এভাবে দিনদুপুরে চুরি হয়েছিল এসএসসি-র নম্বর! বড় গড়মিল এখন প্রকাশ্যে

নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে রাজ্যে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। এবার তাঁর দেখানো পথেই কি হাঁটলেন আর এক বিচারপতি? নাম, রাজশেখর মান্থা। এবার তিনি ন‍্যায়বিচার দিলেন এক চাকরিপ্রার্থীকে, যিনি নম্বর চুরির শিকার হয়ে পথে পথে ঘুরেছেন বিচারের আশায়।

সোনা-দানা, টাকা-পয়সা চুরি যায়, সিন্দুক ভাঙে, (দুর্নীতির টাকায় নাকি পাহাড় গড়েন মন্ত্রী) তাই বলে 'নম্বর চুরি’? এমনও হয় নাকি! দুর্নীতির শেকড় কতদূর বিস্তৃত হলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে? 'নম্বর চুরি’ যাওয়ায় চাকরি পাননি এক প্রার্থী। এই মামলা বিচারপতি রাজশেখর মান্থার এজলাসে আসতেই এসএসসি ভুল স্বীকার করে। তারপরে বিচারপতি মান্থার নির্দেশ, ২ সপ্তাহের মধ্যে এসএসসিকে চাকরি দিতে হবে ওই প্রার্থীকে। এসএসসি দুর্নীতি নিয়ে আগেই মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতার চাকরি কেড়ে নিয়েছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। অনেক লড়াইয়ের শেষে শেষ হাসি হাসেন ববিতা সরকার। অঙ্কিতার জায়গায় ববিতা সরকারকে চাকরি দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। সেবারও আদালতে মুখ পুড়েছিল এসএসসি-র। সেবার ববিতাকে সুবিচার দেওয়ার পিছনে মূল কাণ্ডারি ছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এদিন সেই পথের পথিক হয়ে আইনের পাশে দাঁড়ালেন আর এক বিচারপতি। দুর্নীতির জল কত গভীরে পৌঁছলে নম্বর চুরি যায়! কী হলো এদিন?

দুর্নীতির কতই না রকমফের দেখবে রাজ্য। এবার এসএসসি ইন্টারভিউয়ে নম্বর 'চুরি'। হাই কোর্টে ভুল স্বীকার করে নিল স্কুল সার্ভিস কমিশন। বাধ্য হয়ে? সে যাই হোক, চাকরিপ্রার্থী সুরজিৎ গোস্বামী ইন্টারভিউর প্রাপ্য নম্বর ৪ কমিয়ে ২ দেখায় এসএসসি। ইন্টারভিউর স্কোরশিট চাইতেই দুর্নীতির পর্দা ফাঁস। ইন্টারভিউর স্কোরশিটের আসল কপি হাই কোর্টে প্রকাশের আবেদন করেন মামলাকারী। তখনই এসএসসি জানিয়ে দিল, সুরজিৎ গোস্বামী ইন্টারভিউর নম্বর পায় ৪। ভুলবশত তা ২ হয়ে গেছে। এসএসসি-র নয়া এহেন অনিয়ম কাণ্ডে বিস্মিত বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা। দীর্ঘ ৮ বছর আইনি লড়াইয়ের পর জয়। বাঁকুড়ার সুরজিৎ গোস্বামীকে চাকরি দিতে নির্দেশ বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার। উচ্চ প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে ২ সপ্তাহের মধ্যে নিয়োগ দিতে নির্দেশ। সুরজিৎ গোস্বামীর আইনজীবী সুদীপ্ত দাশগুপ্ত জানান, ৮ বছরের চাকরির যাবতীয় সুযোগ দিতেও নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

আরও পড়ুন: পরেশ থেকে মানিক, যেভাবে একে একে রাঘববোয়ালকে জালে ফেলছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

কীভাবে বিচার পেলেন সুরজিৎ?
হাই কোর্টে যেতেই এসএসসি জানাল 'ভুল হয়ে গেছে।' অথচ চাকরিপ্রার্থীর দাবি, ইন্টারভিউতে ৪ নম্বর পেলে তিনি চাকরি পেতে পারেন। দুই পক্ষর বক্তব্য শুনে বিস্মিত বিচারপতি রাজশেখর মান্থা এসএসসি-কে নির্দেশ দিয়েছেন, দ্রুত চাকরিপ্রার্থীকে চাকরি দিতে হবে। প্রয়োজনে শূন্যপদ তৈরি করে চাকরি দিতে হবে। ২০১৪ সালে উচ্চপ্রাথমিকের শারীরশিক্ষা বিভাগের পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেননি বাঁকুড়ার বাসিন্দা সুরজিৎ গোস্বামী। তথ্য জানার অধিকার আইনে তিনি খাতা দেখতে চান। খাতায় তিনি দেখেন, একটি প্রশ্নের উত্তর সঠিক লিখলেও তাঁকে সেই প্রশ্নের জন্য নম্বর দেওয়া হয়নি। তখন পর্যন্ত সুরজিতের যা নম্বর ছিল, এক নম্বর পেলে তিনি ইন্টারভিউর জন্য বিবেচিত হতে পারতেন।

