বিশ্বাসে মিলায়ে শোক, অঙ্কে বিয়োগফল

আমার বিশ্বাস, হয়েছিল। ওরা পারে মুখ লুকিয়ে পালিয়ে যেতে। যেমনটা সর্বজয়ার সঙ্গে হত। ওরা নির্ঘাৎ অপেক্ষা করত, আমার নিদ্রা যাওয়ার। তখনই চোরাগোপ্তায় ডিঙিয়ে যেত ক্ষতস্থল।

কলেজ পেরিয়ে খানিক লায়েক-টায়েক হয়েছি যখন, অন্তত মনে তা-ই করছি আর কী! ‘অপরাজিত’ ধীরে গ্রাস করতে শুরু করে। বিশেষ করে সেই মুহূর্ত, যখন সর্বজয়া ভীষণ বিপন্ন আলোয় বসে স্থির তাকিয়ে থাকে, হয়ে ওঠা এক আশার দিকে। দূর দিয়ে ভেসে যায় ট্রেন, আরও এক বার, সর্বজয়ার শেষতম বিন্দুকে খড়কুটোর মতো উড়িয়ে। আদরের অপু সে বারও ভুল করে গ্রামের ভিটেয় ফিরে আসে না। বসে থাকে ঠায় তবুও সর্বজয়া অনাদরকেই আধার ভেবে। আর ও ভাবে সে বসে থাকে বলেই তো আমরা বুঝেছি, জংলি আগাছার-ও এক মায়াভুবন আছে, সন্ধ্যাশেষেরও নরম এক আঘ্রাণ আর কলরবি ঝিঁঝিঁ-রাও বেদনার ইশারা বুঝে পিছু হটে মাতমের তোড়জোড় করে। শুধু বুঝিনি, সে ট্রেন বা যাবতীয় ট্রেনেরা, এতটা পথ বুকফাটা হতাশা বয়ে নিয়ে এসেও কেন জাস্ট এক বার দু’দণ্ড থেমে নেয় না? অন্তত সর্বজয়ার মুখের দিকে তাকাতে অসুবিধে হলে, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে অস্ফুটে নয় বলে নিত কিছু একটা। আচ্ছা বলতেও হবে না, অ্যাটলিস্ট একটা দীর্ঘশ্বাস। আমরা বুঝে নিতাম, অপু পরের বারও বোধহয় ফিরবে না। বা সেই ট্রেন বোধ হয় পূর্ব জন্মে অপু ছিল। যে জানে, এই লাগাতার না-ফেরার অন্তিম ফল কী হবে। অনুশোচনায় তার আর দাঁড়ানো হতো না সর্বজয়ার ভগ্নহৃদয়-সম্মুখে। অভাবী আলো-সহোদর সে ট্রেনের, নিশ্চিত। চট করে টেনে দিত যবনিকা আগামীর যাত্রাপথে।

আরও পড়ুন: নোলান শেষমেশ ঝোলালেন, ম্যাচের গোলাপি ঘোড়া বার্বিই!

কিন্তু ট্রেনের কি আর সুখের দুপুর দেখা কপালে রয়েছে? বেচারির জন্মদাগই অভিশাপের আঁতুড়ঘর যে। নইলে আজও আমার মনে থাকে ওই লাল মালগাড়ি, যাতে কাটা পড়েছিল আমার বড় মামা! আমার প্রথম মৃত্যু দেখা। আমার প্রথম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মালগাড়িকেও দেখা। যে কোনও মৃত্যুই তার মতো করে নৃশংস, কিন্তু ট্রেনের চাকায় ফালা ফালা হওয়া অন্য এক বিষাদবৃক্ষ। আমার তখন কত হবে ৬ কি ৭, দূর থেকে দেখেছিলাম বৈতরণী নদীর পারে কাঠের চিতায় রাখা সাদায় মোড়া দেহাংশ। একদা গম্ভীর ও স্নেহময় বড় মামার। কী করে যে কী হল, এখন ভাল করে বুঝি, তা নিয়ে কেউ তখন কোনও আলোচনা করেনি। আমার দাদারাও। সত্যিই তো, ও সব করে তো পচতে থাকা ক্ষয়কেই আরও খানিক বিষিয়ে তোলা হত। থাক না, কী দরকার…আমি এক বারই নেমেছিলাম বালিতে, তার পর আবার উঠে বসেছিলাম আমাদের জিপ-এ। বাবা-মা গিয়েছিল সামনে, আগুনের। আমি ওদের যেতে দেখেছিলাম, ড্রাইভার আহমেদ কাকুর পাশে বসে। লিখে ফেললাম বটে ড্রাইভার, কাজটাও তাই ছিল, কিন্তু আহমেদ কাকু (সকলের দেখাদেখি আমি বলতাম আমেদ) আমার কাছে চিরকাল আহমেদ কাকু-ই। মুখে পান সর্বক্ষণ, শোলে-য় আমজাদ খান যেমন পোশাক পরেছিল, অনেকটা তেমন জামা পরত আহমেদ কাকু। খানিক থলথলে দেখতে হলেও, আসলে সাংঘাতিক গায়ের জোর ছিল, পাঞ্জাখানি দেখার মতো ছিল। এক বার আহ্লাদ দেখাতে গিয়ে আমি ওর নাক কামড়ে দিয়েছিলাম, অকস্মাৎ ওই আদরজ্ঞাপনের মোক্ষম রিঅ্যাকশন বাবদ আমি ওর পাঞ্জাকে ক্লোজ-শটে দেখেছিলাম। সে যাক গে।

