে করেন দিলখুশাতেই প্রথম কবিরাজী কাটলেট তৈরি হয়।  এখানকার কবিরাজি কাটলেট, মাটন চপ, ডেভিল চপ, ব্রেস্ট কাটলেটের স্বাদ পেতে সাহিত্যিক থেকে বিদ্বজন সকলেই ভিড় জমাতেন।

অধ্যাপক অলোক কুমার বলেছেন, ‘সবসময় একই কেবিনে তাঁরা দেখা করত না কারণ এতে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকত। তবে শুধু কিন্তু আন্দোলন নয় কেবিনে আড্ডা এবং প্রেমও চলত পাল্লা দিয়ে। পরবর্তী সময়ে স্ট্রিট ফুডের জনপ্রিয়তার কারণে কেবিনগুলিতে মানুষের আনাগোনা কমতে থাকায় স্ন্যাক্সের পাশাপাশি চাইনিজ খাবার, রুটি- কষা মাংস ইত্যাদি খাবারও মেনুতে জায়গা করে নেয়’। ইতিহাসের পাতায় কেবিনগুলি জায়গা করে নিলেও কলকাতাবাসীর মনে আজ ঝাপসা হয়ে এসেছে কেবিনের স্মৃতি। চা স্ন্যাক্স খেতেও আজ তাঁদের প্রথম পছন্দ ঝকঝকে রেস্তোরাঁ। ইতিহাসের মর্ম কবে আর বুঝবে বাঙালি। তাও পরের নয়, ঘরের ইতিহাস।   

More Articles