কুস্তিতে হারাতে পারলেই বিয়ের প্রতিশ্রুতি, কখনও হারেননি চেঙ্গিস খানের নাতনি

Khutlun, wrestling princess of Mongolia: খুতুলুন ঠিক করেন, বিয়েতে আগ্রহীরা খালি হাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে পারবেন না মোটেই। তার জন্য রাখতে হবে বাজি।

একটা সময় ছিল, মেয়েদের পাত্রস্থ করতে পাকা দেখা নয়, ব্যবস্থা হত স্বয়ংবরের। হরধনু ভঙ্গ থেকে শুরু করে মাছের চোখে তির মারার মতো অদ্ভুত সব কৌশল, খেলা দেখিয়ে তবে পুরুষটির ভাগ্যে জুটত কন্যার বরমালা। একগুচ্ছ প্রার্থীর মধ্যে থেকে শ্রেষ্ঠ পুরুষকে বেছে নিতেন বিবাহযোগ্যা। পরবর্তী জীবনে যতই লাঞ্ছনা জুটুক না কেন, যতই পাশা খেলায় বাজি রাখা হোক বা অগ্নিতে ছুঁড়ে ফেলা হোক তাঁকে, সেরা পুরুষ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতাটুকু পেতেন তৎকালীন উচ্চবর্ণের মেয়েরা। শুক্তোয় কী ফোড়ন দিতে হয় কিংবা গায়ের রং আসল কিনা, এমন পরীক্ষা অন্তত বিয়ের আগে দিতে হত না মেয়েদের।

প্রেমে পড়ে অর্জুনকে যুদ্ধে আহ্বান করেছিলেন চিত্রাঙ্গদা। আজ বলে নয়, বরাবরই আসলে 'সুপিরিয়র' পুরুষই বেশি পছন্দ করে মেয়েরা। তাই বুদ্ধি বলো বা বল, জীবনসঙ্গী নির্বাচনে ক্ষেত্রে নিজের থেকে বেশি শক্তিধরকেই কাউকেই বেশি মনে ধরে তাঁদের। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের যেমন শিক্ষার অধিকার ছিল, বহু ক্ষেত্রেই স্বীকৃত ছিল অস্ত্রের অধিরারও। বিশেষত রাজপরিবারগুলিতে তো বটে। যেমন ছিলেন মঙ্গোলিয়ার এই রাজকন্যা। অস্ত্রশিক্ষায় তো বটেই, বলেও তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। ফলে পুরুষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি রেখেছিলেন দুর্দান্ত একটি শর্ত।

আরও পড়ুন: সংস্কৃত থেকে রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন এই মুসলিম মহিলা! কেমন ছিলেন মুঘল যুগের প্রভাবশালী নারীরা?

কিন্তু তাঁরা উচ্চঘর, যার তার নয়, স্বয়ং চেঙ্গিস খানের বংশধর। ফলে বেড়ে ওঠায় সেই ছাপ যে থাকবে তাতে আর আশ্চর্য কী! ডিজনির মুলান নামক ছবিটি অনেকেই দেখেছেন। যেখানে শোনানো হয়েছে এক তরুণী যোদ্ধার গল্প, যিনি কিনা ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু সে তো সাজানো, বানিয়ে তোলা চরিত্র। তবে মুলানের হুবহু বাস্তব রূপ ছিল মঙ্গোলিয়ার রাজকন্যা খুতুলুন।

চেঙ্গিস খানের তেমন কোনও ছবি আমরা দেখি। যেটুকু যা দেখেছি, সবটাই হাতে আঁকা। তবে 'চেঙ্গিস খান' শব্দটাই যথেষ্ট তার বীরত্বের মালুম পেতে। তিনিই পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম অপরাজিত জেনারেল। তার মতো শক্তিশালী বীর সেনাপতি কমই ছিল দুনিয়ায়। রাজা বা শাসকের কাজ সাম্রাজ্য বিস্তার। সে কাজে সফল হয়েছিলেন তিনি। আর এই সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে যে হাতে রক্তের ছিটে লাগবেই, তাতেও সন্দেহ নেই। লেগেছিল চেঙ্গিসের কুর্তাতেও। প্রায় ৮ কোটি নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর দায় ছিল তাঁর কাঁধে।

সেই পরিবারের মেয়ে খুতুলুন। এবং বলাই বাহুল্য যোগ্য বংশধর তিনি। মঙ্গোলিয়ান সাম্রাজ্য ছিল পুরুষতান্ত্রিক। সেখানে লিঙ্গসাম্যের ধারনা তো দূর, বরং স্পষ্ট ভাগাভাগি ছিল নারী-পুরুষের কাজের। তবে সেই ধরা গত ভেঙে বেরিয়ে পড়েছিলেন খুতুলুন। শিখে ফেলেছিলেন মার্শাল আর্ট। কুস্তিতে তাঁকে টেক্কা দেওয়া ছিল দুঃসাধ্য। মঙ্গোলিয়ার ইতিহাসে আজও তার কাহিনি মুখে মুখে ফেরে।

