'নৌজওয়ান' থেকে 'প্যায়াসা'—একের পর এক হিট, কেন ভেঙে গেল সাহির-শচীন জুটি?

Sahir Ludhianvi and Sachin Deb Barman: শচীনকত্তা লাফিয়ে উঠলেন। 'এই তো'! সাহিরের হাত ধরে টানতে টানতে সোজা করদার স্টুডিও। প্রযোজক-নির্দেশক এ আর করদারকে দেখাতে হবে তো এই নতুন আবিষ্কার!

১৯৪৯ সালের কথা। দেশভাগ হয়ে গিয়েছে। উত্তাল একটা সময় পেরিয়ে একটু একটু করে ভবিষ্যতের দিকে তাকাচ্ছেন ভারতের মানুষ। সারা শরীরে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হওয়ার দাগ তখনও দগদগে। সাম্প্রদায়িক হানাহানির রক্তের দাগ তখনও মুছে যায়নি শহরের রাস্তা থেকে। এমন একটা সময় বোম্বের রাস্তায় রাস্তায় গান লেখার সুযোগের জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। অখ্যাত নন, বেশ বিখ্যাত মানুষ। প্রথমবার সিনেমায় গান লিখবেন─তেমনটাও নয়। 'আজাদি কি রাহ পর' সিনেমায় চার-চারটে গান লিখে ফেলেছেন কয়েক বছর আগেই। নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছেন 'বদল রহি হ্যায় জিন্দেগি' গানে। অথচ সুযোগ জুটছে না। এমনও হয়? মানুষটার নাম শুনলে চমকে উঠবেন। সাহির লুধিয়ানভি। গীতিকারদের যিনি প্রথম আলোর তলায় নিয়ে আসবেন। যিনি লিখবেন, ‘কভি কভি মেরে দিল মে'। শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে জুটি বেঁধে যিনি ইতিহাস গড়ে ফেলবেন এক দশকেই। কেন এক দশক? কারণ বছর সাতেকের বেশি টেকেনি সেই জুটি। আজ আপনাদের জন্য সেই ইতিহাসই রইল।

১৯৪৯ সালে সাহির পাকাপাকি ভাবে বোম্বেতে চলে এলেন। মাকে নিয়ে উঠলেন বার্সোবার কুবের লজে কিসেন চন্দরের ঘরে। কবি হিসেবে তখন সাহির বেশ প্রতিষ্ঠিত। 'তলখিয়াঁ'র জেরে মানুষজন তাঁকে ভালোই চেনেন। কিন্তু সাহিরের স্বপ্ন একদিন বিরাট মাপের গীতিকার হবেন। 'বদল রহি জিন্দেগি' ছিল স্বাধীনতা উদযাপনের গান। তেমনভাবেই লিখতে বলা হয়েছিল সাহিরকে। কিন্তু গানে দেখা গেল,

ইয়ে উজড়ি উজড়ি বস্তিয়াঁ, ইয়ে লুট কি নিশানিয়াঁ
ইয়ে অঞ্জানি পে অজনবি কে জুলম কি নিশানিয়াঁ
অব ইন দুখোঁ কে ভার সে নিকল রহি হ্যায় জিন্দেগি
বদল রহি হ্যায় জিন্দেগি

ঠিক নিজের ভঙ্গিমায় চারপাশের ছেঁড়া ছবি উপস্থাপিত হল গানের শরীরে। অসঙ্গতিতে আলো ফেলা যে এই গীতিকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠবে, ক্ষমতাকে প্রশ্নের শানিত ছুরিতে ক্ষত-বিক্ষত করবেন তিনি, কোনও সঙ্গীত-পরিচালক তাঁকে দমাতে পারবেন না, তারই খানিক আভাস ছিল এই গানে। গানটি শুনলেই বোঝা যায়, শেষ লাইনটি কেবল সিনেমার মোটিফ হিসেবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আসলে গীতিকারের বক্তব্য অন্য।