আমি সে দিন গাড়ি থেকেই দেখেছিলাম বড় মামা কেমন আগুনের পাতলা একটা আস্তরণের মধ্যে দিয়ে নেই হয়ে গেল। প্রতিবার আমাদের বাড়ি এলেই বড় মামা একটা করে চকলেট আনত আমার জন্যে। সে দিন বাড়ি ফিরে ফ্রিজ খুলে দেখেছিলাম, সে বারেরটা আমার খাওয়া হয়নি। কেন জানি না, আমার আজও ভিতরে একটা খচ্‌খচ্‌ থেকে গেছে। কেন আমি ফ্রিজে চকলেট আছে জেনেও খেলাম না! সাধারণত তো খাই। খেয়ে নিলেও বা কী হত, তবুও কোথাও যেন প্রত্যাখ্যানের একটা স্বাদ বহু বছর লেগেছিল আমার আত্মায়। অবশ্য তা কখন গা থেকে ঝড়ে পড়ে গেছে, তা-ও খেয়াল নেই, এমনই লায়েক হয়েছি কালে কালে।

বড় মামা রইল না, ভূত হয়েও না। ভূতে আমার আজও প্রবল ভয়। যে যাই বলুক না কেন, আমি বিশ্বাস করি সে ভয়ে। আর বরবিল থেকে জঙ্গলের রাস্তা বেয়ে যে দীর্ঘ পথ থামত এসে বাঁশপানিতে (আমার মামা'র বাড়ি), সেখানে কোনও আবছায়া-মাঝে কখনও তো মনে হয়নি, বড় মামার মতো কেউ যেন চোখে চোখে রেখেছে আমাদের। অথচ, জোডা (মতান্তরে জোড়া) বাস স্ট্যান্ডের একটু পাশে আমিই তো অন্তত তিন বার দেখেছি সাদাটে সালোয়ার কামিজ পরা সেই প্রায় ছ’ফুটি পঞ্জাবনকে। যখন ক্রস করতাম ওই অঞ্চল, আমি জোর করে চোখ বন্ধ করে রাখতাম, তার পর অনেকটা এগিয়ে গেছি বুঝতে পারলে, আলতো করে চোখ খুলতাম। সেই করেই তিন বার দেখেছি, তার পর বাড়ি এসেও কেমন সিঁটিয়ে থাকতাম, এক বার তো জ্বরও চলে এলে। নেহাৎ সারেঙ্গী ডাক্তারের অসম্ভব তেতো একটা সিরাপ চার বারের বেশি খেতে পারলাম না, তাই জোর করে সুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। সেই পঞ্জাবন নাকি আমার জন্মের আগে এক বার দত্ত কাকুর সঙ্গে আমাদের বাড়িও এসেছিল। অন্য কোনও দিন নয় বলব তার কথা, কিন্তু বড় মামাকে সে দিন বৈতরণী নদীর পারে ছাই হতে দেখার পর আর কোনও দিনই দেখিনি। আসলে ছোটদের বিশ্বাস থাকে বোধ হয়, যে এই না হলে নিশ্চয়ই ওই বা সেই নামক অন্য কোনও ফর্মে বা শেপে ঠিক প্রিয় জনেরা বুদ্বুদ জার্নি জারি রাখে। বড় মামা সেই ভুল ভেঙেছিল।

আরও পড়ুন: শোকের বিগ্রহ

আমার মনের ভুল কি না জানি না, তবে সে ঘটনার পর আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে লাল মালগাড়ির চলাচল কমে গিয়েছিল। যুক্তি বলে, হতে পারে না। একটি মাইনিং টাউনে মালগাড়ি ঢুকছে না, বেরোচ্ছে না, ম্যাঙ্গানিজ ওর বা অ্যালুমিনিয়াম ওর নিয়ে, স্রেফ রেললাইনের ধারে যে ছেলেটা থাকে, তার বড় মামা ট্রেনের ধাক্কায় গত হয়েছে বলে, সম্ভব? কিন্তু আমার বিশ্বাস, হয়েছিল। ওরা পারে মুখ লুকিয়ে পালিয়ে যেতে। যেমনটা সর্বজয়ার সঙ্গে হত। ওরা নির্ঘাৎ অপেক্ষা করত, আমার নিদ্রা যাওয়ার। তখনই চোরাগোপ্তায় ডিঙিয়ে যেত ক্ষতস্থল। এ রকম করে করেই এক দিন সয়ে গেল আমার শূন্যভাব। মেজমামা আর দাদা'রা পুরনো বাড়ি ছেড়ে তৈরি করল সাদা প্রায় প্রাসাদের মতো এক নতুন বাড়ি।

প্রকৃত অর্থেই বোধ হয় বড় মামা পার হয়ে গেল বৈতরণী।

More Articles