নিকষ আঁধারে ওরা হাঁটছে...

Walking with Refugees in mind: আয়নায় সেই বিষাদে ভরা ভয়ার্ত মুখ আমি দেখতে পাই। দেখতে পাই অজস্র প্রত্যয়শূন্য মুহূর্ত। দেখতে পাই অ্যালিনারা নিকষ আধাঁরে হাঁটছে।

যখন যেখানে যাই একটা জলের বোতল সঙ্গে রাখি। জলের অভাব নেই এমন জায়গায় যাচ্ছি, নিশ্চিত জেনেও বোতলটা সঙ্গে রাখা আমার স্বভাব। এর মানে এই নয় যে আমি ঘন ঘন জল খাই। এমনটা হতেই পারে, গোটা দিনে দু'লিটারের বেশি জল খাওয়া হলো না। কিন্তু এমন যেন না হয়, যখন তেষ্টা পাচ্ছে জল পেলাম না। এই অবস্থাটা কল্পনায় এলেই আমার শ্বাসরোধ হয়ে আসে। তাই ব্যবস্থা থাকে। শুধু নিজের কথাই নয়, অন্য কেউ তৃষ্ণার্ত অথচ জল পাচ্ছে না, এই চিন্তাও আমার শ্বাসরোধ করে। কিন্তু যা আমার চিন্তার অতীত তা যে বাস্তবে ঘটবে না, তা তো নয়। আর সেই বাস্তব দূরে বসে থাকা এই আমির কাছেই যদি দমবন্ধ করা হয়, তবে যে সহ্য করছে তার কাছে কেমন? ছ'বছরের শিশু জলের জন্যে হাহাকার করছে, বাবা জল দিতে পারছে না। এ দৃশ্য কল্পনা করতে পারি না। এমন নিষ্ঠুরতা মহাকাব্যেও থাকে না। কিন্তু জীবনে থাকে। গাজা স্ট্রিপ এই জীবনের সাক্ষী। তিলে তিলে লাখো মৃত্যুর দিকে যাওয়ার সেই দৃশ্যে তাকিয়ে ভাবি বুকে কত বল থাকলে মানুষকে এদিকে ঠেলে দেওয়া যায়! রাষ্ট্রনায়করা রাতে ঘুমোন? সন্তানের চোখে চোখ রাখতে পারেন?

এই পর্যন্ত পড়েই কেউ বলবেন 'ওহ, তার মানে হামাসের পক্ষে।' এই যে ইজরায়েলের এত মানুষ পণবন্দি, তাঁদের অন্যায় কোথায়? এত শিশুকে আটক করা হল, এত মহিলা নিপীড়িত হলেন তাঁদের অন্যায় কোথায়? অন্যায় নেই তাঁদের। কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করি। কিন্তু এক বাক্যে এই প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে বরং অভিজ্ঞতার কথা বলি৷

আরও পড়ুন: পথ বেঁধে দিল…

২০১৬ সালে আলাপ হয় অ্যালিনা উসচেকার সঙ্গে। অবিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্রুজকোভাকা শহরের মেয়ে অ্যালিনার বাবার জন্ম ইউক্রেনে। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাশ করে ইউক্রেনেই থিতু হওয়ার কথা ভেবেছিল অ্যালিনা। ২০১৪ সালে ডোনেটস্কের যুদ্ধে রাতারাতি ঠাঁই হারায় সে। যখন-তখন মৃত্যু হতে পারে জেনে রাতারাতি সে রাষ্ট্রপুঞ্জের সহায়তায় ফুজি ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সুদূর আফ্রিকায় লোথাস বলে একটা গ্রামে দীর্ঘদিন ছিল অ্যালিনা। সে গ্রামে রাতে বুনো জন্তুরা ঢুকে পড়ে। এই সময়ে তোলা লোথাসের বাচ্চাদের কিছু ছবির জন্যে অ্যালেনা একটা আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায়। সেই পুরস্কারের অর্থে সে ভারত আসে। আমার সঙ্গে আলাপ সে সময়েই। অ্যালিনা আমায় বলেছিল, 'অর্ক আমার মন নেই। যার দেশ থাকে না, তার মন থাকে না, সে শুধু বাঁচে। এমনি এমনি বাঁচা, কেউ অপেক্ষা করে না আমার জন্য। আমি ঘুরে বেড়াই, বাঁচি, যা পাই খাই, কোনো প্রত্যাশা নেই। কাল খেতে না পেলে ভিক্ষে করব, আমার কোনো লজ্জা নেই।' এই অ্যালিনার সঙ্গে যোগাযোগ চুকেবুকে গিয়েছিল বহুকাল। আবার যোগাযোগ তৈরি হলো যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হতে। খবর নিয়ে জানতে পারলাম, ভবঘুরে মেয়েটি আবারও জীবনের প্রতি বিশ্বাস ফেরাতে চেয়েছিল। ফিরে গিয়েছিল ইউক্রেনে। সেখানে প্রণয়, বিবাহ, দুই সন্তান-- একে একে এসব পর্ব মেটে। একটা নিটোল ছবি যখন তিলে তিলে গড়ছে ওরা, তখনই সমরসজ্জা তৈরি করছে রুশ রাষ্ট্রনায়ক ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেনে, স্ত্রী আর দুই সন্তানকে রেখে অ্যালেনার বরকে চলে যেতে হয় সেনাবাহিনীতে। ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে নিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অসহনীয় দিন কাটিয়েছে অ্যালিনা। তারপর একদিন রাতের অন্ধকারে আবার দেশছাড়া। প্রথমে পোল্যান্ড। সেখান থেকে ফের জার্মানি। অ্যালেনার স্বামী কি যুদ্ধ থেকে ফিরেছে? দ্বিধা নিয়ে একদিন প্রশ্নটা করেই ফেলি। অ্যালিনা বলে, 'যুদ্ধের সময় থেকেই আমাদের আর যোগাযোগ নেই। দু'টো বাচ্চাকে একা মানুষ করছি জার্মানিতে।' ওর পাঠানো নানা সময়ের নানা ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি, ওর মেরুদণ্ডের হাড়টায় চোখ যায়। মনে হয় গাজায় যে বাড়িগুলি ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে সেগুলি অ্যালিনাদের মেরুদন্ডের হাড়ের মতো। ধ্বংসের মধ্যে জেগে থাকে৷ অ্যালিনার শরীরও তো তাই, ধ্বংসাবশেষ। এক দশক যন্ত্রণা সহ্য করা একটা কাঠামো।

