২০২৩ বর্ষশেষের সেরা ভারতীয় সিনেমা, এখনও দেখেননি?

Best Indian Movies: ওটিটি থেকে সিঙ্গল স্ক্রিন, মাল্টিপ্লেক্স-বদলাচ্ছে ছবির ধরণ। বদলাচ্ছে ছবির বিষয়বস্তু, বক্তব্য। ছবির জগতে কী কী মণিমুক্তো এবার জমল ভারতের ঝুলিতে? আসুন, বছরের শেষে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

শেষ হতে চলেছে ২০২৩। নতুন বছরের অপেক্ষায় দিন গুনছে সবাই। এমন শীতের দিন উদাসীনতা বয়ে আনে। মানুষের মনে হয় আরেকটা বছর মুছে গেল জীবন থেকে। অভিজ্ঞতার বদলে সময়ের চেনা বিনিময়। তখন, কী কী পাওয়া গেল, সে হিসেবের দিকে চোখ যায়। ফিরে দেখে মানুষ। তার যাবতীয় সঞ্চয় ঠিক কতটা মূল্যবান? মাপতে চায় কালের দাঁড়িপাল্লায়। অর্থনীতি, রাজনীতি, খেলাধুলো, বাজারদর, পাশের পাড়ায় অমুকের মৃত্যু, বাড়ির পিছনের দেওয়াল—এত কিছু বদলে গেল। বদলে গেল গোটা দেশদুনিয়াটাই। সেই বদলানো দেশ-দুনিয়ার মাঝে সিনেমারও উজ্জ্বল উপস্থিতি। করোনাকালের খরার পর বিশ্বজোড়া ছবির দুনিয়ায় নতুন জোয়ার এসেছে। ওটিটি থেকে সিঙ্গল স্ক্রিন, মাল্টিপ্লেক্স-বদলাচ্ছে ছবির ধরণ। বদলাচ্ছে ছবির বিষয়বস্তু, বক্তব্য। ছবির জগতে কী কী মণিমুক্তো এবার জমল ভারতের ঝুলিতে? আসুন, বছরের শেষে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

আরও পড়ুন: অ্যানিমাল: এমন জান্তব সিনেমা কি শুধুই বিনোদন? কাদের জন্য?

জোরাম

দেবাশীষ মাখিজা পরিচালিত এই ছবিটি ইতিমধ্যে জিতে নিয়েছে অনেকগুলি আন্তর্জাতিক খেতাব। প্রশংসিত হয়েছে প্রায় সর্বত্র। কিন্তু ভারতে খুব বেশি হলে মুক্তি পায়নি ছবিটি। 'অ্যানিম্যাল' ঝড়ে মানুষও দেখেননি খুব একটা। ভারতীয় ছবির জগতে অন্যতম সংযোজন এই ছবি। ছবির মূলে দুই ব্যক্তি। আদিবাসী 'দশরু' এবং পুলিশ 'রত্নাকর'। ঝাড়খণ্ডের জঙ্গল থেকে উৎখাত হয়ে মুম্বইয়ে এসে আশ্রয় নেয় দশরু এবং তার স্ত্রী। 'প্রগতি নগর'-এর অত্যচার, এবং নকশালদের প্রতিরোধ-এই দুইয়ের মাঝে একটি খুনের মামলায় ফেঁসে গিয়েছিল সে। ফলে ঝাড়খাণ্ডের জঙ্গল থেকে তাকে বাধ্যত পালিয়ে আসতে হয় মুম্বইয়ের ইট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়না। সেখানেও তাকে চিনে ফেলে একজন। ফের পালিয়ে ঝাড়খণ্ডে আসে দশরু। সঙ্গে তার নবজাতক। তাকে ধাওয়া করে রত্নাকরও পৌঁছয় সেখানে। কিন্তু অবাক হয়ে দশরু দেখে সে নিজের গ্রামের কিছুই প্রায় চিনতে পারছে না। দুজন মানুষের মানসিক অবস্থার যে টানাপোড়েন, তার মধ্যে বারবার ঢুকে পড়ে প্রেক্ষাপট, তার যাবতীয় রাজনীতি নিয়ে। বিভিন্ন মোড়ে বিস্ময় ওঁৎ পেতে থাকে দুজনের জন্যেই। ছবিটিকে মাখিজার সেরা কাজ বলে মনে করছেন সমালোচকেরা। মনোজ বাজপেয়ী যে কী মাপের অভিনেতা, তা তিনি আরেকবার বুঝিয়ে দিলেন। এর আগেও মাখিজার 'আজ্জি' এবং 'ভোঁসলে' সাড়া ফেলেছিল দর্শকদের মধ্যে। এবার 'জোরাম'-এও ফের ক্ষমতার অমানবিকতার প্রতি আঙুল তুললেন দেবাশীষ।