সাহিরের বেশ দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস ছিল। সাধারণত মানুষ যখন দুপুরের আহার সারে, তখন সকাল হত তাঁর। সেই অভ্যেস আমূল বদলে ফেললেন। ভোর ছ'টায় উঠে ঘুরতেন স্টুডিওর দরজায় দরজায়। তাঁকে দেখেই প্রোডিউসারেরা "আরে সাহিরসাব!” বলে উঠে দাঁড়াত। খাতির করে বসাত চেয়ারে। কিন্তু সুযোগ দিতে রাজি নয় কেউ। বলত, “দেখুন, আপনার কবিতা আমার খুব প্রিয়। কিন্তু একটা সিনেমা লাখ আষ্টেক টাকায় তৈরি। তাতে আমার ভালো কবির কোনও প্রয়োজন নেই। ভালো কবি মানেই যে ভালো গীতিকার হবেন, এমনটাও তো নয়, বুঝতেই পারছেন।" এমনকি শাহিদ লতিফ তাঁকে একবার ডেকে বলেছিলেন, “আপনি বড় মাপের কবি বলেই, আপনাকে দিয়ে গান লেখানো দুঃসাধ্য। আপনার পয়সাকড়ির অসুবিধা হলে আমার বাড়িতে খেয়ে যাবেন, দ্বিধা করবেন না।" স্বাভাবিক ভাবেই এ'সব সাহিরকে ক্ষুণ্ণ করত।

এ'দিকে সত্যিই টাকা ফুরিয়ে আসছে। মায়ের সোনার গয়না বিক্রি করে ইলেকট্রিক আর জলের বিল মেটাচ্ছেন সাহির। কিসেন চন্দরের বাজে হাতের লেখায় লিখিত চিত্রনাট্য পুনর্লিখন করে শ-দেড়শো টাকা পাচ্ছেন। কিন্তু হাল ছাড়ছেন না। কাছের লোকেদের বলতেন, “ভাই, এ'টা বোম্বাই শহর। বাইরে থেকে যারা আসে তাদের কাছে বছর দুয়েক খাটিয়ে বিষ ঝেড়ে দেয়। তারপরে খোলা মনে আলিঙ্গন করে।" এ'ভাবে বছর খানেকের বেশি কাটিয়ে দিলেন বোম্বেতে। একদিন তাঁর এক বন্ধু মোহন সেগল জানাল, এস ডি বর্মণ নামে এক সঙ্গীত পরিচালক রয়েছেন। তিনি নাকি নতুন গীতিকার খুঁজছেন। নতুন প্রতিভাদের কদর করেন বর্মণ।

আরও পড়ুন: ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর দজ্জাল গিন্নির আড়ালে রয়ে গেলেন দুঃসাহসী মলিনা দেবী

সাহির সোজা হাজির খারের গ্রিন হোটেলে। দরজায় 'প্লিজ ডু নট ডিস্টার্ব' ঝোলানো ছিল। সে'সবের পরোয়া করে কে! সাহির গট গট করে শচীনকত্তার ঘরে ঢুকে নিজের পরিচয় দিলেন। বর্মণ বাঙালি মানুষ। লেখালেখির সঙ্গে তেমন সম্পর্কও ছিল না। 'তলখিয়াঁ'র নাম পর্যন্ত শোনেননি। সাহিরের খ্যাতি সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। তবে নতুন লোকেদের সঙ্গে কাজ করার সাহস ছিল। সাহিরকে বসতে বললেন। তারপর ছবির দৃশ্য বুঝিয়ে একটা সুর দিলেন। কথা বসাতে হবে। আরেকবার সুরটা শুনাতে বললেন সাহির। হারমোনিয়াম বাজিয়ে সুর শুনালেন শচীনকত্তা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সাহির লিখে ফেললেন, “ঠন্ডি হাওয়ায়েঁ, লেহরা কে আয়েঁ, রুত হ্যায় জওয়াঁ, তুম হো য়াহাঁ, ক্যায়সে ভুলায়েঁ"। শচীনকত্তা লাফিয়ে উঠলেন। 'এই তো'! সাহিরের হাত ধরে টানতে টানতে সোজা করদার স্টুডিও। প্রযোজক-নির্দেশক এ আর করদারকে দেখাতে হবে তো এই নতুন আবিষ্কার! লুধিয়ানা থেকে লাহোর হয়ে দিল্লি হয়ে বোম্বে─দেশভাগের দাগ বুকে ভেসে বেড়ানো মানুষটির জীবনে এই দিনটি ছিল আরেকটি মাইল ফলক। একটু স্বস্তির হাওয়া। নতুন স্বীকৃতির আস্বাদ।