খুতুলুন থিলেন কাইডু খানের মেয়ে। চিনে পরে যিনি উয়ান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন সেই কুবলাই খান ছিলেন তাঁর তুতো-ভাই। ফলে কোন আবহে বড় হয়েছেন খুতুনুন, তা বলে দিতে হয় না। এমনকী সেই কুবলাই খানের বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধরেছিলেন তিনি। বাবার সঙ্গে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন যুদ্ধের ময়দানে। চিনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন মঙ্গোলিয়ান সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে। ওই একবার নয়। বারবার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন তিনি। হারিয়েছেন একের পর এক বিরোধীকে। এক কথায় বলতে গেলে খুতুলুন ছিলেন মারকাটারি যোদ্ধা।

১২৬০ সালে জন্ম খুতলুনের। ১৪টি ভাইয়ের একটি পারুল বোন সে। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় কোনও শিক্ষার অধিকারই তাঁর ছিল না। তবে হার মানেননি তিনি। ঘোড়ায় চড়া থেকে তীরন্দাজি, মার্শাল আর্ট থেকে কুস্তি, সমস্ত ধরণের কসরতে নিজেকে করে তুলেছিলেন সিদ্ধহস্ত। যা মেয়েদের নয় বলে দেগে দেওয়া, যেখানে যেখানে নারীর সেই অর্থে প্রবেশাধিকার নেই, সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন খুতুলুন। ছিনিয়ে এনেছেন অধিকার।

মঙ্গোলিয়া সংস্কৃতিতে এই সব খেলাগুলিকে খুবই মান্যতা দেওয়া হয়। প্রতিবছর সেখানে আয়োজন করা হত জাতীয় গেমস কর্মসূচীর। যা ১২০৬ সালে শুরু করেছিলেন চেঙ্গিস খান স্বয়ং। স্থানীয় ভাষায় তাকে বলা হত নাদাম। প্রতি গ্রীষ্মে এই খেলার আসর ছিল মঙ্গোলিয়ার গর্ব। যেখানে আয়োজন করা হত এই সমস্ত খেলাধুলার। শুধু তিরন্দাজি বা ঘোড়সওয়ারি নয়, মঙ্গোলিয়ার ইতিহাসের সঙ্গে লতায় পাতায় জড়িয়ে আছে কুস্তির ইতিহাস। বছরের পর বছর ধরে কুস্তিতে নিজেদের পরম্পরা ধরে রেখেছে মঙ্গোলিয়া। সেখানকার অনেকেই জাপান পাড়ি দিয়েছিলেন সুমো রেসলার হওয়ার জন্যে। হবে না-ই বা কেন, মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকেই কুস্তির শিক্ষা দেওয়াটাই ওই সংস্কৃতির রীতি।

স্বাভাবিক ভাবেই রাজকন্যা খুতুলুনও সে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হননি। বরং ধীরে ধীরে তিনি তাতে হয়ে ওঠেন অদ্বিতীয়া। চেঙ্গিস খানের মতোই আজীবন বিজয়ী হয়ে থাকার বর নিয়েই বোধহয় জন্মেছিলেন তিনি। তাই এখনও পর্যন্ত তাঁকে হারাতে পারেননি বাঘা বাঘা কোনও কুস্তিগিরই। এমনিতে খুবই নিয়মানুবর্তী ছিলেন রাজকন্যা। যোদ্ধা হওয়ার জন্য যা যা লাগে আর কী! আর প্রথা ভাঙার মন তো বরাবর ছিলই তাঁর মধ্যে। তা এ হেন খুতুলুন সিদ্ধান্ত নিলেন, যে তাঁকে কুস্তিতে হারাতে পারবেন, তাঁর গলাতেই তিনি বরমাল্য তুলে দেবেন। যোদ্ধা হলে কি হবে, রূপেও কোনও দিক থেকে কম যান না। স্বাভাবিক ভাবেই রাজকন্যে বিয়ে করার সাধ বুকে নিয়ে নিত্য ভিড় জমাতেন বহু বড়় যোদ্ধা, বলশালী। ততদিনে অবশ্য খুতুনুনের বীরত্বগাথা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। তবু পুরুষের অহংবোধ যায় কোথায়! যে অহংবোধের দাপটে দুর্গাকে যুদ্ধক্ষেত্রে আহ্বান করেছিল মহিষাসুর, ঠিক তেমন ভাবেই হাজার হাজার সুপাত্র আসতেন খুতুলুনকে বিয়ে করতে, কুস্তির আহ্বানে সাড়াও দিতেন। তবে তার পরের গল্পটা অবশ্য তেমন ভালো হত না।

