২০২৩: বর্ষশেষে ফিরে দেখা পাঁচটি বাংলা বই

2023 bengali books: এই বিপন্নতার মধ্যেও কারা বলে উঠল, থেমে থাক? লাইমলাইট কেড়ে নিল কোন কোন বই? থ্রিলার-তন্ত্রের ভিড় এড়িয়ে কোন বই পাঠককে ভাবাল? আসুন, চোখ বুলিয়ে নিই আরেকবার।

ছাপা বইয়ের দিন ফুরিয়ে এল। কান পাতলেই শুনতে পাই এই দীর্ঘশ্বাস মেশানো আপ্তবাক্য। কিন্তু এই বিপন্নতার মধ্যেও কারা বলে উঠল, থেমে থাক? লাইমলাইট কেড়ে নিল কোন কোন বই? থ্রিলার-তন্ত্রের ভিড় এড়িয়ে কোন বই পাঠককে ভাবাল? আসুন, চোখ বুলিয়ে নিই আরেকবার।

এখানে ডেরেক বসে আছে

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের বইটি এবছর 'অপূর্ব স্মৃতি পুরস্কার' পেয়েছে। প্রকাশক বৈভাষিক। মুদ্রিত মূল্য ২২৫ টাকা। উপন্যাসটি এক ফিরে আসার কথা বলে। পঁচিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া এক মৃত্যুর সামনা-সামনি আবার দাঁড়াতে চেয়েছিল প্রবুদ্ধ। সে ফিরে এসেছিল পঁচিশ বছর পর, আর দেখেছিল দত্তদের বাড়িটা তার অপেক্ষায় এখনও দাঁড়িয়ে আছে। যেমন অপেক্ষায় আছে পদ্মিনী। আছে বাবলি, ডরোথি, ডেরেক, ঘেন্টু। ঝরে যাওয়া সময়কে ধরার অক্ষম চেষ্টায় সে বুঝেছিল অমীমাংসিত রহস্যদের খুঁড়ে বার করে আনতে গেলে তাকে আবার দাঁড়াতে হবে সেই বিভীষিকার সামনে, যা তাদের জীবন পালটে দিয়েছিল। কিন্তু প্রবুদ্ধর তখন আর ফেরার উপায় ছিল না। কী সেই রহস্য, কী সেই অতীত─জানতে গেলে পড়ে দেখতেই হবে বইটি। শাক্যজিৎ-এর বলিষ্ঠ কলম ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে বাংলা সাহিত্য জগতে। এই কাজটি আরও সম্মৃদ্ধ করল বাংলা সাহিত্যকে।

সিটি বুলেটিন

স্বপন পাণ্ডা সাহিত্য জগতে নবীন নন। অথচ তাঁর প্রতিটি কাজ চিরনবীন ও মৌলিক। এর আগে তাঁর 'নবপর্যায় গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' হইচই ফেলে দিয়েছিল বাংলা সাহিত্য জগতে। 'নবতাত্ত্বিকের নভেল কিংবা অনিশ্চয়তার নববার্তা' প্রবন্ধে দেবেশ রায় সে উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন─

উপন্যাস আকার নিরপেক্ষ। উপন্যাসের চেহারা দেখলেই তাকে উপন্যাস বলে চেনা যায় না। প্রত্যেকটা উপন্যাসই হয়ে উঠতে চায় একক ও অদ্বিতীয়। ... স্বপন পাণ্ডা 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' পুনর্নির্মাণ করেছেন, ‘নবপর্যায়' শব্দটি যোগ করে। উপন্যাসে এমন কাজ হয়নি। ... স্বপন পাণ্ডা এক পুরনো কীর্তি পুনর্নিমাণ করে উনিশ শতক-একুশ শতক গ্রামীণ ব্যবস্থার সমীকরণের আভাসের মধ্যে একুশ শতকের উপন্যাস লিখেছেন।

অথচ প্রাপ্য খ্যাতি পাননি এই লেখক। এ বছর তাঁর আরেকটি অনবদ্য কাজ নিয়ে হাজির কেতাব-ই। 'সিটি বুলেটিন'। মুদ্রিত মূল্য ২৭৫ টাকা। বইয়ের মোড়ক বলছে, “একে আখ্যানের কাহিনী হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা উপন্যাসই। হয়ত প্রথাগত মস্তিষ্ক একে ছাড়া ছাড়া গল্পের একত্রীকরন হিসেবেই ভাবতে পারবে কেবল; অন্তর্নিহিত পাঠ পারঙ্গম মাথাকে বোঝাতে সক্ষম হবে এ উপন্যাসের বর্ম, মর্ম এবং ধর্ম। খোলসের পর খোলস ছাড়ালে পৌঁছনো যাবে উপন্যাসের নতুন সংজ্ঞায়, বা, তত-নতুন-নয় গাথাকল্পে।" পাঠকের কাছে পৌঁছনো প্রয়োজন এমন একটি বই। নইলে দেবেশের অভিযোগই ফলবে অক্ষরে অক্ষরে, “একটাই অসুবিধে। তিনি বাঙালি ও দৃশ্যমান। তাই এতটা মৌলিকতার স্বীকৃতি তাঁকে দেওয়া আমাদের অভ্যাসের বাইরে।"

book

আরও পড়ুন: ২০২৩ বর্ষশেষের সেরা ভারতীয় সিনেমা, এখনও দেখেননি?

