ইজরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে 'গণহত্যা'র নালিশ! কবে ফিরবে গাজায় শান্তি?

Israel-Gaza war: আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত মামলা গড়ালেও গাজায় আগ্রাসন কমাতে চাইছে না কোনওভাবেই ইজরায়েল। এরই মধ্যে একাধিক হামলা চালানো হয়েছে গাজায়।

কোনও মতেই রোখ টানা যাচ্ছে না ইজরায়েলের আগ্রাসনে। গাজা যেন মৃত্যুপুরী। এত মৃত্যু, এত লাশ, তার পরেও যুদ্ধের অবস্থান থেকে টলানো যায়নি ইজরায়েলকে। তার পরেও দ্বিগুণ আগ্রাসন নিয়ে গাজা জুড়ে হামলার পর হামলা চালিয়েই যাচ্ছে নেতানিয়াহু সরকার। এবার সেই ইজরায়েলের বিরুদ্ধেই ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (ICJ)-র কাছে গণহত্যার অভিযোগ আনল দক্ষিণ আফ্রিকা।

প্রায় তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজায় লাগাতার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। ইতিমধ্যেই চব্বিশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে গাজায়। যার মধ্যে অন্তত ৮ হাজার নাবালক ও শিশু। জখম কম করে হলেও ৬০ হাজার। গত ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে ঢুকে পড়ে হামলা চালিয়েছিল প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। তার পরেই হামাসের বিরুদ্ধে কার্যত গাজার বিরুদ্ধেই যুদ্ধঘোষণা করে দেয় ইজরায়েল। মধ্যিখানে বন্দিবদলের জন্য় চারদিনের যুদ্ধবিরতি থাকলেও অক্লান্ত ভাবে যুদ্ধ চলছে তার পর থেকেই। স্কুলবাড়ি, হাসপাতাল, শরণার্থী শিবির, ধর্মস্থান কোনও কিছুকেই বাদ দেয়নি ইজরায়েলি সেনা। একের পর এক মিসাইল, বোমা, ড্রোন হামলায় ধুলোয় মিশে গিয়েছে গোটা গাজা। বিশ্বের প্রায় সবকটি দেশের যুদ্ধশান্তির প্রস্তাবে কান পর্যন্ত দেয়নি নেতানিয়াহু সরকার। 

আন্তর্জাতিক আদালতে দক্ষিণ আফ্রিকা জানিয়েছে, গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের উপরে নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছে ইজরায়েল। আর ইজরায়েল, বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দেশ সেই সমস্ত অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলছে, এই সমস্ত অভিযোগ ভিত্তিহীন। রাষ্ট্রপুঞ্জের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ও উচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস অর্থাৎ আইসিজে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই আন্তর্জাতিক আদালত।

আরও পড়ুন: নেই চিকিৎসার ন্যূনতম সুযোগ! কেন গাজায় মেডিক্যাল ত্রাণ বন্ধ করে দিচ্ছে WHO?

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (ICC)-র মতো কোনও ব্যক্তিমানুষের বিচার করা হয় না এই আদালতে। বরং বিভিন্ন দেশের আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার হয় এই আদালতে। যেমন ভাবে এবার সেখানকার কাঠগড়ায় উঠেছে ইজরায়েল। এর আগে রাষ্ট্রপুঞ্জে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সংখ্য়াগরিষ্ঠতা এলেও তাতে আমল দেয়নি নেতানিয়াহু সরকার। এ বারও কি একই ভাবে আন্তর্জাতিক আদালতে দায় এড়াবে ইজরায়েল? গা থেকে ঝেড়ে ফেলবে গণহত্যার অভিযোগ?

যদিও ইজরায়েলের গা-ছাড়া ভাব অবশ্য সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত মামলা গড়ালেও গাজায় আগ্রাসন কমাতে চাইছে না কোনওভাবেই ইজরায়েল। এরই মধ্যে একাধিক হামলা চালানো হয়েছে গাজায়। বিশেষত বাসিন্দাদের নিশানা করেই ধেয়ে এসেছে ইজরায়েলি রকেট, ক্ষেপণাস্ত্রগুলি। গাজার উত্তরে রাফাহ এলাকায় ইজরায়েলের সাম্প্রতিকতম হামলায় অন্তত তেরো জনের মৃত্যর খবর মিলেছে। তার মধ্যে অনেকেই শিশু বলে জানা গিয়েছে। আর এই ঘটনা ঘটেছে সেদিন, যেদিন আন্তর্জাতিক আদালতে প্রথম শুনানি হতে চলেছে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ। শুধু রাফাহতেই নয়, মধ্য গাজার ডের এল বালাহর আল আকসা শহিদ হাসপাতালে ইজরায়েলি বোমায় অন্তত আট জনের খবর মৃত্যুর খবর মিলেছে। প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। খাতায় কলমে সংখ্যাটা এখন ২৩,৩৫৭-র আশপাশে ঘুরছে। জখম অন্তত ৫৯,৪১০।