'ঠন্ডি হাওয়ায়েঁ' লেখা হয়েছিল 'নৌজওয়ান' (১৯৫১) ছবির জন্য। নায়িকা নলিনী জয়ওয়ন্তের লিপে গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। সারা দেশে সাড়া ফেলে দিয়েছিল সেই গান। যাকে বলে 'ইনস্ট্যান্ট হিট'। সাহির-শচীন জুটির যাত্রা সেই শুরু। সে'সময় মজনু সুলতানপুরি লিখছেন, শাকিল বদায়ুনি লিখছেন, রাজিন্দর কিসেন লিখছেন, শৈলেন্দ্র লিখছেন, হসরত জয়পুরি লিখছেন, কইফি অজমি লিখছেন। দিকপাল এক এক জন গীতিকার। তাঁদের মাঝখানে জায়গা করে নেওয়াটা খুব সহজ কাজ ছিল না। তার উপর সাহির অত্যন্ত উৎকৃষ্ট কবি। কবিতার ছায়া গানে পছন্দ করতেন না সে'সময় সঙ্গীত পরিচালকেরা। কিন্তু শচীনকত্তার সুরে সাহিরের লেখা হিট করতে শুরু করল। এবং এই গানগুলির জনপ্রিয়তা বুঝিয়ে দেয়, সঙ্গীত পরিচালকদের সেই চিন্তা কতখানি ভুল! ১৯৫১ থেকে ১৯৫৭─পরপর পনেরোটি সিনেমা। শচীনকত্তার সুর মানে সাহিরের লেখা প্রায় থাকবেই, অবধারিত। 'নৌজওয়ান'-এর পরের ছবিটি এই দু'জনের জন্যেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ‘বাজি' (১৯৫১) ছবির মধ্যে দিয়ে নির্দেশনার জগতে পা রাখলেন গুরু দত্ত।

'বাজি'র জন্য সাহির লিখেছিলেন, ‘তদবির সে বিগড়ি হুয়ি, তকদির বনালে'। কিন্তু তাঁর গজল শচীনকত্তা পার্টি সং বানিয়ে ফেললেন গীতা দত্তের খাতিরে। সাহিরের সে কী আপত্তি! শচীনকত্তা পাত্তাই দিলেন না। গান হিট করল ঠিকই। কিন্তু প্রশংসা কুড়ালেন এক শচীনকত্তাই। দেব আনন্দের 'নবকেতন' ‘বাজি'র প্রযোজনা করেছিল। ছবিটি যখন মুক্তি পায়, দেব আনন্দ তখন যোধপুরে। কাছেই একটা বায়ুসেনার স্টেশন ছিল। ডিস্ট্রিবিউটররা তাঁকে জানায়, দিনের একটি নির্ধারিত সময়ে, ছবিতে যখন গানটি চলত, পাইলটেরা লাইন দিয়ে সিনেমার টিকিট কিনতেন শুধুমাত্র গানটি দেখবেন বলে। ছবির জন্য নয়, তাঁরা আসতেন কেবল গানটি দেখতেই। এতখানি জনপ্রিয় হয়েছিল সেই গান।

এরপর 'জাল' (১৯৫২), ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার' (১৯৫৪), 'মুনিমজি' (১৯৫৫), 'দেবদাস' (১৯৫৫), 'হাউজ নং ৪৪' (১৯৫৫), ফান্টুস (১৯৫৬)─প্রভৃতি ছবিতে কখনও প্রেম, কখনও দুঃখ, কখনও ক্যাবারে─কী গান বাঁধেননি সাহির-শচীন জুটি! শচীনকত্তার জন্য লেখা গানে প্রচুর দৃশ্যকল্পের প্রয়োগ করেছিলেন সাহির। মানব-মানবীর প্রেম তাঁর লেখায় যেন প্রকৃতির মাধ্যমে ভাষা খুঁজে পেত। যেমন 'জাল' (১৯৫২) ছবির একটি গান, ‘ইয়ে রাত, ইয়ে চাঁদনি ফির কাহাঁ'তে লিখছেন,

পেড়োঁ কে সাখোঁ পে সোয়ি সোয়ি চাঁদনি
তেরে খ্যয়ালোঁ মেঁ খোয়ি খোয়ি চাঁদনি
অউর থোড়ি দের মেঁ থক কে লউট জায়েগি
রাত ইয়েহ বাহার কি ফির কভি না আয়েগি
দো এক পল অউর হ্যায় ইয়েহ সমা
শুন যা দিল কি দাস্তাঁ