এই পরিস্থিতিতে সুরজিৎ হাই কোর্টের দ্বারস্থ হলেন। ২০২২ সালের মার্চ মাসে বিচারপতি অমৃতা সিনহা নির্দেশ দেন, এসএসসি চেয়ারম্যান বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ে প্রশ্ন বিতর্কের নিষ্পত্তি করুক। উত্তরপত্রের পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। বিশেষজ্ঞ কমিটি জানায়, সুরজিতের লেখা উত্তরটি সঠিক ছিল। তখন ওই চাকরিপ্রার্থীর প্রাপ্ত নম্বর হয় ৬৬। তিনি ইন্টারভিউর জন্য বিবেচিত হন। কিন্তু সুরজিৎ অভিযোগ করেন, ইন্টারভিউতে তিনি ৪ নম্বর পেলেও তাঁকে ২ নম্বর দেওয়া হয়েছে। চাকরিপ্রার্থী এও দাবি করেন যে, ৪ নম্বর পেলে তাঁর মোট নম্বর হবে ৭০। সেক্ষেত্রে তিনি চাকরির জন্য বিবেচিত হবেন। কারণ মেধাতালিকায় থাকা শেষ প্রার্থীর প্রাপ্ত নম্বর ৭০-এর কম। সোমবার এই মামলার শুনানিতে বিচারপতি ররাজশেখর মান্থা ইন্টারভিউর নম্বর কমা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এসএসসি-কে নির্দেশ দেন, দ্রুত সুরজিৎকে চাকরি দিতে হবে। ২০১৪ সাল থেকে পদোন্নতি-সহ চাকরির সমস্ত সুযোগসুবিধে তাঁকে দিতে হবে।

এদিনের রায় অবশ্যই বিচারব্যবস্থায় নজির তৈরি করল। এর আগে যেমন নজির তৈরি করেছে ববিতা-অঙ্কিতা মামলা। সেই মামলায় এসএসসি-র দুর্নীতি অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হলেও তার মূল উপড়ে ফেলে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।

২০১৭ থেকে ২০২২ সাল। রাজ্যের শিক্ষামানচিত্রে অঙ্কিতা অধিকারীর নাম। এদিকে অপর একটি নামও ফের আসে চর্চায়। তিনি ববিতা সরকার। ওয়েটিং লিস্টে নাম ছিল তাঁর। এদিকে সাধারণত প্যানেল লিস্টে থাকা কর্মপ্রার্থীদের চাকরি হওয়ার পরে ওয়েটিং লিস্টে থাকা চাকরিপ্রার্থীদের পালা আসে। এই নিয়ে আশায় আশায় বসেছিলেন শিলিগুড়ির কোর্ট মোড়ের বাসিন্দা ববিতা সরকার। কিন্তু সেই চাকরি আর জুটল না। তালিকা প্রকাশের দাবিতে আন্দোলনে নামেন কর্মপ্রার্থীরা। এরপর দেখা যায় ববিতা সরকারের নাম রয়েছে ২০ নম্বরে। এদিকে দ্বিতীয় কাউন্সেলিংয়ের পর তিনি জানতে পারেন তাঁর নাম চলে এসেছে ২১ নম্বরে। আর এক অদৃশ্য হাতের জোরে এক নম্বরে চলে এসেছেন অঙ্কিতা অধিকারীর নাম। তাঁর বাবা রাজ‍্যের মন্ত্রী পরেশ অধিকারী।

ববিতার দাবি, অঙ্কিতার ইন্টারভিউ ছাড়া প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৬১। এদিকে তাঁর ইন্টারভিউ-সহ নম্বর ছিল ৭৭। অঙ্কিতা যদি ইন্টিরভিউতে ১০ নম্বরও পান, তবেও তাঁর নম্বর কোনওভাবে ববিতার থেকে বেশি হবে না। তাহলে কীভাবে মেধাতালিকায় অঙ্কিতার নাম প্রথমে এসে যায়?

প্রভাবশালী মন্ত্রীকন্যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন ববিতা। তাঁর হার না-মানা জেদ প্রভাবশালী মন্ত্রীকেও এনে ফেলেছে সিবিআইয়ের দরজায়। এদিকে এসএসসি-র চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন সিদ্ধার্থ মজুমদার। তিনিও জানিয়েছিলেন, পরেশ-কন্যাকে অবৈধভাবে চাকরি দেওয়ার কথা। এই লড়াইয়ের শরিক তিনিও। তারপর ববিতার ভরসা দেশের আইন-আদালত। এত লড়াইয়ের পর শেষ হাসি হাসেন তিনি।

দুর্নীতির চোরাগোপ্তা পথে প্রভাবশালী বাবার তকমা কাজে লাগিয়ে চাকরি পেয়েও অঙ্কিতার মুখের হাসি ম্লান করে দিল সত্যের লড়াই। ববিতা এই ঘুণ ধরা সমাজের বুকেই লিখে দিলেন এভাবেও রুখে দাঁড়ানো যায়। সততার পথে সত্যেরই জয়। জয়ী ববিতা! নেপথ্যে এক বিচারপতি। এদিন সুরজিতের কাহিনি যদি কোনও নজির তৈরি করে, তাহলে সেক্ষেত্রেও নেপথ্যের কারিগর হিসেবে লেখা থাকবে আর এক বিচারপতির নাম। এরই পাশাপাশি পেঁয়াজের খোলা ছাড়ানোর মতো প্রতিদিন যেভাবে নিয়োগ দুর্নীতির নতুন নতুন অধ্যায় সামনে আসছে, তাতে রাজ্য আরও কত পাতালে প্রবেশ করবে, কে জানে!

More Articles