Refugees have been walking since ages by Arka Deb Ultopalta Ghurir Manja

এ শতক ইউক্রেনের অ্যালিনাদের। এ শতক রাতের অন্ধকারে গভীর সমুদ্রে ট্রলারে গাদাগাদি মানুষের। পরের দিন সকালে স্থলভাগ দেখার স্বপ্ন বুকে নিয়ে জেগে থাকা রোহিঙ্গা রিফিউজিদের। এ শতক নূর আলজাকার। এ লেখা লেখার কিছুক্ষণ আগে জীবনে প্রথম, জানি না শেষবার কিনা, যার সঙ্গে তিন মিনিট কথা হলো। দেখে বুঝছিলাম, ওর শরীরটা ভেঙে আসছে। বলছিল, 'জলের অসুবিধে, একটুও জল পাচ্ছি না আমরা।' আমি দ্রুত ভিডিও থামাই। গলা বুজে আসছে আমারই। নূর কম কথা বললে ওর তেষ্টা কম পাবে।

মনে পড়ে ঠাম্মার কথা। মা-বাবাকে ছেড়ে এক কাপড়ে রিফিউজি ক্যাম্পে চলে আসা বালিকা। আর কখনও নিজের দেশে ফিরে যেতে না-পারা এক কিশোরী। যিনি সমস্ত স্মৃতির তাড়নাকে কবর দিয়ে স্রেফ সন্তান মানুষ করলেন। বৃদ্ধ হলেন। একদিন মরে গেলেন। ক্যাম্প থেকে কলোনি পর্যন্ত আসা হলো।

Refugees have been walking since ages by Arka Deb Ultopalta Ghurir Manjaআসলে একটা নতুন দেশে যখন এক কোণে রিফিউজিদের ঠাঁই হয়, ভিটেমাটি ছেড়ে তাদের যখন আসতে হয়, ফের নতুন করে শুরু করতে হয়, সভ্যতার পায়ে পা মেলাতে গিয়ে তারা একটু পিছিয়ে পড়ে। তাল রাখতে পারে না। মানিয়ে নিতে তিন প্রজন্ম চলে যায়। কলোনিতে ওরা ঠাসাঠাসি করে থাকে। জলের জন্য ঝগড়া করে। বাড়িতে নতুন সদস্য জন্মালে বেঞ্চ দিয়ে খাটের জায়গা বড় করে। শোয়ার ঘরেই খায়। খাওয়ার ঘরেই শোয়। বেমানান জামাকাপড় পরে। বড় শহরে যেতে ভয় পায়। অপমানের ভয়ে বুকে নিয়ে বাঁচে অন্তত তিনটে প্রজন্ম। যে রিফিউজি হয়েছে তার সন্তান তো বটেই, নাতিনাতনিরাও বোঝে আমরা কিছুতেই পারছি না। গ্রেটার কলকাতা থেকে কলকাতায় ঢুকতে পারছি না। মূলস্রোতটার সমকক্ষ হতে পারছি না। প্রবল চেষ্টা করতে থাকে ওরা। চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যায়। বড় শহরে ফিট-ইন হতে হতে ক্লান্ত হয়ে যায়। ঘিরে ফেলে হীনম্মন্যতা। ঠাসাঠাসি থাকা পেরিয়ে একটা বাড়ি জোগাড় করতেই দুই প্রজন্ম পেরিয়ে যায়। ঘর হারানোর বিষাদ, বাস্তুচ্যুত হওয়ার যন্ত্রণা তার ডিএনএ-তে খেলা করে। ভয় তার শরীর-মনের রাস্তাঘাট অন্ধকার করে রাখে। আয়নায় সেই বিষাদে ভরা ভয়ার্ত মুখ আমি দেখতে পাই। দেখতে পাই অজস্র প্রত্যয়শূন্য মুহূর্ত। দেখতে পাই অ্যালিনারা নিকষ আধাঁরে হাঁটছে।

আরও পড়ুন:শোকের বিগ্রহ

ইজরায়েলের নিরপরাধ শিশুর মৃত্যু সমর্থন করি না। সমর্থন করি না সাধারণ মানুষকে পণবন্দি করার ঘটনা। ১৯৬৭ সালে আরব দেশগুলি যে ভাবে ইজরায়েলকে কোনঠাসা করেছে সমর্থন করি না। কিন্তু যুদ্ধে, হিংসায় দীর্ণ যে মানুষ রাতের আঁধারে বিরানপথে হাঁটে, আমার মন তার সঙ্গে সঙ্গে পা চালায়। আমার শরীর তার সঙ্গে সংলাপ রচনা করে। এ আমার নিয়তি।

More Articles