কোথাও ন্যাড়া পোড়া, কোথাও হোলিকা দহন, বিজ্ঞান নাকি মিথ? কোন সত্যি লুকিয়ে আছে এই প্রথায়?

Nera pora or Holika Dahan ritual : এই যে ইতিহাস, এই যে রীতি তার আসল সত্যিটা ঠিক কী? কীভাবে বাংলায় শুরু হল এই প্রথা, জানেন? শুধুই কি মিথ নাকি এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা?

“আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল।
পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বলো হরিবোল...”
আজকের আধুনিক প্রজন্ম এই ছড়াটির সঙ্গে কতটা পরিচিত তা অবশ্য জানা নেই, তবে একটা সময় দোল মানেই ছিল এই প্রচলিত ছড়ার অনুরণন। তখন যদিও যান্ত্রিকতা গ্রাস করেনি জীবনকে, তখন উৎসব মানে ছিল অফুরান আনন্দ। কচিকাঁচাদের শব্দে মুখরিত পরিবেশ। এখন বাচ্চাদের হাতেও অ্যান্ড্রয়েড ফোন, যা কিছু উৎসাহ সব যেন সেঁধিয়ে গিয়েছে ওই কয়েক ইঞ্চি মুঠোফোনেই। তবে পুরনো বাক্সটা হাতড়ে দেখলে এখনও খোঁজ মেলে এইসব ঐতিহ্যের। এখনও কলকাতা সহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় দোলের আগের দিন গনগনে অঙ্গুনের আঁচ ওঠে। চোখের নিমেষে ছাই হয়ে যায় জীর্ণ পুরাতন। আর সেই আগুনের পরশ এসে লাগে বাঙালির রঙের উৎসবে। রাত পেরিয়ে ভোর হয়, আবির রঙে শুরু হয় বসন্তের উদযাপন।

কিন্তু এই যে ইতিহাস, এই যে রীতি তার আসল সত্যিটা ঠিক কী? কীভাবে বাংলায় শুরু হল এই প্রথা, জানেন? শুধুই কি মিথ নাকি এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা?

রাজনীতি প্রেমীরা আজকাল প্রায়শই বিপক্ষ দলের কুশ পুতুল পুড়িয়ে থাকেন। ন্যাড়া পোড়াও খানিক সেরকম। বাঁশের ওপর খড় দিয়ে তৈরি করা হয় বিশেষ ন্যাড়া, তার পর তাকে পোড়ানো হয় বলেই এরকম নাম। এখানেই শেষ নয়, শুকনো পাতা, খড়, বাঁশের গায়ে নারকেল দড়ি দিয়ে বেঁধে তৈরি করা হয় ন্যাড়ার ঘর। তারপর বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার যে রেওয়াজ তাকেই বাঙালিরা বলেন ন্যাড়া পোড়া। তবে অবাঙালিদের কাছে এটি 'হোলিকা দহন' নামেই খ্যাত।

আরও পড়ুন - জামা ছিঁড়ে খালি গায়ে রঙ খেলার কাছে হাজার গোলে হেরে যায় তিন আঙুলের আবিরের দোল

এই প্রাচীন প্রথাটির শুরু হয়েছিল এক পৌরাণিক কথন অনুসারে। অনেকেরই অজানা সেই গল্প। পুরাণ মতে, রাক্ষসরাজ হিরণ্যকশিপ একবার তাঁর প্রজাদের পুজো করা বন্ধ করে দিয়ে নিজে অমরত্ব লাভের আশায় ব্রহ্মার তপস্যা করা শুরু করেন। ব্রহ্মা অবশ্য বর দেওয়ায় সিদ্ধ হস্ত। হিরণ্যকশিপকেও খালি হাতে ফেরালেন না। একটা দুটো নয়, পাঁচ পাঁচটি বর দিলেন তাঁকে। সেই বর অনুসারে হিরন্যকশিপ-এর মৃত্যু দিনেরবেলাও হবে না, রাত্রিবেলাও হবে না। চারদেওয়ালের ভিতরেও হবে না, চারদেওয়ালের বাইরেও হবে না। কোনও মানুষের হাতেও হবে না, প্রাণীর হাতও হবে না। জলে-স্থলে মহাশূণ্যে কোথাও তাঁর মৃত্যু হবে না। এখানেই শেষ নয়, অস্ত্র অথবা শাস্ত্র কোনোকিছুর সাহায্যেই তাঁর মৃত্যু সম্ভবপর হবে না, এমনটাও নির্ধারিত হল ওই বরে।