প্রেমিকের আহ্বান এ'খানে ছড়িয়ে পড়ছে প্রকৃতির শরীরে। প্রকৃতি ধারণ করছে সেইসব অনুভূতি। কখনও প্রেম। আবার কখনও দুঃখ! 'ফান্টুস' (১৯৫৬) ছবির গান 'দুখি মন মেরে'। তাতে লিখছেন,

আপনে লিয়ে কব হ্যায় ইয়েহ মেলে
হম হ্যায় হর ইক মেলে মেঁ অকেলে
কেয়া পায়েগা উসমেঁ রেহকর
জো দুনিয়া জীবন সে খেলেঁ

গান-শরীরের এই দুঃখ মারাত্মক সংক্রামক। একাকীত্বের এই চরম বোধ থেকেই বোধহয় সাহিরের গানে বারবার ফিরে আসে, মৃত্যুর প্রসঙ্গ,

তেরি দুনিয়া মেঁ জিনে সে তো বেহতর হ্যায় কি মর জায়েঁ
ওহি আসুঁ, ওহি আহেঁ, ওহি গাম হ্যায় জিধর জায়েঁ

এই নাস্তিবোধ যে সাহিরের কাব্যদর্শনের সঙ্গে মেলে, তা 'তলখিয়াঁ'র পাতায় পাতায় স্পষ্ট। কী যেন এক যন্ত্রণায় গুমরে গুমরে উঠছে শব্দ। এ'সব গান জমি তৈরি করছিল। নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন গুরু দত্তও। মনে মনে নির্বাচিত করে ফেলেছিলেন সাহির এবং শচীনকত্তাকে 'প্যায়াসা'র (১৯৫৭) জন্য। 'প্যায়াসা' এমন এক তীর্থ, বা বলা ভালো পরিণতি, যাঁর দিকে নিজ নিজ পথে এগোচ্ছিলেন তিনটি মানুষ। নিজেদের সর্বোচ্চ শিখর ছুঁয়ে ফেলার ভবিতব্য নিয়েই হয়তো। গুরু দত্তের শ্রেষ্ঠ কাজ বলা হয় ছবিটিকে। শচীন-সাহির জুটির শ্রেষ্ঠ কাজ তো বটেই। অর্ধশতাব্দী পরেও, ২০০৫ সালে, টাইমস ম্যাগাজিনের 'সর্বকালের সেরা ১০০ ছবি'র তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল সেই ছবি।

আরও পড়ুন: স্টিয়ারিং বুকে লেগে স্পট ডেথ— সিনেমায় আর ফেরা হয়নি ছবি বিশ্বাসের

আশ্চর্যের বিষয়, ছবির বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে বহু জায়গায় সাহিরের রেফারেন্স ব্যবহার করা হয়েছে। তা নিয়ে চর্চাও কম হয়নি। জোশ মলিহাবাদি বা আহমেদ ফইজের মতো মানুষ খোলাখুলি বলেছেন, ছবির বিজয় আসলে সাহিরই। সেইসব রেফারেন্স অনিচ্ছাকৃত না ইচ্ছাকৃত─তা আজ জানার উপায় নেই। তবে ছবির দৃশ্য পরিকল্পনা নিয়ে সাহিরের লেখা গানগুলিতে তার খানিক পথনির্দেশ পাওয়া গেলেও যেতে পারে। সাহিরের কাব্যদর্শন এই ছবির গানে নিজেকে আর আড়াল করতে পারেনি। গুরু দত্ত দৃশ্য দিয়েছেন, সাহির লিখেছেন, ‘জিনহে নাজ হ্যায় হিন্দ পর, ও কাহাঁ হ্যায়?’ 'তলখিয়াঁ'র 'চাকলে' কবিতাটি একটু ভিন্ন ভাবে গান হয়ে এসেছে। গুরু দত্ত এক দশক আগেই কবিতাটি পড়েন। সে'দিন থেকে নাকি বন্ধু-বান্ধবকে বলে বেড়াতেন, এই কবিতা তাঁর ছবিতে একদিন না একদিন ব্যবহার করবেনই। অবশেষে সংলাপ রচয়িতা আবরার আলভি তাঁকে সেই সুযোগ দিলেন। মায়ের দুঃখে ক্ষত-বিক্ষত বিজয় পালিয়ে আসে ভাঁটিখানায়, বেশ্যাপল্লিতে। একটি শিশুর কান্নায় মাতাল বিজয়ের চমক ভাঙে। সমাজের এই বঞ্চিতরা কি বিচ্ছিন্ন কেউ? সাহির লেখেন,

ইয়েহ সদিয়োঁ সে বে-খফ সেহমি সি গলিয়াঁ
ইয়েহ মসলি হুয়ি অধ-খিলি জর্দ কলিয়াঁ
ইয়েহ বিকতি হুয়ি খোকলি রং-রলিয়াঁ
জিনহে নাজ হ্যায় হিন্দ পর ও কাহাঁ হ্যায়?

