কামদুনি গণধর্ষণে ন্যায়বিচার পেল নির্যাতিতার পরিবার?

Kamduni gang rape and murder: কামদুনি গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রায় দশ বছর পর সেই মামলায় রায় শোনাল কলকাতা হাইকোর্ট। তবে সেই বিচার সন্তুষ্ট করতে পারল নির্যাতিতার পরিবারকে।

কামদুনি, শব্দটার সঙ্গেই যেন আজও জড়িয়ে একটা ভয়, আতঙ্ক আর লজ্জার স্মৃতি। ২০১৩ সালে কামদুনির সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা, যা নাড়িয়ে দিয়েছিল রাজ্য-রাজনীতিকে। প্রায় দশ বছর পর সেই মামলায় রায় শোনাল কলকাতা হাইকোর্ট। তবে সেই বিচার সন্তুষ্ট করতে পারল নির্যাতিতার পরিবারকে। গুরু পাপে লঘু দণ্ড দিয়েই কি রেহাই দিল হাইকোর্ট! মকুব করা হল মৃত্য়ুদণ্ডও। আপাতত সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে শীর্ষ আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে পরিবার।

২০১৩ সালে কলেজ থেকে ফেরার সময়ে তরুণীকে তুলে নিয়ে যায় কয়েকজন দুষ্কৃতি। পরিত্যক্ত একটি কারখানায় নিয়ে গিয়ে চলে অকথ্য অত্যাচার, গণধর্ষণ। ধর্ষণের প্রমাণ লোপাট করতে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল তরুণীর দুই পা। তরুণীর নাভি পর্যন্ত ছিঁড়ে গিয়েছিল। শেষমেশ গলা কেটে খুন করার পর নির্মমভাবে লাশ ফেলে আসা হয় মাঠে। ঘটনার বীভৎসতায় শিউড়ে উঠেছিল গোটা বাংলা। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল কামদুনি। চলে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর। শেষপর্যন্ত নামাতে হয়েছিল আধাসেনা।

কামদুনির সেই ঘটনার প্রথম চার্জশিটে নাম ছিল মোট ৬ জনের। তদন্তভার উঠেছিল সিআইডির হাতে। অভিযুক্ত সন্দেহে গ্রেফতার হয় আনসার আলি, সইফুল আলি, আমিনুর আলি, ভুট্টো মোল্লা, এনামুল মোল্লা, আমিন আলি, গোপাল নস্কর, ভোলানাথ নস্কর। মামলা চলাকালীন মৃত্যু হয় একজনের। সেই ঘটনার প্রাথমিক রায় বেরোতে বেরোতেই কেটে গিয়েছিল ৩ বছর। ২০১৬ সালে ২৯ জানুয়ারি কামদুনি ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের রায় ঘোষণা করেছিল বারাসাত জেলা আদালত। ৩১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণের পর সাজা শোনানো হয় ছ'জনকে। ৩ জনকে যাবজ্জীবন এবং ৩ জনকে ফাঁসির সাজা শোনানো হয়েছিল। বেকসুর খালাস হয়েছিলেন রফিকুল গাজি ও নূর আলি। দোষীরা এই রায়ের বিরোধিতা করে কলকাতা হাইকোর্টে গিয়েছিল দোষীরা।

আরও পড়ুন: কাশ্মীর থেকে মণিপুর, ক্ষমতার হাতিয়ার যখন ‘ধর্ষণ’

সেই কামদুনি মামলায় দশ বছর পর রায় দিল কলকাতা হাইকোর্ট। মামলাটি বিচারাধীন ছিল বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী এবং বিচারপতি অজয়কুমার গুপ্তের ডিভিশন বেঞ্চে। সেখানে নিম্ন আদালতের ফাঁসির সাজা রদ করে সইফুল আলি ও আনসার আলির আমৃত্যু কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আমিন আলি হাইকোর্টের রায়ে বেকসুর খালাস পেয়েছে। একইসঙ্গে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত শেখ ইনামুল ইসলাম, আমিনূর ইসলাম, ভোলানাথ নস্করও ১০ হাজার টাকার বন্ডের বিনিময়ে বেকসুর খালাস পায়।

