৫০ হাজার গর্ভবতী মহিলা যুদ্ধের শিকার! প্রিম্যাচিওর শিশুদের মৃত্যু দেখবে গাজা?

Gaza Premature Babies : ইউএনএফপিএ-র অনুমান গাজায় ৫০,০০০ গর্ভবতী মহিলা এই যুদ্ধের শিকার। প্রতিদিন ১৬০ টিরও বেশি প্রসব হচ্ছে গাজায়।

৬ অক্টোবর। হামাস আক্রমণ করেছে ইজরায়েল। একের পর এক রকেটে দক্ষিণ ইজরায়েলের নানা জায়গায় হামলা। ঠিক সেই দিনই গাজায় জন্ম নিয়েছে তালিয়া। জন্মের কিছু পরেই তাঁর শরীরের নীল আভা ক্রমেই কমতে থাকে। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের নাসের মেডিকেল হাসপাতালের চিকিত্সকরা সামান্য চিন্তায় পড়ে যান। একরত্তি বাচ্চা, ফুসফুস এখনও নিজের মতো করে কাজ করার মতো শক্তিশালী নয়। তালিয়ার জন্য বিশেষ যত্ন দরকার। বিপ বিপ আওয়াজের যান্ত্রিক ভেন্টিলেটরের দরকার। তালিয়া প্রিম্যাচিওর শিশু। এমন শিশুর ফুসফুসে অক্সিজেন পৌঁছতে বিশেষ ব্যবস্থা লাগে। অক্সিজেন ট্যাঙ্ক থেকে পাতলা একটি টিউব নরম শরীরে প্রাণবায়ু পৌঁছে দেয়। একটি মনিটর ওই কচি হৃদয়ের দুর্বল ওঠানামাকে নজরে রাখে। কিন্তু গাজায় ৭ অক্টোবর থেকে যা অবস্থা তাতে, ফিলিস্তিনি প্রিম্যাচিওর শিশুরা বাঁচবে কীভাবে?

গাজা উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাসপাতালগুলি জানিয়েছে, ইজরায়েল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়াতে জ্বালানি পাচ্ছে না গাজা। ফলে হাসপাতালে জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেলে, বেঁচে থাকার জন্য বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটরের উপর নির্ভরশীল নবজাতক শিশু কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যেতে পারে। ইতিমধ্যেই জ্বালানির ঘাটতির কারণে গাজার একমাত্র ক্যান্সার হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুন- বোমা-রকেটে ছারখার গাজা! কেন পিরিয়ড বন্ধের ওষুধ খুঁজছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত মহিলারা!

নাসেরের শিশু ও নবজাতক বিশেষজ্ঞ আসাদ আল-নাওয়াজা আল জাজিরাকে জানান, নবজাতকদের মৃত্যুর আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। হাসপাতালের জেনারেটর চালানোর জন্য এবং গাজায় শিশু, অসুস্থ এবং আহতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহের আবেদন করছেন তারা।

হাসপাতালের নবজাতকদের জরুরি বিভাগে ১০টি শিশু রয়েছে। অনেকেই জন্মের নির্দিষ্ট দিনের চার সপ্তাহ আগেই জন্মগ্রহণ করেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অনুমান, গাজা জুড়ে প্রায় ১৩০ জন নবজাতক শিশু ইনকিউবেটরের উপর নির্ভরশীল।

তালিয়ার মা সমর আওয়াদ জানান, শিশুকন্যার জন্মের সময়টা বিশেষ ভালো ছিল না। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন শিশুর ফুসফুসে জল রয়েছে এবং তাই নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার। সেই থেকে মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেননি তিনি।

গাজা উপত্যকায় ৭ অক্টোবর থেকে নিরলস বোমাবর্ষণ চলছে। হামাস দক্ষিণ ইজরায়েলে ৬ অক্টোবর হামলা চালায়, তাতে কমপক্ষে ১,৪০০ মানুষের প্রাণ যায়। এই হামলার প্রতিশোধে ইজরায়েল গাজায় যুদ্ধ শুরু করে। গাজায় এখনও অবধি ৯,০০০ এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ৩,০০০ এরও বেশি শিশু রয়েছে।

