খিদের মার, শীতের ছোবল! যুদ্ধের একশো দিন পেরিয়ে যেমন আছে গাজা...

Gaza-Israel War: যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার জনসংখ্যার অন্তত ৯৩ শতাংশই খাদ্যসংকটের মুখোমুখি। হু জানিয়েছে, চারটি পরিবারের মধ্যে অন্তত একজন করে খাদ্যের চরম অভাব ও অনাহারে ভুগছে।

যুদ্ধের একশো দিন। এই একশো দিনে ক্রমশ খাদের অতলে পৌঁছে গিয়েছে গোটা গাজা ভূখণ্ড। তা সত্ত্বেও আগ্রাসন কমছে না ইজরায়েলের। যুদ্ধ মানে তো শুধুই প্রতিমুহূর্তে মাথার উপর ঘাই মারা যুদ্ধবিমান, রক্তাক্ত শরীর আর মৃতদেহের সারিই নয়। আরও নানাবিধ ক্ষয়ক্ষতির মুখে দাঁড়িয়ে একেবারে পর্যুদস্ত গাজা। ছোবল মারছে খিদের জ্বালা। তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়া শীত। সেই অক্টোবর থেকে গাজায় যুদ্ধটা চলছে, বিরামহীন। হ্যাঁ, মাঝখানে চারদিনের যুদ্ধবিরতি ছিল বটে। তবে তা নাম কা ওয়াস্তে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে গাজায়। তিন মাসে প্রায় ২৫ হাজার বাসিন্দাকে মৃতদেহ হয়ে যেতে দেখেছে প্যালেস্টাইন। তার মধ্যে সাত-আট হাজারই শিশু। জখম প্রায় পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষ। শরীরে যুদ্ধাঘাতের দগদগে ক্ষত, পেটে খিদে, শরীরে শীতের ছোবল আর মাথায়, চেতনায় যুদ্ধের আরও বড় ধরনের ক্ষয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাঁরা যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায়।

কবে থামবে যুদ্ধ! উত্তর নেই। এরই মধ্যে ইজরায়েলের বিরুদ্ধ নির্বিচারে গণহত্যার অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক আদালতে (ICJ)-র দ্বারস্থ হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ইজরায়েলের অবশ্য তা নিয়ে বিকার নেই। প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র সংগঠন হামাসের শেষ না দেখে ছাড়বে না তারা। বিশ্ব আদালতেও তার পক্ষে যুক্তি দিতে ছাড়েনি তারা। প্যালেস্টাইন এমনই একটা দেশ, যার কোনও সরকারি, বেসরকারি সশস্ত্র সেনা বা বাহিনী থাকতে নেই। ইজরায়েলের সঙ্গে এমনই চুক্তিতে বাঁধা তারা। সেই চুক্তি ভাঙলেই প্যালেস্টাইনে হামলা চালিয়ে বসতে পারে ইজরায়েল। তেমনটাই হয়েছে। প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার জন্য যে লড়াই, তা আজকের নয়। সেই লড়াইকে সমর্থন করেছে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বহু দেশই। কিন্তু তাতে গাজার এই মৃত্যমিছিল থামেনি। একশো দিন ধরে প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন গাজার মানুষ। নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রেহাই মিলছে না কারওরই। এতদিনে গাজা কার্যত একটা ধ্বংসস্তূপ। গাজায় প্রায় প্রতিটি অংশ জুড়ে হামলার পর হামলা চালিয়ে গিয়েছে ইজরায়েল। গুঁড়িয়ে দিয়েছে ঘরের পর ঘর, বহুতলের পর বহুতল। হাসপাতাল, স্কুল থেকে শরণার্থী শিবির রেহাই পায়নি কিছুই।

আরও পড়ুন: ইজরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে ‘গণহত্যা’র নালিশ! কবে ফিরবে গাজায় শান্তি?