এই অমরত্বের বরলাভই শেষে কাল হয়ে দাঁড়ালো। অসুর বধে ঠিক যেভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন দেবতারা ঠিক তেমনই ঘটল আবার। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়লেন না হিরণ্যকশিপও। আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন তিনি। প্রজাদের ওপর শুরু হল অকথ্য অত্যাচার। কিন্তু ঘর শত্রু বিভীষণ গিয়ে দাঁড়াল হিরম্যকশিপ-এর নিজের ছেলে প্রহ্লাদ। সে পিতাকে ঈশ্বর বলে মানতেন না। প্রহ্লাদ ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত। শোনা যায়, রাগে তাই নিজের ছেলেকেও হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন হিরণ্যকশিপ। এই কাজে তিনি সাহায্য নেন নিজের বোন তথা রাক্ষসী হোলিকার। প্রসঙ্গত, হোলিকাও আবার ছিলেন ব্রহ্মা দ্বারা বরপ্রাপ্ত। ব্রহ্মার বাইরে তিনি কখনই আগুনে পুড়বেন বলে স্থির ছিল। তাই রাক্ষসী হোলিকার কোলে প্রহ্লাদকে নিয়ে বসা অবস্থায় পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করে হিরণ্যকশিপ। যাতে আগুনে না পোড়ার বরে রাক্ষসী হোলিকার কিছুই না হয়, বরং সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় প্রহ্লাদ। কিন্তু ধর্মের কল যে সত্যিই বাতাসে নড়ে, তার প্রমাণ মিলল অচিরেই। ভক্ত প্রহ্লাদের ভক্তিতে প্রসন্ন হতে ভগবান বিষ্ণু তাঁকে বাঁচিয়ে দেন। কিন্তু হোলিকা তাঁর এই ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেই থেকেই যা-কিছু অন্যায়, যা-কিছু খারাপ সেই সবকিছুর অবসান করে ন্যায় কিছু প্রতিষ্ঠার সূচক হিসেবে পুরাণকে স্মরণ করে আজও পালিত হয় ন্যাড়া পোড়া বা হোলিকা দহন।

আরও পড়ুন - টানা দশ দিন ধরে দোল খেলা হয় নবদ্বীপে, কোন রহস্য লুকিয়ে আড়াইশো বছরের পুরনো ইতিহাসে?

হোলিকার পুড়ে মরা থেকেই এই প্রথা, তবে এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও একটি বাস্তব সত্যি। রয়েছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও। আসলে এই প্রথা অন্যায়, খারাপ তথ্য পরিবেশে দূষণ সৃষ্টিকারী যা কিছু তার পুড়ে যাওয়াকে বোঝায়। আমরা জানি বসন্তকাল মানেই বাতাসে রোগের উপদ্রব। জানা অজানা অজস্র ভাইরাসের আনাগোনা এই সময়। এছাড়া শীতের শেষ এবং গরমের শুরু এই দুয়ের পরিবর্তনেও অসুখ ছড়ায় এই সময়। আর এই সময়েই যাবতীয় রোগ-জীবাণু-ব্যাকটেরিয়া বাতাসে ভেসে বেড়ায়। যার ফলে ফ্লু, ভাইরাসঘটিত জ্বর এবং পক্সের মতো একাধিক রোগ শরীরে বাসা বাধার সম্ভাবনা থাকে।

তাই এই সময় ঝড়ে পড়া শুকনো পাতা, যেমন - নারকেল, সুপুরি, খড় ইত্যাদি জড়ো করে পুড়িয়ে ফেলা হয়। যার জেরে বাতাসে ছড়ানো ভাইরাস বিনাশ সম্ভব বলেই মনে করেন বিজ্ঞানীরা। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, আগুনে আবর্জনা পোড়াতে গিয়ে অতিরিক্ত বায়ু দূষণ হয় এমন কিছু যাতে না পোড়ানো হয়। এতেই হয়তো মনের সব পাপ, অশুচি, লোভ, হিংসের পাশাপাশি বাতাসে ছড়িয়ে যাওয়া অকাল রোগও পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আর একটা নতুন সকাল আসবে, যেখানে থাকবে নানান রঙের মিশেল।

More Articles