মায়ের গলা কেটে গীতা পাঠ, ৭৭ পাতার সুইসাইড নোট! বেকার যুবকের সিদ্ধান্তে শিউরে উঠছে দেশ

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, শেষ দু’বছরে বেকারত্বের কারণে আত্মঘাতী হয়েছেন ২৫০০০ এরও বেশি মানুষ।

দুর্গন্ধে টিকতে পারছিলেন না প্রতিবেশীরা, তাই খবর দেন পুলিশে। ঘর খুলে পুলিশ দেখে মেঝেতে পড়ে আছে এক মাঝবয়সী ছেলের মৃতদেহ। বাথরুমে পড়ে ছিল ছেলের মায়ের নিথর পচাগলা শরীর। রবিবার খোদ রাজধানী শহর দিল্লিতে ঘটেছে এমন ঘটনা। পুলিশের কাছে এমন কিছু নতুন নয় এসব দৃশ্য। তবে একটি বিষয় তাক লাগিয়ে দিয়েছে তাবড় পুলিশ আধিকারিকদেরও। রান্নাঘর থেকে ৭৭ পাতার একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করেছে পুলিশ। জানা গিয়েছে, মাকে খুনের তিনদিন পর নিজে আত্মঘাতী হন ওই যুবক। এমন ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে স্বাভাবিকভাবেই হতবাক প্রতিবেশীরা। পুলিশের তরফ থেকে পরিবারটির আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য গ্রহণের কাজ চলছে।

কেন এই সুইসাইড ও খুন?

বেশ কয়েকদিন ধরেই বাড়ির দরজা বন্ধ অথচ উৎকট এক গন্ধ নাকে আসছিল প্রতিবেশীদের। শেষমেশ রবিবার রাতে আর থাকতে না পেরে রাত আটটা নাগাদ পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করে বিষয়টা জানান প্রতিবেশীরা। পুলিশের তদন্তকারী দল পৌঁছে দেখে বাড়ির দরজা ভিতর দিক থেকে বন্ধ। বাড়ির ব্যালকনি দিয়ে ভিতরে ঢুকে পুলিশ কর্মীরা দেখেন রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে রয়েছে বছর ২৫-এর এক যুবক। রান্নাঘর থেকে উদ্ধার হওয়া ৭৭ পাতার সুইসাইড নোট থেকে জানা গিয়েছে মৃত যুবকের নাম ক্ষিতিজ।

শেষ সপ্তাহের বৃহস্পতিবার নিজের অসুস্থ মা মিথিলেশকে প্রথমে শ্বাসরোধ করে খুন করে ক্ষিতিজ। এরপরের দু’দিন মায়ের মৃতদেহ আগলে বসেছিল সে। দুর্গন্ধ রুখতে বারে বারে সারা ঘরে পারফিউম ছড়িয়ে দেয় ক্ষিতিজ। এমনকি মায়ের আত্মার শান্তির জন্য মৃতদেহের সামনে বসে গীতার একটি অধ্যায়ও পাঠ করে সে এবং মৃত মায়ের শরীরে ছিটিয়ে দেয় গঙ্গাজল। এক প্রতিবেশী তাঁর বাড়ি এসে মায়ের খোঁজ করলে ক্ষিতিজ জানায় তিন দিন আগেই তাঁর মা মারা গিয়েছেন এবং সেও নিজেকে শেষ করে ফেলবে। এরপর অন্যান্য প্রতিবেশীদের সবটা জানিয়ে কোনও উত্তর না পাওয়ায় পুলিশকে খবর দেন ওই প্রতিবেশী। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। সুইসাইড নোটে ক্ষিতিজ লিখেছে, বহুদিন ধরে বেকার হওয়ায় অবসাদে ভুগছিল সে। পাশাপাশি মায়ের চিকিৎসার ব্যায়ভার আর টানা সম্ভব হচ্ছিল না তাঁর পক্ষে। ক্ষিতিজের বাবা বেশ কয়েক বছর আগেই মারা গেছেন এবং প্রায় নির্বান্ধব সে। ঘনিষ্ঠ কোনও বন্ধু নেই যার সঙ্গে মনের কথা ভাগ করে নিতে পারা যায়। তাই এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে ক্ষিতিজ। এখানেই শেষ না, মায়ের মৃত্যুর পর থেকে রবিবার দুপুর দু’টো পর্যন্ত যা যা করেছে সে তার বিবরণও রয়েছে সুইসাইড নোটে।

আরও পড়ুন- মুম্বইয়ের জমকে ব্রাত্য আরে অরণ্য, আদিবাসীদের দিন বদলের স্বপ্ন দেখান ক্যাসান্দ্রা

ওই ৭৭ পাতার সুইসাইড নোট থেকে আরও জানা গিয়েছে, ক্ষিতিজের বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী ছিলেন। বাবার পেনশনের টাকাতেই সংসার চলত তাঁদের। মায়ের শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি ক্ষিতিজ নিজেও অসুস্থ ছিল। ফলে পেট চালিয়ে চিকিৎসার খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর পক্ষে। পুলিশের মতে এর পিছনে অন্য কোনও রহস্য নেই। নিজেই নিজের মাকে খুনের কথা এই যুবক স্বীকারও করেছেন সুইসাইড নোটে। তবে মৃতদেহগুলি উদ্ধারের সময় মিথিলেশের শরীর একেবারে পচে গলে গিয়েছিল।

দেশে বেকারদের মৃত্যু

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক দশকে ভারতে বেকারত্বের হার প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে সর্বাধিক। করোনা অতিমারির কারণে এই হার আরও বেড়ে গিয়েছে। শহুরে বেকারত্বের হার বেড়ে ২৭.১ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে যা রীতিমতো ভয়ের। শহরের তুলনায় গ্রামে বেকারত্বের হার আরও বেশি। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, শেষ দু’বছরে বেকারত্বের কারণে আত্মঘাতী হয়েছেন ২৫০০০ এরও বেশি মানুষ। ফলে ভারতের যুবকদের অবস্থা কতখানি সঙ্গিন তা পরিষ্কার। রাজ্যসভার বিরোধীদের একাধিক সদস্য বলেছেন ২০২২ সালের বাজেটে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার সুরাহা দিতে ব্যর্থ হয়েছে মোদি সরকার। এ কথা যে খুব ভুল নয় তা ফের প্রমাণ করে দিল ক্ষিতিজের অকাল মৃত্যু।

আরও পড়ুন- বারবার সুযোগ পেয়েও ‘ঐতিহাসিক ভুল’, জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হলে অন‍্যভাবে লেখা হত ভারতের ইতিহাস

পাশাপাশি প্রয়োজন পড়েছে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর জোর দেওয়া। একাকীত্ব মানুষকে যেভাবে গ্রাস করেছে শেষ কয়েক দশকে তাতে এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। রিপোর্ট বলেছে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত রোগে ভুগছেন এমন ৮০% মানুষই চিকিৎসা পান না। ফলে অনেকেই বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ভারতের ৫৭ মিলিয়ন মানুষ অবসাদের শিকার। ফলে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। আপাত দৃষ্টিতে ক্ষিতিজ আত্মঘাতী হলেও সে এক ধসে যাওয়া ব্যবস্থার শিকার।

More Articles