মানবাধিকার সংগঠনগুলো আগেই সতর্ক করেছিল, এইভাবে ইজরায়েল আগ্রাসন দেখিয়ে চললে খুব শিগগিরই আরও বড় মানবিক সংকটে পড়বে গাজা-সহ প্য়ালেস্টাইন। আর সেই পরিস্থিতিই এসে পৌঁছেছে এখন। দেখা গিয়েছে খাদ্য সঙ্কট। হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে দেওয়ার পরেই গাজায় জল, খাবার ও বিদ্যুৎ পরিষেবায় রোখ টেনেছিল ইজরায়েল। সেই কৃত্রিম রোখ তো স্তীমিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু এতদিনে সত্যিকারের খাদ্যসঙ্কটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে গাজা। কিছুদিন আগে গাজা ভূখণ্ড থেকে সমস্ত রকম মেডিক্যাল সাহায্য় প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু। একাধিক দাতব্য সংস্থাই গাজা থেকে নিজেদের কর্মী প্রত্যাহার করে নিচ্ছে নিরাপত্তার খাতিরে।

দিন কয়েক আগেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার জনসংখ্যার অন্তত ৯৩ শতাংশই খাদ্যসংকটের মুখোমুখি। হু জানিয়েছে, চারটি পরিবারের মধ্যে অন্তত একজন করে খাদ্যের চরম অভাব ও অনাহারে ভুগছে। সামান্যতম খাদ্যবস্তুটির জন্যও নিজেদের সম্পত্তি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন গাজার মানুষ। সিরিয়ার যুদ্ধের সময় আমরা দেখেছি, কীভাবে একটুকুরো রুটির জন্য কোলের সন্তানকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন বাবা-মা। যুদ্ধ আসলে এমনই। মানুষের ভিতর থেকে ভয়ঙ্করতম দানবটাকে বের করে আনে বাইরে। গাজা এখন ঠিক সেই দুর্ভীক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে।

তার উপর প্রবল শীত সেই পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলছে ক্রমশ। যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচাতে শহর থেকে অন্য শহর, দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পালিয়ে বেরিয়েছে মানুষ। কিন্তু কোনও জায়গাই কি আদৌ সুরক্ষিত প্যালেস্টাইনে আর! রাস্তা জুড়ে ভিক্ষুকের ভিড়। যারা মধ্যবিত্ত, মোটামুটি ঠিকঠাক মতো যাদের সংসারটুকু চলে যেত, এই যুদ্ধ তাদের পথে বসিয়েছে। তবু মানুষ চেষ্টা করছে একে অন্যকে সাহায্যের। পারছে না। তবু চেষ্টাটুকু করছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় যখন মানবতার সমস্ত চিহ্নটুকু মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে ইজরায়েল, মানুষ তবু চেষ্টা করছে একে অপরকে এই যুদ্ধের সংকট থেকে বাঁচিয়ে আনার। বারবার হাসপাতালগুলোকে নিশানা করে হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল। মারা গিয়েছে অজস্র রোগী। জখম হয়েছে রোগীর আত্মীয়, পরিজন থেকে হাসপাতালকর্মীরা। ওষুধের জোগান নেই, মেডিক্যালের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেই। তবু চিকিৎসকেরা চেষ্টা করে চলেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষকে বাঁচানোর। সত্যি কথা বলতে, গাজায় এখন এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে মানুষ নিরাপদে একটা রাতও কাটাতে পারে। ক্রমশ গাজা থেকে খান ইউনিসেও হামলার মাত্রা বাড়িয়েছে ইজরায়েল।

