ইডি তাড়াতেই ৩২০ কোটি! লোকসান সত্ত্বেও কেন বিপুল টাকা অনুদান কেভেন্টার গ্রুপের?

Electoral Bond: এসবিআইয়ের দেওয়া তথ্য দেখা গিয়েছে, কেভেন্টার গ্রুপের চারটি সংস্থা মিলে মোট ৬১৬ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিকে। যা ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্য়মে প্রাপ্ত মোট অর্থের প্রায় অর্ধেক।

বিজেপি সরকারের ইলেক্টোরাল বন্ড দুর্নীতি সামনে এসেছে ভোটের ঠিক আগে আগেই। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সপ্তাহ দুয়েক আগেই ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত সমস্ত নথি হলফনামা-সহ প্রকাশ্যে এনেছে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া। এখনও তা জ্বলজ্বল করছে ইলেকশন কমিশনের ওয়েবসাইটে। কোন কোন সংস্থা বা ব্যক্তি কোন রাজনৈতিক দলকে অনুদান দিয়েছে, সেই তথ্যও সামনে এসেছে। ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে বিজেপি। তার পরেই তালিকায় রয়েছে তৃণমূল এবং তার পরে কংগ্রেস। আরও ছোট-বড় অজস্র দল রয়েছে, যারা ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে অনুদান পেয়েছে। এসবিআই প্রদত্ত তথ্য থেকে দেখা গিয়েছে, প্রায় সব ছোটবড় সংস্থা থেকেই আর্থিক সাহায্য় পেয়েছে বিজেপি। কলকাতার সংস্থা কেভেন্টার গ্রুপের কাছ থেকে প্রায় ৩২০ কোটি টাকারও বেশি আর্থিক অনুদান পেয়েছে বিজেপি। যা তাদের মোট অনুদানের অর্ধেক।

মূলত দুগ্ধজাত ও প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্যের জন্যই বিখ্য়াত এই কেভেন্টার গ্রুপটি। মজার কথা, ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে কেভেন্টার ফুডপার্ক ইনফ্রা প্রাইভেট লিমিটেড, মদনলাল লিমিটেড এবং এমকেজে এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড- এই তিনটে গ্রুপ মিলে প্রায় ৫০০ কোটি টাকারও বেশি অনুদান দিয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা ঢেলেছে কেভেন্টার ফুডপার্ক ইনফ্রা লিমিটেডই। এই তিনটে সংস্থার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে ব্যবসায়ী রাধে শ্যাম খেতানের নাম। কেভেন্টার গ্রুপের রিয়েল এস্টেট শাখা কেভেন্টার রিয়েলিটির সিইও পদে রয়েছেন তিনি। আর ঠিক যে সময়ে তারা এই টাকা ঢেলেছে, দেখা গিয়েছে, সেই সময়েই কেভেন্টারের বিরুদ্ধে একটি মামলায় তদন্ত করা শুরু করে এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টোরেট।

আরও পড়ুন: ইলেক্টোরাল বন্ডের গোপন কোড কেন সংগ্রহ করেছিল SBI?

২০১৭ সাল নাগাদ মেট্রো ডেয়ারি নামে দুগ্ধ ফার্মের ৪৭ শতাংশ কেভেন্টার গ্রুপেরই একটি শাখা সংস্থা কেভেন্টার এগ্রোর কাছে ৮৫.৫ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এর পরেই কেভেন্টার গ্রুপ সিঙ্গাপুরের একটি প্রাইভেট ইকুইটি ফার্মের কাছে তার প্রায় ১৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে ১৭০ কোটি টাকায়। বিষয়টি নিয়ে বেশ বিতর্ক তৈরি হয়। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কম মূল্যে ওই গ্রুপের কাছে দুগ্ধফার্মটির শেয়ার বিক্রি করার অভিযোগ এনে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন কংগ্রেস নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী। ২০১৮ সালে এই নিয়ে জনস্বার্থ মামলাও দায়ের করেন তিনি। যার তদন্তভার যায় ইডি-র হাতে।

রাজ্য সরকারে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ আধিকারিককে জিজ্ঞাসাবাদও করে ইডি। কেন সরকার সংস্থাটির শেয়ার অর্ধেক দামে বেচে দিল কেভেন্টার গ্রুপের কাছে, বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সেটা ২০১৯ সালের কথা। ২০২২ সাল নাগাদ হঠাৎ করেই মামলাটি খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট।

এসবিআইয়ের দেওয়া তথ্য দেখা গিয়েছে, কেভেন্টার গ্রুপের চারটি সংস্থা মিলে মোট ৬১৬ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিকে। যা ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্য়মে প্রাপ্ত মোট অর্থের প্রায় অর্ধেক। যার থেকে প্রায় ৩২০ কোটি টাকা গিয়েছে বিজেপির কাছে। এসবিআই-তথ্য বলছে, সেই টাকা এসেছে ২০২০ সালে। যখন কেভেন্টার মামলা নিয়ে ইডি-র তদন্ত তুঙ্গে। আর তার পরে ২০২২ সালে মামলাটি খারিজই করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট।

 