গত ডিসেম্বরেই ইজরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। যেখানে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়। পাশাপাশি ফিলিস্তিনির বিরাট ভূখণ্ড জুড়ে দানবিক অত্যাচার চালাচ্ছে ইজরায়েলি সেনা। দক্ষিণ আফ্রিকা সেই অভিযোগও করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার এই পদক্ষেপে পাশে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের একাধিক দেশ। যারা গাজায় যুদ্ধশান্তির পক্ষে সওয়াল করে আসছে গোড়া থেকেই।

মজার ব্যাপার, দক্ষিণ আফ্রিকার এই আবেদনে সই করেছে ছ'শোর বেশি ইজরায়েলিও। যারা মানবিকতার খাতিরে চান যুদ্ধটা শেষ হোক। সেই ছ'শো জনের মধ্যে রয়েছেন অসংখ্য শিক্ষক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী মানুষজন। যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই তো যুদ্ধের বিরুদ্ধে। তেমনটাই হওয়া উচিত। ফলে ইজরায়েল-গাজা দ্বন্দ্বেও তার অন্যথা হয়নি।

ফিলিস্তিনিদের প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার সমর্থন আজকের নয়। ১৯৯৭ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা যখন রাষ্ট্রপতি, তখন থেকেই ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার সুসম্পর্কের শুরু। নেলসনের বক্তৃতায় একাধিক বার উঠে এসেছে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার কথা। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ, এমনটাই মনে করতেন তিনি। ২০১৩ সালে নেলসনের মৃত্যুর পর ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের রামাল্লা শহরে তাঁর বিরাট মূর্তিও বসেছিল। ফলে প্যালেস্টাইনের এই সঙ্কটে যে দক্ষিণ আফ্রিকা পাশে এসে দাঁড়াবে, তাতে আর নতুন কী!

যদিও আন্তর্জাতিক আদালতের সামনে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, তাদের প্রতিরোধ হামাসের বিরুদ্ধে। হামাস ইজরায়েলের অস্তিত্বের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ বলে দাবি করা হয়েছে আদালতে। পাশাপাশি ইজরায়েলি প্রতিরক্ষাবাহিনী যতটা সম্ভব নৈতিক ভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছে বলেও দাবি করা হয়েছে ইজরায়েলের তরফে। একই সঙ্গে নাগরিকদের মৃত্যু এড়াতে নানা রকম পদক্ষেপের কথাও জানানো হয়েছে বাহিনীর তরফে। ইজরায়েলের দাবি, তারা ফোন করে সতর্ক করে বিভিন্ন সময় গাজার বিভিন্ন ভবনের উপরে হামলা চালিয়েছে। এমনকী আকাশপথে হামলা চালানোর আগেও সতর্ক করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ রাস্তায় চলাচল করায় বহু হামলা বাতিলও করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতে ইজরায়েলি সরকার বারবার দাবি করেছে, গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনি নয়, হামাসদের শেষ করাই তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য। দক্ষিণ আফ্রিকার সমস্ত অভিযোগের জবাবে নিজেদের নিরপরাধ প্রমাণ করতে কোনও কসুর বাকি রাখেনি ইজরায়েল।

আরও পড়ুন: গাজার মৃতদেহ থেকে হৃদপিণ্ড, যকৃত সত্যিই সরিয়ে নিচ্ছে ইজরায়েল? কারণ জানলে শিউরে উঠবেন

দক্ষিণ আফ্রিকা চায়, ইজরায়েলকে গাজায় অবিলম্বে সমস্ত রকম যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দিক ইজরায়েল। তবে আদৌ কি সেই পরিস্থিতি তৈরি হবে। আর যদি হয়ও বা, ইজরায়েল কি আন্তর্জাতিক আদালতের কথা মানবে। খাতায়-কলমে আন্তর্জাতিক আদালতের সমস্ত নির্দেশ মানতে বাধ্য দক্ষিণ আফ্রিকা, ইজরায়েলের মতো দেশগুলি। বাস্তবে কি তা সত্যিই ঘটে। ২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সময় অবিলম্বে যুদ্ধ থামানোর নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। তবে সেই নির্দেশের বাস্তবায়ন হয়নি। আর যদি আন্তর্জাতিক আদালতে প্রমাণও হয়ে যায় ইজরায়েল গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে, তার পরেও সেই মামলায় চূড়ান্ত রায় সামনে আসতে আসতে আরও কয়েক বছর। ততদিনে কি গাজার মানচিত্রে অস্তিত্বটুকুও থাকবে! সংশয়ে গোটা বিশ্ব।

More Articles