প্রবীণ সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতাকে বারবার হেনস্থা, কীসের মাশুল?

NewsClick Journalists Harassed : পরঞ্জয় সাম্প্রতিক অতীতে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন করে দাবি করেন যে, তাঁর ফোন পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে হ্যাক করা হয়েছে।

দিল্লিজুড়ে হুলুস্থূল! ভোরবেলা একাধিক সাংবাদিকদের বাড়িতে অভিযান ও জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করার ঘটনায় আরও একবার যেন স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, নির্বাচন আসছে, আর তাই 'পথের কাঁটা' উপড়ে ফেলতে মরিয়া কেন্দ্র। দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল মঙ্গলবার ভোরে শহরের ৭ সাংবাদিকের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাঁদের ল্যাপটপ এবং মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করেছে। অভিযোগ? এই সাংবাদিকরা নাকি অবৈধ বিদেশি অনুদান ব্যবহার করছেন। বেশিরভাগ সাংবাদিকই নিউজ পোর্টাল নিউজক্লিকের সঙ্গে যুক্ত। পুলিশ এখানে একেবারে মোক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করেছে! এই নিউজ পোর্টালের বিরুদ্ধে বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন, বা ইউএপিএ-এর অধীনে মামলা দায়ের করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই।

নিউজক্লিক নিউজ পোর্টালে কর্মরত এক সাংবাদিককে আটকও করেছে দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল। আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। নিউজক্লিকের সঙ্গে যুক্ত ওই ৭ সাংবাদিকের বাসভবন সহ ৩৫টি জায়গায় এই বিশেষ সেল অভিযান চালিয়েছে। এই সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন সম্পাদক, প্রবীর পুরকায়স্থ, সাংবাদিক অভিসার শর্মা, অনিন্দ্য চক্রবর্তী এবং ভাষা সিং, রয়েছেন কৌতুকাভিনেতা সঞ্জয় রাজৌরা। সাংবাদিক ভাষা সিং, সাংবাদিক অভিসার শর্মার বাড়ি থেকে তাঁদের ল্যাপটপ এবং মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় দিল্লি পুলিশ। ইডি এর আগে অভিযোগ করেছিল যে, এই নিউজ পোর্টালটি চিনের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলির কাছ থেকে প্রায় ৩৮ কোটি টাকা অনুদান পেয়েছে এবং এই এত টাকা কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা নিয়ে তদন্ত চলছে। যারাই নিউজক্লিক থেকে বেতন বা পারিশ্রমিক পেয়েছেন তাদের নজরে রাখা হয়েছে। তাদের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে, ল্যাপটপ এবং ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

আরও পড়ুন- নিজের দলের সাংসদকে অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ, তবু কেন চুপ মায়াবতী?

হঠাৎ একটি পোর্টালের বিরুদ্ধে এত কেন তৎপর পুলিশ? কোন অবৈধ টাকার লেনদেনের কথাই বা বলা হচ্ছে? নিউজক্লিকের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের জন্য এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের নজরে অনেকদিন থেকেই রয়েছেন সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা। নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, নিউজক্লিক টাকা নিয়েছে নেভিল রায় সিংঘমের কাছ থেকে। এই নেভিল রায় সিংঘম আসলে চিনের সরকারি মিডিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। ইডি, নিউজক্লিকের প্রবর্তক এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে নেভিল রায় সিংঘমের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলি থেকে নিউজক্লিক স্টুডিও প্রাইভেট লিমিটেডে ৮৬ কোটি টাকারও বেশি বিদেশি অনুদান আসার অভিযোগ তদন্ত করছে। ইডি আরও দাবি করে যে, ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা প্রবীর পুরকায়স্থ এবং ট্রাইকন্টিনেন্টাল এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর বিজয় প্রসাদকে নেভিল রায় সিংঘম একটি ইমেল পাঠান যেখানে একটি চিনা প্রচারমূলক চলচ্চিত্রের সাবটাইটেলিংয়ের কথা বলা হয়েছে।

তদন্তকারী এই সংস্থা নিউজক্লিক থেকে কর্মী তিস্তা শীতলাবাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকার ফান্ড ট্রান্সফার, সাংবাদিক ও লেখক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা, নিউজক্লিকের কিছু কর্মচারী এবং আরও কয়েকজনকে প্রায় ৭২ লক্ষ টাকা পাঠানোর অভিযোগও তদন্ত করছে। অভিযোগ, নিউজক্লিক জেলবন্দি কর্মী গৌতম নাভলাখাকে বেতন হিসাবে ১৭.০৮ লক্ষ টাকা, নিউজক্লিকের শেয়ারহোল্ডার এবং সিপিআই(এম)-এর আইটি সেলের সদস্য বাপ্পাদিত্য সিনহাকে ৯৭.৩২ লক্ষ টাকা দিয়েছে৷