সব মিলিয়ে কেভেন্টার গ্রুপ থেকে ৩৫১.৯২ কোটি টাকা আর্থিক অনুদান পেয়েছে বিজেপি। কিছুদিন আগেই ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত সমস্ত নথি সামনে এনেছে এসবিআই। সামনে এসেছে ইলেক্টোরাল বন্ডের উপর গোপনে রাখা ওই ইউনিক আলফা নিউম্যারিক নম্বরও। যা খালি চোখে দেখা যায় না। বিজেপি সরকার অবশ্য বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, ওই নম্বর ইলেক্টোরাল বন্ডে রাখা হয়েছিল শুধুমাত্র নিরাপত্তার খাতিরেই। ওর সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের কোনও সম্পর্ক নেই। তবে বেশিদিন লাগেনি বিজেপি সরকারের সেই মিথ্যা ধরা পড়তে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে শেষপর্যন্ত সেই কোডের নথি সামনে আনতে বাধ্য হয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক। জানা গিয়েছে ওই কোডই একমাত্র লিঙ্ক বন্ডের ক্রেতা ও বন্ড থেকে পাওয়া অনুদান গ্রহণকারীর মধ্যে। ওই নম্বরই স্পষ্ট করে দিয়েছে, কোন কোন রাজনৈতিক দল কোন কোন ব্যবসায়ী বা সংস্থার থেকে অনুদান পেয়েছে।

দেখা গিয়েছে, ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে কেভেন্টার গ্রুপের চারটি সংস্থা যে অনুদান দিয়েছে, সেই প্রতিটি অনুদানই এসেছে একটি রেজিস্টারড ঠিকানা থেকে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এই কেভেন্টার গ্রুপের সংস্থাগুলির সেই আর্থিক সামর্থ কি আদৌ ছিল রাজনৈতিক দলকে আর্থিক সাহায্য করার মতো। দেখা যাচ্ছে, ২০১৯-২০ সালে কেভেন্টার ফুডপার্ক ইনফ্রা লিমিটেড প্রায় ১৯৫ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। যেখানে ওই বছর তারা লাভ করেছে মাত্র ১২.৪ লক্ষ টাকা। বিজেপি তার মধ্যে পেয়েছে ১৪৪.৫ কোটি টাকা, ২০ কোটি পেয়েছে তৃণমূল, ২০ কোটি পেয়েছে কংগ্রেস এবং ৫০ কোটি টাকা পেয়েছে শিরোমণি আকালি দল।

কিন্তু মজার ব্যাপার ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে অনুদান দেওয়ার জন্য আগে যে নিয়ম ছিল, তার ভিত্তিতে অনুদান দেওয়ার অনুমতিই পায় না কেভেন্টার গ্রুপ। আগে নিয়ম ছিল, গত তিন বছরের কোনও সংস্থার লাভের সাড়ে ৭ শতাংশ অনুদান হিসেবে দেওয়া যাবে বন্ডের মাধ্যমে। কেভেন্টার ফুডপার্ক ইনফ্রা সেই সময় অন্তত ৫ লক্ষ টাকা লোকসান করে। তবে বিজেপি পরবর্তীকালে সেই নিয়মের বেড়াজাল সরিয়ে দেওয়ায় সুযোগ পায় এই সব সংস্থাগুলি। এমন সব সংস্থাও রাজনৈতিক অনুদান দিয়েছে বন্ডের মাধ্যমে যাদের আয় শূন্য। শুধু ফুডপার্ক ইনফ্রাই নয়, কেভেন্টারের অন্য আরেকটি সংস্থা মদনলাল লিমিটেড ২০২০ অর্থবর্ষে ১৮৫.৫ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। যার ১৭৫ কোটি টাকা গিয়েছে বিজেপির কাছে। তৃণমূল পেয়েছে ১০ কোটি। অথচ সে বছর সংস্থার লাভ ছিল মাত্র ৫.১৮ কোটি। তিন বছরের হিসেবে আড়াই কোটি টাকার কাছাকাছি লোকসানে চলছিল সংস্থাটি। হিসেব মতো অনুদান দেওয়ার যোগ্য ছিল না এই সংস্থাটিও।

আরও পড়ুন:নির্বাচনী বন্ডের চেয়েও ভয়াবহ! ১২০০০ কোটি টাকার দুর্নীতি PM CARES ফান্ডে?

কেভেন্টারের শাখা সংস্থা এমকেজে এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে দিয়েছে ১৯২,৪২ তোটি টাকা। যার মধ্যে ৯১.৫ কোটি গিয়েছে কংগ্রেসের কাছে, ৪৫.৯ কোটি এসেছে তৃণমূল কংগ্রেসের কোষাগারে, বিজেপি পেয়েছে ২৬.৯২ কোটি এবং বাকিটা পেয়েছে বিজেডি. আপ এবং জেএমএম। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে প্রায় ১৪.৪২ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে তারা, যেখানে নিয়ম অনুযায়ী, তাদের দেওয়ার ক্ষমতা ছিল ২৬ লাখ।

কেভেন্টার গ্রুপের চতুর্থ সংস্থা সাসমল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ২০২৪ অর্থবর্ষে ৩৯ কোটি টাকা দিয়েছে কংগ্রেসকে, বিজেপি পেয়েছে ৫ কোটি। এদিকে গত তিনবছরে তাদের লোকসানের অঙ্ক প্রায় ৪৩.৩ লক্ষ টাকা। তা সত্ত্বেও কর্পোরেট অনুদানে ফুলে ফেঁপে উঠেছে রাজনৈতিক দলগুলি। কোটি কোটি টাকা ঢুকেছে তাদের ফান্ডে। কীসের বিনিময়ে সেই সমস্ত অনুদান ঢুকেছে, তা আঁচ করতে পারছে মানুষ। একদিকে যখন ইডি-সিবিআইকে ব্যবহার করে অবিজেপি রাজ্যগুলিকে নিশানা করা হচ্ছে, সেখানে কীভাবে কেভেন্টার গ্রুপের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ রাতারাতি ধামাচাপা পড়ে যায়, এবং তা কীসের বিনিময়ে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না বিশেষ।

More Articles