মনোজ বাজপেয়ী

'দশরু' চরিত্রে মনোজ বাজপেয়ী

আরও পড়ুন: জ্বলছে মণিপুর, মরছে মানুষ! আর সিনেমাহলে দেখানো হচ্ছে ‘উড়ি; দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’?

অল দ্যট ব্রিদস্‌

শৌনক সিন্‌হার এই তথ্যচিত্রটি তথ্যচিত্র সম্বন্ধে মানুষের ধারণা ওলটপালট করে দিয়েছে। দুই ভাইয়ের জীবন তুলে এনেছেন পরিচালক। সউদ এবং নাদিম। এবং তাদের বন্ধু সালিক। দিল্লির ক্রমবর্ধমান দূষণ জন্তু জানোয়ারদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। তারই মাঝে এই তিনজন আহত চিলদের উদ্ধার করে ঘরে নিয়ে আসে। সেবায় পাখিগুলিকে সুস্থ করে তোলাই তাদের উদ্দেশ্য। ৯০ মিনিট পর্দা ছেড়ে উঠতে পারবেন না দর্শক। পাখি উদ্ধারের জগতে যে নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছে সউদ, নাদিম এবং সালিকের কাজ, তারই খানিক চিত্রণ দেখা যায় এই তথ্যচিত্রে। অবিশ্বাস্য বয়ানে গাঁথা সমস্ত ছবি। এরই মধ্যে এনআরসি বিরোধী আন্দোলন উঠে আসে, উঠে আসে ২০২০-র সাম্প্রদায়িক হানাহানিও। অদ্ভুতভাবে মূল বয়ানের বাইরের এই বয়ানগুলিকেও আত্মস্থ করে ফেলে ছবিটি। ২০২৩-এ ভারতীয় সিনেমার তালিকায় তথা বিশ্বসিনেমার তালিকায় এটি অসামান্য সংযোজন।

তথ্যচিত্র

আরও পড়ুন: সত্যিই কি ওপেনহাইমার শতাব্দীর সেরা সিনেমা? নাকি…

কস্তুরী

এই ছবির মূল চরিত্র গোপি। একটি তেরো বছরের দলিত কিশোর। সে পড়াশোনায় ভালো। কিন্তু পেটের দায়ে তাকে ময়লা থেকে মলমূত্র পরিষ্কারের কাজ করতে হয়। সেই গন্ধ গায়ে নিয়ে সে যখন স্কুলে যায়, তার বন্ধুবান্ধব তাকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে, নাকে রুমাল বাঁধে। গোপির কান্না পায়। তার প্রিয় বন্ধু আদিমের সঙ্গে সে খোঁজ শুরু করে কস্তুরীর। সে শুনেছে কস্তুরী মৃগের নাভি থেকে যে কস্তুরী তৈরি হয়, সেই গন্ধে নাকি সমস্ত দুর্গন্ধ কেটে যায়। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয় তাদের। শেষে সে বুঝতে পারে, কস্তুরী নয়, তার এই যাবতীয় দুরবস্থা দূর করতে পারে কেবল শিক্ষাই। এটি বিনোদ কাম্বলের প্রথম ছবি। অনুরাগ কাশ্যপ এবং নাগরাজ মঞ্জুলে এই ছবির প্রযোজক। শুরুতেই পরিচালক বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া। অত্যন্ত শক্তিশালী এই পরিচালক ভারতীয় সিনেমার পরিসর উজ্জ্বল করবেন।

কস্তুরী পোস্টার

আরও পড়ুন: বগল বাজাতে বাজাতে তাঁর ছবি দেখা যায় না! গোদারের সিনেমা কেন দেখবে মানুষ?