প্রসঙ্গত, পরঞ্জয় সাম্প্রতিক অতীতে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন করে দাবি করেন যে, তাঁর ফোন পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে হ্যাক করা হয়েছে। আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে টানা লিখে গেছেন পরঞ্জয়। হিন্ডেনবার্গও তাঁর নাম উল্লেখ করেছে আদানির কীর্তিফাঁসে। মিডিয়া এথিক্স, ফেসবুক মুখ ও মুখোশের মতো বিতর্কিত বইয়ের লেখক সাংবাদিক পরঞ্জয় দীর্ঘকাল ধরেই আদানি গোষ্ঠী, ও তাদের শাসক ঘনিষ্ঠতার বিরুদ্ধে সরব। রবি নায়ার ও পরঞ্জয়ের বই 'দ্য রাফাল ডিল: ফ্লাইং লাইজ?’ নিয়েও প্রভূত তর্ক হয়। শাসকের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার নিয়েও নিবিড় কাজ করেছেন তিনি। ইনস্ক্রিপ্টে নিয়মিত লেখালিখি এবং 'বাংলা যা ভাবছে' অনুষ্ঠানেও নিয়মিত নিজের বক্তব্য রাখেন পরঞ্জয়।

 

পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা নিজেই জানিয়েছিলেন ২০১৮ সালের মে মাস থেকে নিউজক্লিক পোর্টাল পরিচালনা, মালিকানা এবং পরিচালনাকারী সংস্থার পরামর্শদাতা (কনসালট্যান্ট) ছিলেন তিনি। এই পাঁচ বছর ধরে তাঁর সাম্মানিকই তিনি গ্রহণ করেছেন। তিনি করও দেন, নিয়মিত আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। পরঞ্জয়ের দাবি, তিনি PPK নিউজক্লিক স্টুডিও প্রাইভেট লিমিটেডের কর্মচারী নন, সম্পাদক মণ্ডলী বা পোর্টালে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার অংশও তিনি নন।

আরও পড়ুন- সারা বিশ্বের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেল নরেন্দ্র মোদির নির্বুদ্ধিতা

 

নিউজক্লিকের অফিস এবং এর প্রধান সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থর বাড়িতে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট অভিযান চালায়। গত বছর, দক্ষিণ দিল্লির সাকেত এলাকায় অবস্থিত ৪.৫২ কোটি টাকার একটি ফ্ল্যাট এবং ৪১ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট ঘিরে অভিযোগ ওঠে প্রবীর পুরকায়স্থর বিরুদ্ধে। প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট (PMLA) অনুযায়ী, এই সাড়ে চার কোটি টাকার সম্পত্তি সোজা পথে উপার্জিত আয়ের অংশ নয় বলে অভিযোগ। ইডির মতে, ২০১৮ থেকে ২০২১ পর্যন্ত নিউজক্লিক জাস্টিস অ্যান্ড এডুকেশন ফান্ড ইনক ইউএসএ, দ্য ট্রাইকন্টিনেন্টাল লিমিটেড ইনক ইউএসএ, জিএসএএন এলএলসি ইউএসএ, সেন্ট্রো পপুলার, ডি মিডাস থেকে ৭৬.৮৪ কোটি, ১.৬১ কোটি, ২৬.৯৮ লাখ এবং ২.০৩ লাখের 'এক্সপোর্ট রেমিট্যান্স' গ্রহণ করেছে। অথচ এই সংস্থাগুলিতে নিউজক্লিক কোনও পরিষেবাই দেয়নি। ইডির সন্দেহ, জাস্টিস অ্যান্ড এডুকেশন ফান্ড ইনকর্পোরেটেড ইউএসএ-এর মাধ্যমে পাঠানো অনুদানগুলি আসলে সিংঘমের। সিংঘম প্রবীর পুরকায়স্থের 'ঘনিষ্ঠ' এবং 'চিনের বিশ্বস্ত'। ইডির অভিযোগ, সিংঘম এই নিউজ পোর্টালের বিষয়বস্তুকে প্রভাবিত করছে এবং 'পেইড নিউজ' প্রচার করা হচ্ছে। সাকেতের ওই ফ্ল্যাটের রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কারের জন্য বিপুল অনুদানও চিনেরই সৌজন্যে।

এবার নিউজক্লিকের সাংবাদিকদের উপর এমন অভিযান ও আটকের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়া। সাংবাদিকদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে এবং সরকারকে এই ধরপাকড়ের বিস্তারিত জানানোর দাবিও করেছে প্রেসক্লাব।

More Articles