যাঁদের দেখেছি

প্রকাশক রাবণ। মুদ্রিত মূল্য ১২৫০ টাকা। সাতশো পৃষ্ঠার এই সুমুদ্রিত হার্ডবাউণ্ড বইটির লেখক হেমেন্দ্রকুমার রায়। হ্যাঁ, 'যখের ধন' বা জয়ন্ত-মানিকের সৃষ্টিকর্তা হেমেন রায়ই। তবে একদম ভিন্ন মেজাজে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করেছেন লেখক। প্রয়াণের ন-মাস আগে সুধীররঞ্জন মুখোপাধ্যায়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ হেমেন রায় খুব আক্ষেপ করেছিলেন। বলেছিলেন,

“ইচ্ছে মতো লিখতে পারলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু আমি যা চাই তা লিখতে পারি না। আমি আর্টের ওপর প্রবন্ধ লিখতে চাই। ওরা বলে গল্প লিখতে। শুধু গল্প হলে হবে না, ডিটেকটিভ গল্প হওয়া চাই। এমন ফরমায়েশ মতো কি লেখা চলে! আমার ভালো লাগে না।"

হয়তো তাই একেবারে অন্য এক হেমেন্দ্রকুমারকে আবিষ্কার করি আমরা তাঁর এই মুক্তির নিঃশ্বাসে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ থেকে কুস্তিগীর গোবর গুহ বা শচীন দেববর্মণ─যাঁদের সংস্পর্শে এসেছেন জীবৎকালে, তাঁদের নিয়েই ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ। সমসাময়িক পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেই সব লেখা পরবর্তীতে দুমলাটে বন্দি হলেও, এমন অখণ্ড সংস্করণ ছিল না। 'যাঁদের দেখেছি' দু'খণ্ড, ‘এখন যাঁদের দেখছি' এবং বহু অপ্রকাশিত রচনা জায়গা পেয়েছে এই রাবণের বইটিতে।

book

প্রবীর

ডায়রি আকৃতির এই বইটি বোধশব্দের একটি মৌলিক সংযোজন। প্রবীর দাশগুপ্তের লেখার সংখ্যা অতি অল্প। প্রকাশিত লেখার সংখ্যা আরও কম। তাঁর অকাল মৃত্যুর পরে একরকম অবহেলিতই পড়েছিল সেইসব ধুলোমলিন মণিমুক্তো। বইটির মোড়কে লেখা,

“মৃত্যু যে-বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়, ঢেকে রাখতে চায় অসহায়তার সূচে বোনা কারুণ্যের ভারী চাদরে─খুব নির্লিপ্ত মুখে সেই চাদরটি বাতাসে ভাসিয়ে দিতে পেরেছেন তিনি। মহাপুরুষ না হয়েও মৃত্যুর বিপ্রতীপে জীবনকে জিতিয়ে দিয়েছেন। প্রবীর দাশগুপ্ত।"

একদিকে প্রবীরের ডায়েরি তুলে ধরে বইটি। অন্যদিকে ছাপার অক্ষরে কবিতা। বইটির মুদ্রিত মূল্য ৭৫০ টাকা। প্রচ্ছদেও সেই পুরনো পাসপোর্ট সাইজ সাদাকালো ছবি। মলিন ছবি। মলিন খাতার মলাট। এই বইয়ের নির্মাণ বিষয়বস্তুকে এতটাই প্রতিফলিত করে পদে পদে, যে কেবল নির্মাণের জন্যই আলাদা একটি ধন্যবাদ প্রাপ্য বোধশব্দের। বইটি তার যাবতীয় উপাদানসহ বাংলা সাহিত্য জগতকে সম্মৃদ্ধ করেছে।

book

আনন্দধারা

সাদিক হোসেন বাংলা পাঠকদের কাছে পরচিত নাম। বাস্তবকে বিন্দুমাত্র নরম না করে, কাঁচা রক্তমাংস সহ তুলে আনা তাঁর লেখার বৈশিষ্ট্য। মান্দাস প্রকাশিত তাঁর এই বইটির মুদ্রিত মূল্য ২৭০ টাকা। বইটি 'সোমেন চন্দ পুরস্কার' পেয়েছে। 'কাঁথা’, 'আনন্দধারা’, 'কাটারা যেভাবে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ নাগরিকে পরিণত হল'─এইসব গল্পশরীর পাঠকের সামনে নিজেকে উলঙ্গ করে। তুলে ধরে শরীরের যাবতীয় ঘা, পুঁজ, রক্ত। পাঠক দেখে তার উলটো দিকে গল্প নয়, যাবতীয় ক্ষত শরীরে ধারণ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারই প্রতিফলন। সেই অস্বস্তি, বিপন্নতা, নিজের 'অতি স্বাভাবিক' গুলিকে ঘেন্না করতে শেখায়, শেখায় প্রশ্নের মুখে ফেলে ছিন্নভিন্ন করতে। ইনস্ক্রিপ্টে বইটির আলোচনা করতে গিয়ে মধুরিমা দত্ত লিখেছিলেন, “চয়েসের গোড়ায় গিয়ে, ফুল-মধু-চাঁদের ঘাড় ধরে কেউ কেউ গণকবরের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন, অথবা হাঁটিয়ে দেন ভাঙা আয়নার পথে।" সাদিক হোসেন এযুগের গল্পকার। মুসলমানবিদ্বেষের চূড়ার উপর বসে যখন বাদামের খোলা ছাড়িয়ে খোশগল্পে মত্ত 'আদর্শ নাগরিক', রাষ্ট্রপ্রেমের থকথকে গাঢ় লালের থেকে উঠে আসছে জ্যান্ত পুড়ে যাওয়ার আর্তনাদ─এসব এড়িয়ে তিনি লিখবেন কী করে? তাঁর লেখায় অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে আজকের চরমপন্থী রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির, গোষ্ঠীর অবিরত দ্বন্দ্ব উঠে আসে। পাঠক খেয়াল করেন তাঁর ঘা-ঢাকা জামার রঙ সাদা। তাতে লাল-কষ ছোপ ফেলতে শুরু করেছে।

anandadhara

More Articles