হামলার বিরাম নেই, রক্ত আর খিদে দিয়েই রমজান শুরু গাজায়

Is­rael’s war on Gaza: রমজানের প্রথম রাতেই গাজার দক্ষিণে রাফাহ শহরে নতুন করে হামলা চালিয়েছে ইজরায়েলি বাহিনী। যেখানে আশ্রয় নিয়ে অসংখ্য গাজার সবহারানো মানুষ।

রমজানের আগে যুদ্ধবিরতির কথা বলেছিল ইজরায়েল। তবে আদপে তেমনটা হল না। বরং ফের রক্ত দিয়েই রমজান শুরু হল গাজাবাসীর। এবারের রমজানে প্রতিবছরের মতো কোনও কিছুই নেই। আছে তো শুধু খিদে আর চারদিকে রক্ত। প্রতিবছর এই সময়টায় উপবাসে কাটান পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম। ভুখা পেটে দিন কাটাচ্ছেন প্যালেস্টাইনের অসংখ্য মুসলিম। অথচ তার সঙ্গে পবিত্র শব্দটার কোনও সম্পর্কই নেই। প্রায় ৬ মাস ধরে ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে লাগাতার মরছে গাজার মানুষ। এখনও পর্যন্ত একত্রিশ হাজারেরও বেশি বাসিন্দার মৃত্যু হয়েছে ইজরায়েলের হামলায়।

পবিত্র রমজানের আগে গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার কথা বলেছিল ইজরায়েল। তবে তার বিনিময়ে এক গুচ্ছ শর্ত দেওয়া হয়েছিল হামাসকে। তিন বারের বৈঠকের পরেও কোনও রফাসূত্র বেরোয়নি। এর আগেও দিন চারেকের সংঘর্ষবিরতি ঘোষণা করেছিল ইজরায়েল। তবে সেই সময়েও অতর্কিতে হামলা চালিয়ে গিয়েছিল নেতানিয়াহু সেনা। ফলে তাদের যুদ্ধবিরতিতে তেমন ভরসা নেই প্যালেস্টাইনের। রমজান উপলক্ষে যুদ্ধবিরতির কথা হলেও শেষপর্যন্ত তা হয়নি। বরং গাজাবাসীর রমজান মাসের শুরুটাই হয়েছে ইজরায়েলি বোমায়।

প্রতি বছর রমজান উপলক্ষে সেজে উঠত প্যালেস্টাইন। ওল্ড সিটির পুরনো বাজারে রমজান উপলক্ষে মিলত দুর্দান্ত সব খাবারদাবার। টক আচার থেকে শুরু করে খেজুর, জলপাই, বিভিন্ন রকম মশলা, ফল। দোকান বসত ইতিউতি ফলের রস ও অন্যান্য খাবারের। অন্যদিকে ভিড় জমাতেন পোশাক বিক্রয়কারীরা। ইদের জন্য চলত কেনাকাটা। আলোয়, ভিড়ে, গানে সেজে উঠল গোটা শহর। এমনটাই ছিল বিগত কয়েক বছর ধরে রমজান মাসের চল। ইফতারের জন্য প্রতিবেশীদের বাড়িতে জমে উঠত ভিড়। সকলে একসঙ্গে বসে ভাঙতেন উপবাস। এই সময় কাফায়েফ নামক বিশেষ এক ধরনের মিষ্টি তৈরি করতেন ঘরে ঘরে মায়েরা। সেই সুগন্ধ ছড়িয়ে থাকত বাতাসময়। এখন গাজা-সহ প্যালেস্টাইনে অধিকাংশ এলাকার বাতাসেই বারুদের গন্ধ। যুদ্ধ যেন নিমেষে বদলে দিয়েছে সব কিছু।

আরও পড়ুন: রমজান শুরুর দিনটিই কেন সিএএ ঘোষণার জন্য বেছে নিলেন মোদি?