ইজরায়েল সরকার গাজার উত্তর অংশ খালি করার আদেশ জারি করে। তারপর থেকেই দক্ষিণের খান ইউনিস এবং রাফাহ জেলাগুলিতে হাজারে হাজারে শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছেন। ইজরায়েল নাগরিকদের প্রাণ বাঁচাতে দক্ষিণে চলে যেতে আদেশ দিলেও, দক্ষিণ অংশেও নিয়মিত বিমান হামলা চলছে। খান ইউনিসে আত্মীয়দের বাড়িতেই এসেছেন তালিয়ার মা। যে কোনও মুহূর্তে বোমা তাঁর স্বামী এবং তিন বছরের ছেলেকে শেষ করে দিতে পারে তিনি জানেন। জানেন যে কোনও মুহূর্তে তাঁর নবজাতক শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখার যন্ত্রটিও থেমে যেতে পারে।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউএনএফপিএ-র অনুমান গাজায় ৫০,০০০ গর্ভবতী মহিলা এই যুদ্ধের শিকার। প্রতিদিন ১৬০ টিরও বেশি প্রসব হচ্ছে গাজায়। এদের মধ্যে ১৫ শতাংশ শিশুরই জন্ম সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দিচ্ছে। ফিলিস্তিন রাজ্যের ইউএনএফপিএ প্রতিনিধি ডমিনিক অ্যালেন বলছেন, এই মহিলাদের অবিলম্বে প্রসূতিকালীন জরুরি যত্নের প্রয়োজন। সমস্যা আরও মারাত্মক কারণ যুদ্ধের ট্রমাও মহিলাদের অভাবনীয় সঙ্কটে ফেলেছে।

আরও পড়ুন- ২০ দিনে ৩,৩০০ শিশুর মৃত্যু! কেন এত শিশু মারা যাচ্ছে গাজার যুদ্ধে?

গাজার অন্তত এক-তৃতীয়াংশ হাসপাতাল- ৩৫টির মধ্যে ১২টি, এবং প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র- ৭২টির মধ্যে ৪৬টিই ক্ষতিগ্রস্ত বা জ্বালানির অভাবের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে যে ক'টি এখনও খোলা আছে তার উপর চাপ বাড়ছে। ইজরায়েল সম্প্রতি মিশর থেকে রাফাহ সীমান্ত দিয়ে কয়েকটি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু এতে জ্বালানির প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইজরায়েল বলছে ডিজেল প্রবেশের অনুমতি দিলে তা হামাস সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে।

গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতাল ফিলিস্তিনের বৃহত্তম চিকিৎসা কেন্দ্র কম্পাউন্ড। সেখানকার অকাল ও নবজাতক শিশু বিভাগের প্রধান নাসের ফুয়াদ বুলবুল বলছেন, জলের তীব্র ঘাটতি সেখানে। জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্টগুলিও বন্ধ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ জানাচ্ছে, গাজায় খাওয়া, ধোওয়া, রান্না এবং টয়লেট ফ্লাশ সহ মৌলিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে বর্তমানে দিনে মাত্র তিন লিটার জল পাওয়া যায়। অথচ এই জলের ন্যূনতম দৈনিক পরিমাণ ৫০ লিটার। ডিহাইড্রেশনে শিশুমৃত্যুও বাড়তে পারে অচিরেই।

খান ইউনিসের বাসিন্দা লিনা রাবি অনেক কাল ধরে সন্তান ধারণের চেষ্টা করেছেন। অবশেষে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগে পুত্রের জন্ম দেন। আটমাসের মধ্যেই জন্ম হয়ে যায় ওই শিশুর। নাসের হাসপাতালে একটি ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে নবজাতককে। অথচ লিনা জানেন না সন্তান ফিরবে কিনা। হয়তো ইউকিউবেটর বন্ধ হয়ে যাবে অচিরেই। হয়তো মৃত ৩,৫০০ শিশুর তালিকাতেই জুড়ে যাবে তাঁর শিশুটিও। যুদ্ধে তো এসব হয়েই থাকে।

More Articles