...

জরা মুলক কে রখবরোঁ কো বুলাও
ইয়েহ কুচেঁ ইয়ে গলিয়াঁ ইয়ে মঞ্জর দিখাও
জিনে নাজ হ্যায় হিন্দ পর ও কাহাঁ হ্যায়?
কাহাঁ হ্যায়, কাহাঁ হ্যায়, কাহাঁ হ্যায়?

বেশ্যাপল্লির চিত্রে যেন ঢুকে পড়ছে গোটা দেশই। জাতীয়তাবাদের উত্তাল উদযাপনের সময়ে সাহির কিন্তু স্রোতে গা ভাসাচ্ছেন না। তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন, প্রশ্ন করছেন রাষ্ট্রনেতাদের। প্রশ্ন করছেন তাঁদের গর্বকে। যে স্পর্ধায় প্রশ্ন তুলছে তাঁর গান, সেই স্পর্ধা হিন্দি সিনেমার গানে এখনও বিরল।

'প্যায়াসা'-কে মিউজিক্যাল ছবি বলা চলে। গীতিধর্মী ছবির অনেক গানের ভিড়ে, আরেকটি গান সাহিরের শ্রেষ্ঠতম বলে গণ্য আজও। সে'টি 'ইয়েহ দুনিয়া আগর মিল ভি জায়েঁ তো কেয়া হ্যায়!’ গানগুলি আগেই লিখে ফেলেছিলেন সাহির। সেই অনুযায়ী সুর দিয়েছিলেন শচীনকত্তা। গানগুলোর শুটিংও আগে সেরে রেখেছিলেন গুরু দত্ত। খুব উৎসাহে সত্য সরনকে গানগুলো দেখাচ্ছেন, সত্য বললেন, "কেলেঙ্কারি করে রেখেছেন তো!” 'মেহল', 'তখত', ‘তাজ'─এ'খন ব্রিটিশরাজের এইসব রেফারেন্স বা জমিদারির রেফারেন্সের সঙ্গে ছবির দৃশ্য যাবে কীভাবে? ছবিতে তো এমন কোনও সিকোয়েন্সই নেই। গান বদলানো আর সম্ভব ছিল না। কাজেই গান অনুযায়ী বদলে ফেলতে হল চিত্রনাট্যই। তারই ফল হিসেবে দর্শক পেলেন, মারা যাওয়ার পরে কবি হিসেবে বিজয়ের সম্বর্ধনার অসাধারণ দৃশ্যটি। যখন রহমান বলে, আজ যদি বিজয় বেঁচে থাকত, তাকে 'তখতে' বসিয়ে মাথায় 'তাজ' পরিয়ে দিত তারা। ঠিক তখনই আলোর দিকে পিছন ফিরে হলের দরজায় দাঁড়িয়ে বিজয় গাইতে শুরু করে,

ইয়েহ মেহলোঁ, ইয়েহ তখতোঁ, ইয়ে তাজোঁ কি দুনিয়া
ইয়েহ ইনসাঁ কে দুশমন, সমাজোঁ কি দুনিয়া
ইয়েহ দউলত কে ভুখে, রওয়াজোঁ কি দুনিয়া
ইয়েহ দুনিয়া অগর মিল ভি জায়ে তো ক্যা হ্যায়?

ইয়াহাঁ ইক খিলোনা হ্যায় ইনসাঁ কি হসতি
ইয়েহ বসতি হ্যায় মুর্দা-পরেস্তোঁ কি বসতি
ইয়াহাঁ পর তো জীবন সে হ্যায় মউত সস্তি
ইয়েহ দুনিয়া অগর মিল ভি জায়ে তো কেয়া হ্যায়?

ইয়েহ দুনিয়া জাহঁ আদমি কুছ নহি হ্যায়
ওয়াফা কুছ নহি, দোস্তি কুছ নহি হ্যায়
জাহাঁ প্যায়ার কি কদ্‌র হি কুছ নহি হ্যায়
ইয়েহ দুনিয়া অগর মিল ভি জায়ে তো কেয়া হ্যায়?