চেঙ্গিস খানের মতোই হার কোনওদিন ছোঁয়নি খুতুনুনকে। বিয়েতে আগ্রহী অন্তত এক হাজার নাইট, যোদ্ধাকে গো-হারা হারিয়েছেন তিনি। তবে সেই সব বিবাহযোগ্যরা যে কেবল নিজের অহং বা মান হারিয়েছে, তা-ই নয়। মাশুল দিতে হয়েছে তাদের সম্পত্তিও। খুতুলুন ঠিক করেন, খালি হাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে পারবেন না এইসব যোদ্ধারা। তার জন্য বাজি রাখতে হবে ঘোড়া। কেউ বলেন সংখ্যাটা দশ, তো কেউ বলেন একশো। যোদ্ধারা যদি সম্মুখসমরে হেরে যান, ওই সব ঘোড়াগুলি হবে রাজকন্যা খুতুলুনের সম্পত্তি। এমনই ছিল শর্ত। সাধে কি আর তিনি চেঙ্গিস খানের বংশধর। চেঙ্গিসের মতো সাম্রাজ্য বিস্তার খুব কম রাজা বা সেনাপতিই করতে পেরেছেন। ঠিক তেমন ভাবেই খুতুলুনও বেছে নিয়েছিলেন সম্পত্তি বাড়ানোর অভিনব উপায়। শেষপর্যন্ত দশ হাজারেরও বেশি ঘোড়া জমেছিল তার ঘোড়াশালায়।

পরে কাউকে একটা বিয়ে করেছিলেন খুতুলুন। তবে তাঁর নাম-পরিচয় তেমন ভাবে ইতিহাস বইতে পাওয়া যায় না। এ নিয়ে অনেক রটনাও রয়েছে। কেউ কেউ মনে করতেন, নিজের বাবার সঙ্গেই অবৈধ সম্পর্কে ছিলেন খুতুলুন। পরে পারিবারিক দুর্নাম ঘোঁচাতে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ঐতিহাসিক রশিদ আল-দিন তাঁর গবেষণায় জানান, খান অব দ্য খানাটে অব পার্সিয়া, গজনের প্রেমে পড়েছিলেন খুতুলুন। কেউ আবার মনে করেন, আবতাকুল নামে এক যোদ্ধাকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। খুতুলুনের বাবা কাইড়ুকে হত্যা করার জন্য ওই যোদ্ধাকে পাঠিয়েছিল কুবলাই খান। আবতাকুল ধরা পড়ে ও তাঁর গর্দানের হুকুম হয়। ছেলের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ কার্যকর হতেই ছুটে আসেন তাঁর মা। ছেলের জায়গার তাঁর প্রাণ নেওয়ার জন্য কাঁদতে থাকেন। বেঁকে বসেন আবতাকুল। বলেন, মায়ের আত্মাহূতি দিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেয়ে বীরের মতো মৃত্যুই তাঁর মত মঙ্গোল যোদ্ধার পক্ষে বেশি শ্রেয়। বীরের এই বাণী শুনে নরম হয় কাইড়ু খানের মন। তিনি বেকসুর খালাস দিয়ে দেন আবতাকুলকে। তবে এই সমস্ত গল্পই কিছুটা শোনা, কিছুটা বোনা। পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যের অধিকার নিয়ে ভাইদের বিরুদ্ধেও যান খুলুনুন। তবে শেষপর্যন্ত তখতে উঠেছিলেন তাঁর দুই ভাই। কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত সেনাপ্রধানের পদের অধিকার ছিল খুতুনুনের। যা তিনি শুধু উত্তারাধিকার সূত্রে পাননি, বরং খেটে তা অর্জন করতে হয়েছিল।

আরও পড়ুন: দ্রৌপদী একা নয়! জানেন, এক নারীর বহুস্বামীর প্রথা কীভাবে এল বিশ্বে?

মাত্র ৪৫-৪৬ বছর বয়সে মৃত্যু হয় খুতুলুনের। কেউ মনে করেন যুদ্ধক্ষেত্রে, কেউ আবার মনে করেন, ভাড়াটে খুনি লাগিয়ে হত্যা করা হয়েছিল তাঁকে। বাইরের শত্রু না শত্রু ঘাপটি মেরেছিল ঘরেই, তা জানা যায়নি। মঙ্গোলিয়ায় ইতিহাসে খুতুলুন আজও এক আশ্চর্য চরিত্র। শক্তি ও জেদের প্রতীক হিসেবে দেখা হয় তাঁকে। এখনও মঙ্গোলিয়ায় কুস্তির জন্য যে ট্র্যাডিশনাল পোশাক পরা হয়, তার মধ্যে দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় রাজকন্যাকে। শুধু তাই নয়, তাঁর স্মৃতিতে করা হয় একটি বিশেষ নাচও। যাকে জয়ের নাচ বলে থাকেন মঙ্গোলিয়ানরা।

শুধু মঙ্গোলিয়ার নয়, সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মহিলা কুস্তিগির হিসেবে নাম রয়ে গিয়েছে খুতুলুনের। আর যে ভাবে পুরুষশাসিত সমাজে দাঁড়িয়ে তিনি বারবার চিৎকার করে উঠেছেন, বয়ে গিয়েছেন স্রোতের বিপরীতে, তা সভ্যতা মনে রাখবে দীর্ঘদিন।

More Articles