ইজরায়েলি সেনার হামলায় বাড়িঘর উড়ে গিয়েছে, দাঁড়িয়ে রয়েছে কোনওক্রমে একটা দরজা আর দুটো জানলার কাঠামোটুকু। কোনওমতো ২ মিটার বাই ১ মিটার তাবুতে উঠে এসেছে রাফাহা থেকে বাস্তুচ্যুত পরিবারটি। সেই তাবুটুকুও কোনওমতে নিজেরাই কিনেছেন তারা। মেলেনি কোনও সাহায্য। প্রথম কয়েকদিন টিনজাত খাবার কিনে খেয়ে দিন কেটেছিল। এখন সেই খাবারের দামও যুদ্ধের বাজারে এতটাই বেড়েছে, যে কেনা কঠিন। নেই ওষুধটুকুক জোগানও।

 

এদিকে যুদ্ধের বাজারে গাজায় বেড়েছে অসুস্থতাও। হু-এর একটি পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, অক্টোবর থেকে অন্তত এক লক্ষ ডায়রিয়ার ঘটনা ঘটেছে গাজায়। আর তার অর্ধেক শিকারই পাঁচ ও তার চেয়ে কম বয়সী শিশু। ইজরায়েল হামলার আগে এই সংখ্যাটা গড়ে ছিল পঁচিশের কাছাকাছি। শুধু ডায়রিয়াই নয়। শ্বাসযন্ত্র সংক্রমণেক ঘটনাও বেড়েছে গাজায়। মেনিনজাইটিস, ত্বকের ব়্যাশ, খোশপেঁজরা থেকে শুরু করে বেড়েছে বহু রোগই। অনেকের মধ্যেই জন্ডিসের লক্ষণ রয়েছে। হেপাটাইটিস রোগীও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। অথচ এই যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার মানুষের চিকিৎসায় পর্যাপ্ত ওষুধের জোগানটুকুও নেই। একে খিদে, তার উপর রোগ। এই যুগলবন্দি ক্রমশ মৃতদের ভিড় বাড়াচ্ছে গাজায়। আসলে খিদে তো মানুষের শরীরে প্রতিরক্ষা সিস্টেমকে দুর্বল করে দেয়। ক্রমশ আরও রোগকে ডেকে আনে। বাড়ছে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও হামের মতো অসুস্থতাও। শুধু শিশু ও বয়স্করাই নয়, গর্ভবতী ও সদ্য মা-দের অবস্থাও খুব খারাপ। অপুষ্টিতে ভুগছেন অধিকাংশরাই। পর্যাপ্ত পরিমাণে বুকের দুধটুকু তৈরি হচ্ছে না পুষ্টির অভাবে। ফলে শিশুদের অনাক্রম্যতাও তৈরি হচ্ছে না ঠিকঠাক। গাজা ও সংলগ্ন এলাকায় ক্রমশ কমছে নিরাপদ জলের জোগানও। ফলে বিপদ ক্রমশ বাড়ছেই।

আরও পড়ুন: নেই চিকিৎসার ন্যূনতম সুযোগ! কেন গাজায় মেডিক্যাল ত্রাণ বন্ধ করে দিচ্ছে WHO?

উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ গাজায় রাতভর অবিচ্ছিন্ন ভাবে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। গত কয়েক দিনে কয়েক ডজন সাধারণ নাগরিক হতাহত হয়েছে ইজরায়েলের হামলায়। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে গুলি করে মারা হয় দুই ফিলিস্তিনি যুবককে। গ্রেফতার হয়েছে কয়েক ডজন ছাত্র।

এদিকে হেগে আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার অভিযোগের বিরোধিতায় একের পর এক যুক্তি সাজিয়ে গিয়েছে ইজরায়েল। পাশাপাশি এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছে যে যাই বলুক, আগ্রাসন থামাচ্ছে না ইজরায়েল। সামান্যতম খাবারের জন্য মারপিট, প্রতিদিন অপুষ্টিতে, অভুক্ত মানুষের মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়া আর অযুত-নিযুত মানবাধিকারের ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে প্রহর গুনছে গাজা-সহ প্যালেস্টাইনের একাধিক অংশ। শান্তি শব্দটাতেই বুঝি বা ভ্রম মনে হয় এখন বাসিন্দাদের।

More Articles