'বন্দে মাতরম' বলে উঠলেন পুলিশের গাড়িতে, কেমন ছিল ক্ষুদিরামের জীবনের শেষ কয়েক ঘণ্টা?

Khudiram Bose: গাড়িতে উঠে সে চিৎকার করে বলে উঠেছিল, বন্দে মাতরম। নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় নির্ভীকভাবে দেশের বন্দনা করা এই ছেলেটির নাম ক্ষুদিরাম বসু।

২ মে, ১৯০৮। ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্র স্টেটসম্যানের একটি খবরের অনুবাদ করলে জানা যায় যে, ছেলেটিকে দেখতে রেল স্টেশনে মানুষের ভিড় উপচে পড়েছিল। ছেলেটার বয়স খুব বেশি হলে আঠারো অথবা উনিশ বছর হবে। ছেলেটি ট্রেনের কামরা থেকে বেরিয়ে স্টেশনের বাইরের রাখা পুলিশের গাড়ির দিকে দীপ্ত চিত্তে এগিয়ে গিয়েছিল। গাড়িতে উঠে সে চিৎকার করে বলে উঠেছিল, বন্দে মাতরম। নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় নির্ভীকভাবে দেশের বন্দনা করা এই ছেলেটির নাম ক্ষুদিরাম বসু।

১৮৮৯ সালে ৩ ডিসেম্বর ক্ষুদিরাম বসু জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ বসু এবং লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবীর চতুর্থ সন্তান। ক্ষুদিরামের জন্মের আগেই তাদের দুই পুত্রসন্তান শৈশবে মারা যাওয়ার কারনে প্রথা অনুসারে ক্ষুদিরামের দীর্ঘায়ুর উদ্দেশ্য তাকে তার দিদির কাছে খুদ-এর বিনিময়ে প্রতীকী বিক্রি করা হয়েছিল। এই কারণেই তার নাম হয় ক্ষুদিরাম। হয়তো সেই প্রথা তাকে দীর্ঘায়ু করতে পারেনি, কিন্তু তার কাজের মধ্য দিয়ে তিনি অমর হয়ে গিয়েছেন। ক্ষুদিরামের যখন ছয় বছর বয়স, তখন তাঁর মাকে হারিয়েছিলেন। এক বছরের মধ্যেই তাঁর বাবাকে হারিয়ে অনাথ ক্ষুদিরাম দিদির আশ্রয়লাভ করেছিলেন। ১৯০২ সালে ঋষি অরবিন্দ ঘোষের বক্তৃতা শুনে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদানে আগ্রহী হয়েছিলেন। সেই আগ্রহের ফলস্বরূপ তিনি অনুশীলন সমিতিতে যোগদান করেছিলেন।

ক্ষুদিরামের যখন পনেরো বছর বয়স, তখন তিনি প্রথমবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। তখন তিনি অনুশীলন সমিতির সদস্য। অনুশীলন সমিতির বিভিন্ন চিন্তাধারা সম্বলিত প্যামফ্রেট বিলি করতে গিয়ে তিনি ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়েছিলেন। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার ফলে ভয়ের পরিবর্তে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অনুশীলন সমিতি তখন ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ডকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছিল। তাদের পরিকল্পনামতো হেমচন্দ্র কানুনগোর তৈরি বই-বোমা বিপ্লবী পরেশ মল্লিক কিংসফোর্ডের বাড়িতে দিয়ে এসেছিলেন। যদি কিংসফোর্ড সেই বই সেদিন খুলতেন, তাহলে হয়তো ক্ষুদিরামকে নিজের প্রাপ্য সম্মানের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। কিংসফোর্ড বদলি হয়ে যাওয়ার কারণে সেই বই খুলে দেখার সুযোগ হয়নি। তার ফলে ক্ষুদিরামের কাছে সুযোগ চলে এসেছিল। অনুশীলন সমিতি মুজাফফরপুরে কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। সেইমতো ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকী মুজাফফরপুরে পৌঁছে নাম বদলে একটি ধর্মশালায় থাকতে শুরু করেছিলেন। এই পরিকল্পনার কথা পুলিশ জানতে পেরে গিয়েছিল। কলকাতার পুলিশের তরফে ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকীর নাম এবং পরিকল্পনা মুজাফরপুরে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু মুজাফরপুর থেকে তার মারফত জানানো হয় যে, সেই নামে কেউ সেখানে নেই। আসলে হরেন সরকার এবং দীনেশচন্দ্র রায় ছদ্মনাম পুলিশ জানত না।

আরও পড়ুন: আত্মহত্যা না খুন? স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও রহস্যে মোড়া প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যু

পরিকল্পনা মতো নির্দিষ্ট দিনে সন্ধে নাগাদ ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকী ইউরোপীয় ক্লাবের বাইরে কিংসফোর্ডের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সাড়ে আটটা নাগাদ কিংসফোর্ড তাঁর স্ত্রী, মিসেস কেনেডি এবং মিস কেনেডি ক্লাব থেকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হওয়া মাত্র বিপ্লবীরা বোমা ছুঁড়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, কিংসফোর্ড এবং কেনেডি-রা একই ধরনের গাড়ি ব্যবহার করার কারণে বিপ্লবীরা ভুল করে মিসেস এবং মিস কেনেডির গাড়িতে বোমা মেরেছিলেন। এই ঘটনার পরে ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকী সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সারা রাত প্রায় পঁচিশ মাইল হেঁটে স্টেশনের কাছে পৌঁছে একটি দোকানে জল খেতে চাইলে দোকান উপস্থিত পুলিশদের ক্ষুদিরামের ওপর সন্দেহ হয়েছিল। প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদ এবং পরে ধস্তাধস্তির সময় ক্ষুদিরামের কাছে থাকা একটি বন্দুক মাটিতে পড়ে যায়।

গ্রেফতার করে ক্ষুদিরাম বসুকে পুনরায় মুজাফফরপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে বিচারের পরে তাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ১১ অগাস্ট সকাল ছ'টা নাগাদ ক্ষুদিরাম বসু ফাঁসির দড়িতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ফাঁসির মঞ্চে ওঠার সময় শহিদ ক্ষুদিরাম প্রশ্ন করেছিলেন, "ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন?" বোঝা যায় কৈশোরের গন্ধ তার মন থেকে তখনও যায়নি। বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায় যে, সেইদিন সকাল পাঁচটা থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ হাতে ফুলের মালা নিয়ে এসে সেই এলাকায় জমায়েত করেছিল। ক্ষুদিরাম বসুর শেষ যাত্রায় ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।

নিত্যদিনের ব্যস্ততার এবং ইতিহাস বিস্মৃতির কারণে ক্ষুদিরামের জন্ম বা ফাঁসির কথা ধামাচাপা পড়ে থাকে, নৈমিত্তিক রাজনীতির পাঁকে গুরুত্ব হারায় কিশোরের জেদ। ক্ষুদিরাম বসুর নাম উঠলেই তবু মনে পড়ে, "একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি..।" ক্ষুদিরাম বসু বলেছিলেন, ফিরে আসবেন। তিনি এই দেশকে মনে রাখতে চেয়েছিলেন। আমরা কি তাঁকে মনে রাখি?

More Articles