Calcutta HC sets aside death sentences in 2013 Kamduni gang rape and murder

এমন চরম এবং গুরুতর অপরাধের পরেও কেন ছাড় পেয়ে গেল অপরাধীরা। কেন লঘু শাস্তি দিয়েই দায় ঝাড়ল হাইকোর্ট, প্রশ্ন তুলেছে নির্যাতিতার পরিজনেরা। স্বভাবতই হাইকোর্টের এই রায়ে খুশি নন নির্যাতিতার পরিবার এবং দুই বন্ধু মৌসুমী ও টুম্পা কয়াল। কামদুনির ঘটনার পরে কার্যত প্রতিবাদের মুখ হয়ে উঠেছিলেন ওই দুই কন্যা। রায়ঘোষণার পরেই কান্নায় ভেঙে পড়েন দুই বান্ধবী। মৌসুমী বলে ওঠেন, "টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছে রাজ্য সরকারের উকিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের বিচার দিতে পারলেন না।" এদিন রায়ের পর আদালত চত্বরেই অসুস্থ হয়ে পড়ে মৃতার ভাই। আরেক বান্ধবী টুম্পা জানিয়েছেন, তাঁরা অনেক আশা নিয়ে হাইকোর্টে গিয়েছিলেন। সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দোষীরা শাস্তি পাবেন। তবে তেমন কিছুই হয়নি। হাইকোর্ট থেকে কার্যত খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়েছে কামদুনি নির্যাতিতার পরিবারকে।

Calcutta HC sets aside death sentences in 2013 Kamduni gang rape and murder

এই মামলায় হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ, অভিযুক্তদের অনেকেই সাত থেকে দশ বছর ধরে সংশোধনাগারে রয়েছে। সে কারণেই মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্তদের যাবজ্জীবন ও বাকিদের রেহাই দেওয়া হয়েছে। আর সেই রায় নিয়ে ক্ষুব্ধ নির্যাতিতার স্বজন-বন্ধুবান্ধব। দেশ জুড়ে, রাজ্য জুড়ে যে ভাবে একের পর এক ধর্ষণকাণ্ড ঘটছে, সেখানে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশা করেছিলেন তাঁরা। তবে সেই আশায় জল ঢেলেছে হাইকোর্ট।

আরও পড়ুন: ৩০০ জনেরও বেশি কিশোরীকে ধর্ষণ, খুন! এখনও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই সিরিয়াল কিলার

হাইকোর্টের রায়ে অবশ্য খুশি নয় রাজ্য সরকারও। রাজ্যের তরফে গোটা বিষয়টি দেখছে সিআইডি। ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে বিশেষ একটি দল। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডিআইজি স্তরের এক অফিসার। রায় শোনার পরেই সেই দলের তরফে দুই আধিকারিক মৌসুমীর বাড়িতে আসেন। তবে সেই সাক্ষাৎ নিয়েও ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন মৌসুমী। জানিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের কথা বলতেই বাড়িতে সিআইডির লোক পাঠিয়ে দেওয়া হল। দশ বছর আগে যদি সিআইডি আসত, তাহলে অভিযুক্তরা এভাবে ছাড়া পেত না। সব মিলিয়ে দশ বছর পরেও কামদুনির ঘটনায় সুবিচার তো দূরের, স্বস্তিটুকু পেল না নির্যাতিতার পরিবার। মৌসুমীদের কথায় স্পষ্ট, এই রায়ের পর তাঁদের আস্থা উঠেছে রাজ্য সরকারের থেকে। এর আগেও একাধিক বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরাগভঞ্জন হয়েছেন মৌসুমীরা। এমনকী রাগের বশে মৌসুমীদের একবার 'মাওবাদী' পর্যন্ত বলে বসেছিলেন মমতা। মধ্যিখানে আবার বিজেপি শিবিরে যোগ দেওয়ারও গুঞ্জন উঠেছিল তাঁদের ঘিরে। হাইকোর্টের এই রায় কি সেই দূরত্বকেই স্পষ্ট করল ফের! এমনই একগুচ্ছ প্রশ্ন আপাতত ঘুরছে হাওয়ায়।

More Articles