অভিজিৎ একা নন, আদালত থেকে সরাসরি রাজনীতিতে এসেছেন যে সব বিচারপতিরা

Judges in Politics : সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি বহরুল ইসলাম অবসর নেওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে পদত্যাগ করে বরপেটা থেকে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের হয়ে লড়েন।

কলকাতা হাইকোর্টে এর আগে এমন ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু বিচারপতি থাকা অবস্থাতেই পদত্যাগ ঘোষণা করে রাজনৈতিক ময়দানে নামার ঘটনা ভারতে নতুন নয়। এর আগেও যে তর্ক হয়েছে, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের অবসর ও রাজনীতিতে যোগদানের ঘোষণায় সেই তর্কই উঠেছে ফের। আদালতের প্রাক্তন বিচারকরা কি অবসরের বা পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই কোনও রাজনৈতিক শিবিরে যোগ দিতে পারেন? ১৯৪৯ সালের ৭ জুন কে টি শাহ গণপরিষদের সামনে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি জানান, সাংবিধানিক আদালতের বিচারকদের অবসর গ্রহণের পরে কোনও কার্যনির্বাহী পদ গ্রহণে বাধা দেওয়া উচিত।

বলা হয়, যিনি সুপ্রিম কোর্ট বা ফেডারেল কোর্ট বা কোনও হাইকোর্টের বিচারক পদে থেকেছেন ৫ বছর ধরে, তাকে কেন্দ্রের কোনও রাজ্যের সরকারের অধীনে ভারত সরকারের অধীনস্থ কোনও নির্বাহী অফিসে নিয়োগ করা হবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রদূত, মন্ত্রী, হাইকমিশনার, ট্রেড কমিশনার, হতে পারবেন না। আম্বেদকর কিন্তু বলেছিলেন, “বিচারব্যবস্থা অনেকাংশে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়: এটি জনগণের অধিকার এবং কিছুটা ভারত সরকারের অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত…"। আম্বেদকর উল্লেখ করেছিলেন, ভারতীয় বিচারকরা অপেক্ষাকৃত কম বয়সে অবসর নেন। তাই কোনও পদে থাকার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়াটা আখেরে বোঝা বাড়াবে। তবে, আলোচনা-বিতর্ক সত্ত্বেও অবসর-পরবর্তীকালে বিচারকদের বিষয়ে সাংবিধানিক নীরবতার ইতি ঘটেনি।

১৯৫২ সালে নেহেরু ওড়িশার রাজ্যপাল হিসাবে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি স্যার সৈয়দ ফজল আলিকে নিযুক্ত করেন। এম সি চাগলা ১৯৫৮ সালের ২৬ অক্টোবর বম্বে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসাবে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। নেহেরু অবিলম্বে চাগলাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এবং পরে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার নিযুক্ত করেন। চাগলা নেহেরুর মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রীও হন পরে। ১৯৬৬ সালে ইন্দিরা গান্ধির মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন চাগলা।

আরও পড়ুন- কেন তমলুক আসন থেকে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রার্থী করবে বিজেপি?

ষাটের দশকের শেষের দিকে বিচার বিভাগের সঙ্গে ইন্দিরার দ্বন্দ্ব বাড়তে শুরু করলে, প্রধান বিচারপতি কে সুব্বা রাও ১৯৬৭ সালের ১১ এপ্রিল পদত্যাগ করেন এবং রাষ্ট্রপতি পদে বিরোধী প্রার্থী হন। তবে ইন্দিরার মনোনীত প্রার্থী জাকির হোসেনের কাছে হেরে যান তিনি। সাংবিধানিক আদালতের বিচারক পদত্যাগ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশের এটাই প্রথম বড় ঘটনা। জাকির নিজেও ছিলেন বিচারক।

বিচারপতি কে এস হেগডেও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, লোকসভার স্পিকার হিসাবেও কাজ করেছেন। হংস রাজ খান্না এডিএম জবলপুরের মামলার পরে পদত্যাগ করে তিন দিনের জন্য চরণ সিং সরকারের কেন্দ্রীয় আইন ও বিচার মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কংগ্রেসের আমলে বহরুল ইসলাম, রঙ্গনাথ মিশ্রের মতো বিচারপতিরাও সরাসরি সংসদীয় রাজনীতিতে আসেন।

সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি বহরুল ইসলাম ছিলেন অসমের মানুষ। অবসর নেওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে পদত্যাগ করে বরপেটা থেকে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের হয়ে লড়েন বহরুল। আটের দশকের সেই সময় অসমে তখন জাতিদাঙ্গার লড়াই, বাঙালিদের উপর নিপীড়ন চলছে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি চরম বিপাকে। বহরুল ইসলাম ছিলেন রাজ্যসভার সদস্য। তারপরে রাজ্যসভা থেকে পদত্যাগের পর অসম ও নাগাল্যান্ড হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন তিনি। পরে আবার প্রধান বিচারপতিও হন। সেখান থেকে পদত্যাগ করার পর তাঁকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট থেকে পদত্যাগ করে তিনি নির্বাচনে লড়েন। তাই দেশের অন্যত্র এমন নজির আগে থেকেই ছিল তবে কলকাতা হাইকোর্টে এর আগে এমনটা ঘটেনি।

১৯৯২ সালে তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল হিসাবে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ফাতিমা বেভি এবং ২০১৪ সালে কেরলের রাজ্যপাল হিসাবে সাথশিবমের যোগদান প্রমাণ করে বিচার ব্যবস্থা থেকে সরে এসে অনেকেই দেশের নানা রাজ্যেরই রাজ্যপাল হয়েছেন। বিচারপতি এস আব্দুল নাজিরও ২০২৩ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যপাল হিসাবে নিযুক্ত হন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ থেকে সরে আসার চার মাসের মধ্যে রঞ্জন গগৈও রাজ্যসভার মনোনয়ন পান।

এই সমস্ত ক্ষেত্রেই প্রশ্ন উঠেছিল বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়ে। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও তাই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে তাঁর রায়, সিদ্ধান্ত সবই কি তাহলে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ছিল? সাধারণ মানুষ যাকে আইনের 'দেবতা' ভেবেছেন তিনি কি আসলে রাজনীতির আখের গোছাতেই এমন করলেন?

More Articles