যুদ্ধের বাজারে জ্বালানি অমিল! মাটির সাবেক উনুনে ফুটে ওঠে ভাতই ভরসা এখন বিধ্বস্ত গাজায়

Israel-Palestine conflict: সময় যে ভালো নয়, তা বেশ বুঝতে পারেন আকরা। তাই মানুষের দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে উনুনের দামে নয়ছয় করেন না। পুরনো দামেই উনুন বিক্রি করছেন এখনও।

পোড়া কাঠে সদ্য সেঁকা রুটির গন্ধ। অভুক্ত বা অর্ধভুক্তের কাছে এ যেন স্বপ্নের মতো। তবে সেই রোম্যান্টিসিজমের জায়গা নেই আর বেঁচে নেই গাজা স্ট্রিপে। একটা-দুটো রুটি, একটু অর্ধসিদ্ধ তরকারি, ন্যূনতম এইটুকু জোগার করাটাই এখন কঠিন গাজায়। কারণ সব দিক থেকে গাজাকে অন্নে, ভাতে এবং হাতে মেরে রেখেছে ইজরায়েল। ৪৫ দিনের লাগাতার যুদ্ধে খাবারের মজুতে টান পড়েছে। জল নেই, ওষুধ নেই। এমনকী প্রয়োজনীয় জ্বালানিটুকুও নেই এখন গাজায়। তবু তো বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ন্যূনতম রুটিটুকু তো লাগে। তার জন্যই এখন মাটির উনুনের দিকে ঝুঁকছে গাজা। ক্রমশ রমরমা বাড়ছে মাটির উনুনের।

মাটির উনুনে করা রান্নার স্বাদই আলাদা। তা ছোট থেকেই শুনেছেন গাজার মানুষজন। তবে সেই স্বাদ যে এই পরিস্থিতিতে জিভে উঠে আসবে, তা কি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তারা। তবে আজ এই যুদ্ধপরিস্থিতিতে সেটাই একমাত্র ভরসা গাজার।

আরও পড়ুন: ওষুধের জোগান নেই, নামছে হাসপাতালে ঝাঁপ! জর্ডনের ফিল্ড হাসপাতাল বাঁচাবে গাজাকে?

৫৩ বছরের ইনশিরাহ সালেম আল আকরা এই যুদ্ধভূমিতে বসে একমনে তাই বানিয়ে যাচ্ছেন মাটির উনুন। হ্যাঁ, গ্যাস বা সিলিন্ডার আসার আগে ঠিক যেমন মাটির উনুনে রান্না করতেন মানুষ। নরম মাটি, কাদা, পশুর গোবর ও খড় দিয়ে মণ্ড তৈকি করে হাত দিয়ে মেখে মেখে তৈরি করে ফেলতে হবে একদম উনুনের আকারের। এর পর তাকে রোদে শুরিয়ে ফেলার পালা। আর শুকিয়ে গেলেই তৈরি মাটির উনুন। আর এই কাজটিই গাজাবাসীর জন্য মন দিয়ে করে চলছেন ইনশিরাহ।

As people run out of fuel in Gaza, clay ovens are back in demand

গত ৪৫ দিন ধরে গাজায় একের পর এক হামলা চালিয়ে গিয়েছে ইজরায়েল। একের পর এক হাসপাতাল, একের পর এক শরণার্থী শিবিরকে নিশানা করা হয়েছে। বাস্তুহারা ভিটেহারা স্বজনহারা মানুষ, তবু দিনযাপনের জন্য ন্যূনতম খাবারটুকু তবু প্রয়োজন হয়। যা এখন অমিল গাজায়। তবু মানুষ যুদ্ধ থামান না। বেঁচে থাকার যুদ্ধ। যে যুদ্ধ এই ইজরায়েল-গাজার যুদ্ধের চাইতেও আসলে আরও বড়, আরও কঠিন। গাজায় এখনও পর্যন্ত অন্তত ১৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। জখম তিরিশ হাজারেরও বেশি।

ভয়াবহ এই যুদ্ধ আদতে গাজার শৈশবের উপরে সবচেয়ে বড় একটা প্রশ্নচিহ্ন। তবু যারা বেঁচে গিয়েছে এই যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায়, তাদের জন্য ভরসা এখন মাটির উনুন। জ্বালানিহীন গাজায় শিশুদের মুখে অন্ন তুলে দিতে ওটাই ভরসার জায়গা। জ্বালানি নেই। দীর্ঘদিন ধরেই গাজা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন। কারণ একের পর এক বিদ্যুৎ সরবরাহকারী দফতরগুলিকে উড়িয়ে দিয়েছে ইজরায়েলি সেনা। ফলে সনাতন পদ্ধতির কাছে ফেরা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই গাজায়।

আল-আকরার স্বামী ছিলেন পেশায় মৎস্যজীবী। সেই কাজ করেই চলত সংসার নির্বাহ। তবে গত মালে ইজরায়েলি সেনা তাঁর সাধের নৌকোখানি পুড়িয়ে দেয়। জীবিকাহীন হয়ে পড়ে আল আকরার পরিবার। অগত্যা সংসারের হাত ধরতে হল তাঁকেই। আগেও উনুন বানাতেন আকরা। স্বামীর পাশে দাঁড়াতেন উনুন বানিয়ে। এই যুদ্ধের মধ্যে দাঁড়িয়ে সেটাই হয়ে উঠল আয়ের একমাত্র পথ। গত এক সপ্তাহে অন্তত পাঁচটি মাটির উনুন তৈরি করে বেচেছেন তিনি। আগে যা তৈরি করতে একমাস সময় লাগত, তা এখন ঝড়ের গতিতে বানিয়ে ফেলছেন আকরা। সময়টাই যে বিধ্বস্ত। এ সময় হাতের গতি না বাড়ালেই বা চলবে কেন।

আরও পড়ুন:ওষুধ নেই, কেমোথেরাপি নেই! যেভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে এগোচ্ছেন গাজার ক্যান্সার আক্রান্তরা

সময় যে ভালো নয়, তা বেশ বুঝতে পারেন আকরা। তাই মানুষের দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে উনুনের দামে নয়ছয় করেন না। পুরনো দামেই উনুন বিক্রি করছেন এখনও। গাজায় এখন সবচেয়ে ছোট্ট উনুনটির দাম ৪০ শেকেল, যা ২১ ডলারের কাছাকাছি। আর সবচেয়ে বড় উনুনটি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ শেকেলে। যা ৪০ ডলারের সমান। আপাতত যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার মানুষের মুখে দুটো অন্ন তুলে দিচ্ছে সেকেলে সেই উনুন। একটু গাছের ডাল, শুকিয়ে যাওয়া লকরি, যে যেটুকু পারছেন, উনুনের মুখে ঢেলে দিয়ে ফুটিয়ে নিচ্ছেন খাবারটুকু। তুলে দিচ্ছেন সন্তানের মুখে। বাড়ির মানুষগুলোর মুখে। কথায় বলে, যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। সেদিকেই তাকিয়ে সাবেক জীবনযাপনের দিকে ফিরছে গাজা। উনুনের আঁচে সেঁকে লাল হয়ে উঠছে রুটি, এই আশায় একদিন সকাল হবে। গোলাবারুদহীন সুন্দর এক সকাল, যেখানে ইজরায়েলি বাহিনীর চোখরাঙানি থাকবে না, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া শরীর থাকবে না। এমন দিনের দিকে চেয়ে গোটা বিশ্ব।

More Articles