রমজানের প্রথম রাতেই গাজার দক্ষিণে রাফাহ শহরে নতুন করে হামলা চালিয়েছে ইজরায়েলি বাহিনী। যেখানে আশ্রয় নিয়ে অসংখ্য গাজার সবহারানো মানুষ। গত ২৪ ঘণ্টায় ফিলিস্তিনি হামলায় নতুন করে অন্তত ৬৭ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। রমজানের সঙ্গেই মিলতে পারে সামান্য হলেও যুদ্ধশান্তি, এমনটাই আশা করেছিল গাজার বাসিন্দারা। তবে তেমনটা হয়নি। তবু প্রার্থনাটুকু করতে ভোলেননি মানুষ। বোমায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া মসজিদে জড়ো হয়েছেন রমজানের প্রার্থনাটুকু সারতে। যেখানে সেটুকুও বেঁচে নেই, সেখানে ভরসা বলতে অস্থায়ী শরণার্থী শিবির। তা-ও যে যেকোনও মুহূর্তে গুঁড়িয়ে যাবে না ইজরায়েলি বোমায়, সেই গ্যারান্টিই বা কোথায়!

এই পবিত্র রমজান মাসে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস করে থাকেন মুসলিমেরা। সেই জন্য সেহরি হিসেবে ও উপবাস ভাঙার সময়ে পুষ্টিকর কিছু খাবারদাবার খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। তবে গাজায় এসব ভাবনাই এখন যেন বিলাসিতা। দেখতে দেখতে যুদ্ধের ১৫৮ দিনে পড়েছে যুদ্ধ। যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই যেটা আসে, সেটা দুর্ভীক্ষ। গাজাতেও তেমনটাই হয়েছে। গোটা গাজা জুড়ে এখন খাবার আর পানীয় জলের হাহাকার। সাহায্যের জন্য খাবার-জল নিয়ে ট্রাক আসে। কিন্তু সেই অযুত-নিযুত মানুষের ভিড় থেকে এক পাত্র জল বা একটুখানি আটা জোগার করা এক অন্য লড়াই। দেশ জুড়ে সবাই ক্ষুধার্ত। সেই ক্ষুধা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সহায়তাকারী সংস্থাগুলি। তার মধ্যে খাবারের লাইনে কখনও ছুটে আসছে ইজরায়েলি বাহিনীর গুলি, কখনও আবার আকাশ থেকে নামছে বোমা। গত কয়েক মাস ধরেই অনাহারে কাটছে গাজাবাসীর। পবিত্র রমজান মাসে স্বেচ্ছায় উপবাস করেন ইচ্ছুক মুসলিমরা। তবে গাজায় ইচ্ছা-অনিচ্ছার জায়গাটুকুও বেঁচে নেই এখন। বাজারে সমস্ত জিনিসের আকাশছোঁয়া দাম। সেসব কেনার সামর্থ নেই মানুষের। নিজস্ব বাড়িঘর ছেড়ে অস্থায়ী শিবিরগুলোই এখন শেষ আশ্রয় গাজাবাসীর। এখন সেখানে কান পাতলেই শুধু কান্না আর হাহাকারের শব্দ।

গাজায় যুদ্ধের যেন শেষ নেই। এর মধ্যেই লাগাতার চলছে গুলি। গাজা তো বহুদিন আগেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সেখানে এখন মাটি খুঁড়লেই মিলবে লাশের পাহাড়। ইজরায়েলি বাহিনীর সাম্প্রতিকতম হামলায় দু'সপ্তাহে অন্তত চারশো জনের মৃত্যু হয়েছে গাজায়। কিছুদিন আগেই আটা বিলোতে আসা ট্রাকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে নিশানা করে গুলি ছুড়তে শুরু করেছিল ইজরায়েলি সেনা। মৃত্যুর পাশাপাশি অসংখ্য লোক জখম হয়েছিল ওই হামলায়। গাজায় যথাযথ চিকিৎসার পরিকাঠামো বলতে আর কিছু বেঁচে নেই। এই পরিস্থিতিতে বহু আহতেরই মৃত্যু হয়েছে পরবর্তীতে। তার উপর অনাহারের চাবুক তো রয়েইছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, উত্তর গাজার আল শিফা হাসপাতালে কিছু সাহায্য পৌঁছে দিতে পেরেছে তারা। রয়েছে খাবারদাবার ও চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। তবে সেসব দিয়ে কতটা অভাব মিটবে বলা কঠিন। যাঁরা চিকিৎসা করবেন, সেই সব স্বাস্থ্যকর্মীদের অবস্থাও শোচনীয়। ফলে গাজায় মানুষ যে কীভাবে বেঁচে রয়েছেন এখনও, তা-ই আসলে বিস্ময়।