জলা দো ইসে ফুঁক ডালো ইয়েহ দুনিয়া
জলা দো জলা দো জলা দো, ইসে ফুঁক ডালো ইয়েহ দুনিয়া
মেরে সামনে সে হটা লো ইয়েহ দুনিয়া
তুমহারি হ্যায় তুম হি সমহালো ইয়েহ দুনিয়া!

যখন এই যাবতীয় দেউলিয়াপনা, খ্যাতির বিড়ম্বনা কবি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন। ছবির সেই আইকনিক দৃশ্যে সমসাময়িক সমাজকে, রাজনীতিকেও যেন ধিক্কার দেন সাহির। পুঁজির রাজনীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছত্রে ছত্রে প্রতিধ্বনি তোলে শ্রোতার ভিতরমহলে।

আরও পড়ুন: উত্তম কুমার: ফিরে পড়া এক সিনেমাজীবন

গানগুলিতে যেমন সুর দিয়েছিলেন শচীনকত্তা। তেমনই গেয়েছিলেন রফি। কিন্তু সে'বার সমস্ত খ্যাতি কেবল সঙ্গীত পরিচালক আর গায়কের ভাগ্যেই জুটল না, ছবি মুক্তি পাওয়ার দু'দিন বাদেই বিজ্ঞপন দেখা গেল, লিরিক্স অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। পোস্টারে শচীনকত্তার আগে লেখা হল সাহিরের নাম। এই প্রথম ভারতীয় গানের জগতে নিজের ভাগের আলো ছিনিয়ে নিলেন একজন গীতিকার। বিখ্যাত গীতিকার হওয়ার স্বপ্ন পূর্ণ হল সাহিরের। রেখে ঢেকে কথা বলা সাহিরের স্বভাবে ছিল না। 'প্যায়াসা' হিট করার পর তিনি বহু জায়গায় পরিষ্কার বললেন, তাঁর লেখা ছাড়া এইসব গানের জন্ম হত না। গানে গীতিকারের ভূমিকা সুরকারের থেকে অনেকখানি বেশি─এই ছিল তাঁর মত।

শচীনকত্তা ব্যাপারটা ভালো ভাবে নিলেন না। তিনি ঘোষণা করলেন, সাহিরের সঙ্গে আর কাজ করবেন না। গুরু দত্ত, দেব আনন্দ হাঁ হাঁ করে উঠলেন। বহু বোঝানোতেও ফল হল না। গীতিকারের খ্যাতি মেনে নেবেন সঙ্গীত-পরিচালক─এ হতে পারে না, শচীনকত্তার এক কথা। গুরু দত্তের পরের ছবি 'কাগজ কে ফুল'-এ (১৯৫৯) শচীনকত্তা দাবি করলেন, হয় তিনি থাকবেন, নয় সাহির থাকবেন ছবিতে। অগত্যা কইফি অজমিকে গীতিকার হিসেবে নিতে হল গুরু দত্তকে। সাহির-শচীন জুটি ভেঙে গেল চিরকালের জন্য। আর ক্ষতি? দুই ক্ষেত্রের দুই মহানায়ক দাপটের সঙ্গে কাজ করে গেলেন আজীবন। এক দশকে যে উচ্চতায় পৌঁছে ছিল তাঁদের জুটি, সেই মানের কাজ আর করতে পারলেন কিনা─তা হয়তো সঙ্গীতজ্ঞরাই বলতে পারবেন। গানপাগল মানুষেরা বঞ্চিত হলেন। তাঁদের যা দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল, সেই সব সম্ভাবনার আশা শ্রোতাদের আর কোনও দিনই পূর্ণ হল না। এক গীতিকারের খ্যাতি, দোসর সুরকারের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াল। দুই প্রতিভার মাত্র সাত বছরের যৌথসৃষ্টি আজও শ্রোতারা মাথায় করে রেখেছেন। আজও প্রেমে, আনন্দে, দুঃখে, বিষাদে তাঁদের ফিরে যেতে হয় সাত দশক আগের সেই সব গানে। যেখানে সাহিরের শব্দেরা, শচীনকত্তার সুরে ভর করে বিষাদের পাশে এসে বসে। প্রেমের আঙুলে নিজেদের চিরযৌবনের আঙুলটুকু রাখে। গাছেদের ডালে ডালে সবার অলক্ষে তখন জোৎস্না সরে সরে যেতে থাকে।

More Articles