দেবীর স্বপ্নাদেশ! গ্রামের বিলে সালঙ্কারা ভাসান যান ঋষিপুরের ডাকাতকালী

Kalipuja 2023: মানতের সোনা বা রূপোর গয়না সমেতই দেবী বিসর্জন যান সোজা নদীতে। শোনা যায়, এমন নির্দেশ নাকি দিয়েছিলেন ইসলামপুরের ডাকাতকালী স্বয়ং।

বাড়িতে অধিষ্ঠাত্রী প্রতিমা হোক বা মণ্ডপের পুজো, বহু জায়গাতেই প্রতিমাকে সোনার গহনা পরানোর রীতি রয়েছে। কেউ মানত করে দেবীর জন্য গড়ে দেন গলার হার কিংবা নাকের নথ। কেউ আবার স্বপ্নাদেশ পেয়ে দেবীকে সালঙ্কারা হিসেবে সাজিয়ে তোলেন। বিসর্জনের আগে সে সব অলঙ্কার খুলে রেখে দেওয়া হয় আগামী বারের জন্য। প্রতিবছর সেই সব গয়নায় সাজিয়ে দেওয়া হয় দেবীকে। সমস্ত জায়গাতেই এমনটাই দেখা যায় সাধারণত। তবে দেবীর স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী, সালঙ্কারা দেবীকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া, এমন ঘটনা বোধহয় সচরাচর দেখা যায় না।

তবে এমনটাই প্রতিবছর ঘটে থাকে মুর্শিদাবাদের ইসলামপুরে। শতাব্দীপ্রাচীন ডাকাতকালীর পুজোয় বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে অদ্ভুত এই নিয়ম। প্রতিমার গায়ের যাবতীয় মূল্যবান সোনা, রূপোর অলঙ্কার নিয়ম করে ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীর জলে। সেসব পুনরায় তুলে এনে ব্যবহারের রীতি নেই এ পুজোয়া। প্রতিবছর নানা মনষ্কামনা পূরণের জন্য দেবীর কাছে নানা গয়নাগাটি মানত করেন স্থানীয়রা। মানতের সেই সোনা বা রূপোর গয়না সমেতই দেবী বিসর্জন যান সোজা নদীতে। শোনা যায়, এমন নির্দেশ নাকি দিয়েছিলেন ইসলামপুরের ডাকাতকালী স্বয়ং। স্থানীয়রা জানান, গ্রামের উন্নতির কথা ভেবেই নাকি এমন স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন দেবী। দেবীর সেই নির্দেশ আজও পালন করা হয় অক্ষরে অক্ষরে।

আরও পড়ুন: কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন দেবী, আজও জঙ্গলিকালীর অপেক্ষায় পথ চেয়ে নশীপুর

সেই ইংরেজদের আমল থেকে চলে আসছে ইসলামপুরের ঋষিপুর গ্রামের শ্যামাপুজো। কালীপুজোর দিন রাতে দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীদের ভিড় জমতে থাকে গ্রামে। এমনকী ভিনরাজ্য থেকেও ছুটে আসেন ভক্তেরা। একসময় এই এলাকা ছিল জঙ্গলে ঢাকা। আর যেখানেই জঙ্গল, সেখানেই ডাকাতের উৎপাত। কালীপুজো সেরে প্রতিরাতে ডাকাতি করতে বেরিয়ে পড়ত তারা। তখন থেকেই শুরু হয়েছিল কালীপুজোর চল। তবে প্রাচীন সেই প্রথা মেনে ঋষিপুরে আজও পূজিতা হন ডাকাত কালী।

Gold and silver ornaments are floated in the river with the idol of kali Goddes in murshidabad's Islampur

 

কে কবে এই পুজোর সূচনা করেছিল, তা আজ আর মনে নেই কারওর। শুধু মানুষ জানেন, ডাকাতদের আমল থেকে চলে আসা সেই প্রাচীন পুজোকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তাঁদেরই। স্থানীয় বিশ্বাস, ঋষিপুরের এই ডাকাতকালী দারুণ জাগ্রত। তাঁর কাছে মানত করলেই পূরণ হয় ইচ্ছা। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তেরা এসে প্রতিমার কাছে সোনা রূপোর গয়না মানত করেন। ইচ্ছা পূরণ হলে দেবীকে সাজিয়ে দেন গয়নায়। তবে দেবীর অলঙ্কার পুজো শেষে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অধিকার নেই কারওর। প্রতিমার সঙ্গেই গ্রামের বিলে সোনা ও রূপোর গহনা ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তবে মজার ব্যাপার, এই মন্দিরে একসঙ্গে একাধিক মূর্তি পূজিত হন। এ বছর মন্দিরে একসঙ্গে ২৪টি প্রতিমার পুজো হওয়ার কথা।

আরও পড়ুন: কুখ্যাত মিহির সর্দারের ডেরা থেকে ‘দুর্গেশনন্দিনী’র মন্দির, কেন এত জাগ্রত হুগলির সিদ্ধেশ্বরী কালী?

পুজো মানেই বাড়ি ফেরা। কালীপুজোও বোধহয় ব্যতিক্রম নয় ঋষিপুর গ্রামে। প্রতিবছর গ্রামের মানুষ একজোট হন এই পুজো উপলক্ষে। আসের তাঁদের আত্মীয়স্বজনেরাও। যারা কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন, তাঁরাও গ্রামে ফেরেন এ সময়টা। একসময় গ্রামের ফাঁকা জায়গায় পুজো হত। পরে সেই জায়গায় গড়ে ওঠে মন্দির। অনেকেই সোনারূপোর পাশাপাশি নাকি মায়ের মূর্তিও মানত করেন এই মন্দিরে। মূল মায়ের মূর্তি অনেকটাই বড়। মানতের মূর্তিগুলি সাধারণ ভাবে ছোট আকৃতির হয়। সেই সমস্ত মূর্তির কাছে সম্মিলিত ভাবে প্রার্থনা জানান গ্রামের মানুষ। ইচ্ছেপূরণ থেকে স্বপ্নপূরণের মানতগুলি নিয়ে দেবী ভাসান যান পুজো সারা হলে। সালঙ্কারা দেবী মিশে যান বিলের জলে। তার পর সময় মতো সেই মাটি জল আর খড়ের কাঠামো নিয়ে ফের উঠে আসেন ঋষিপুর গ্রামে। নিরাপত্তাবলয়ে আগলে রাখেন গোটা গ্রাম, বছরের পর বছর ধরে।

More Articles