গোল্ডফিশ

পুশন কৃপালানির 'গোল্ডফিশ' এ বছরের তালিকায় অন্যতম একটি সংযোজন। কলকি কেকলাঁ এই ছবিতে একজন ইঙ্গ-ভারতীয় যুবতীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তার নাম অনামিকা। সে বহুদিন পরে লন্ডনে ফেরে। লন্ডনের বাড়িতে একা থাকেন তার মা। মায়ের ডিমেনশিয়া। বিস্মৃতির পরতে পরতে জুড়ে যেতে থাকে স্মৃতি। কী তারা পেয়েছেন কী হারিয়েছে! মা ও মেয়ের সম্পর্ক, তাদের অনন্য বোঝাপড়া ছবির মূল বিষয়বস্তু। 'গোল্ডফিশ' এমন একটি প্রেক্ষাপট তুলে ধরে, যে প্রেক্ষাপট নিয়ে ভারতীয় সিনেমা প্রায় নীরব। কাজেই বিষয়বস্তুর দিক থেকেও ছবিটি অভিনব।

গোল্ডফিশ পোস্টার

আরও পড়ুন: দেশের প্রথম মহিলা সিনেমাওয়ালা, স্পর্ধার নাম ফতমা বেগম

কাঠাল

যশোধরণ মিশ্র-র 'কাঠাল' আদতে প্রহসন। হাস্যরসের আড়ালে ভারতের জাতিবিদ্বেষ থেকে রাজনৈতিক নেতাদের অপদার্থতার মতো বিষয় অত্যন্ত সাবলীল ভাবে তুলে ধরেছেন পরিচালক। কাহিনীর শুরুতে এক মন্ত্রীর ঘর থেকে চুরি যায় দুই খানা কাঁঠাল। তার খোঁজে পুলিশ তোলপাড় করে ফেরে গোটা অঞ্চল। এরই মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যায় জাতিবিদ্বেষ। উঠে আসে সাংবাদিকদের বাক-স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার ব্যাখ্যান। অবশেষে কাঁঠাল রহস্যের কিনারা হয়। একাধারে গোয়েন্দা গল্প ও প্রহসনের প্রকরণকে স্বাভাবিক ছন্দে মিশিয়ে দিয়েছেন পরিচালক। ২০২৩-এর তালিকা এই সিনেমার উল্লেখ ছাড়া অপূর্ণ থেকে যেত।

কাঠাল পোস্টার

আরও পড়ুন: উত্তম কুমার: ফিরে পড়া এক সিনেমাজীবন

ভিড়

এ বছরে অনুভব সিনহার যে কাজটির উল্লেখ না করলেই নয়, তা নেটফ্লিক্সের 'ভিড়'। করোনাকালে লাখে লাখে যে পরিযায়ী শ্রমিকেরা বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করেছিলেন, তাঁদের কেউ ট্রেনে কাটা পড়েছেন ঘুমন্ত অবস্থায়, কেউ পথেই আত্মীয় হারিয়েছেন, খিদেয় তেষ্টায় মারা গিয়েছেন অনেকে, আবার কাউকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে নগ্ন করে ক্লোরিন জল দিয়ে 'স্বচ্ছ' করেছে সরকার। 'ভিড়' এঁদেরই গল্প। ঘর থেকে বেরিয়ে ছিলাম, ঘর থেকেই আসছি, যাবও তো সেই ঘরেই। 'ঘর'-এর ধারণাকে যেভাবে বিপন্ন করে এই উক্তি, সেই বিপন্নতাই এই ছবির সম্পদ। অফিসার সূর্য কুমার সিং-এর চোখ দিয়ে যাচাই করে নেওয়া করোনাকালীন সেই সময়, মানবতার সেই অপমান। ছবির আরেকটি সম্পদ এর অভিনেতা সমূহ। রাজকুমার রাও, ভূমি পেডনেকার, আশুতোষ রানা, পঙ্কজ কাপুরসহ বিভিন্ন দক্ষ অভিনেতাদের অভিনয়ে সম্মৃদ্ধ ছবিটি।

ভিড় পোস্টার

More Articles