 

এদিকে, রমজান মাস শুরু হতে না হতে আতঙ্কে কাঁপছে জেরুজালেম। গোটা বিশ্ব ভেবেছিল রমজান উপলক্ষে অন্তত কিছুদিনের জন্য গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করবে প্যালেস্টাইন। সেই চুক্তিতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছিল আমেরিকা, কাতার ও মিশর। তবে কাজের কাজ হয়নি। গোটা বিশ্বের প্রত্যাশাকে মাটিতে মিশিয়ে যুদ্ধ থামানোর শর্তে রাজি হয়নি কোনও পক্ষই। বিফলে গিয়েছে সমস্ত আলোচনা। ইজরায়েলের বাসিন্দারাও প্রত্যাশা করেছিলেন, অন্তত রমজান মাসে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করবে ইজরায়েল। এখন প্যালেস্টাইন জুড়ে শুধু বিষন্নতা আর হাহাকার। চেনা রমজানের সুরখানা এ বছর হারিয়েছে যুদ্ধের বাজারে। এদিকে, ইজরায়েলের রাজধানী জেরুজালেমেও যেন স্বস্তি নেই। মাস ছয়েক আগেই ইহুদিদের পবিত্র দিনে ঢুকে পড়েছিল ফিলিস্তিনি জঙ্গিগোষ্ঠী হামাস। কার্যত সন্ত্রাস চালিয়েছিল তারা ইজরায়েল জুড়ে। অসংখ্য বাসিন্দাকে খুন, ধর্ষণ, পণবন্দি বানানো- কী করেনি তারা। রমজান শুরু হতেই জেরুজালেম জুড়ে যেন ভয়ের আবহ। বহুদিন ধরেই ইজরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাতের অভিকেন্দ্র ছিল জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ।

আরও পড়ুন:হামাস-ইজরায়েল আলোচনা বিফলে! রমজানেও শান্তি ফিরবে গাজায়?

ইতিমধ্যেই রাজধানী জুড়ে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। এমনকী পবিত্র মাসের প্রথম দিনে প্রার্থনার জন্য বহু ফিলিস্তিনিকেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি মসজিদে। চালানো হয়েছে লাঠিও। গত ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামাস হামলার পর থেকেই আল-আকসা মসজিদে ইজরায়েল ও ইজরায়েল অধিকৃত প্যালেস্টাইনে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। গত সপ্তাহেই প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু জানিয়ে দেন, শুধুমাত্র ইজরায়েলিরাই মসজিদে ঢুকতে পারবেন। যেখানে আগে প্রথম এক সপ্তাহ অন্তত ফিলিস্তিনিরা ওই মসজিদে ঢুকতে পারতেন। কিন্তু যুদ্ধের আবহে সে সব কিছুই গিয়েছে পাল্টে। আগেও রমজান ঘিরে অশান্তির মুখে পড়ছে আল আকসা মসজিদ। এবার যুদ্ধের পরিস্থিতিতে যে কড়াকড়ি বাড়বে, তাতে আর নতুন কী!

সব মিলিয়ে রমজান কোনও আশার আলো দেখাতে পারেনি গাজাবাসীকে। তবু রমজান মাসের প্রতিটি প্রার্থনায় শান্তিটুকুই চেয়ে চলেছেন প্যালেস্টাইনের প্রতিটি মানুষ। শুধু ফিলিস্তিনিরাই নয়, এই পবিত্র মাসে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে সওয়াল করেছে কানাডা-সহ বহু দেশের মানুষরাই। তবে গাজাকে পুরোপুরি না ধ্বংস করে বোধহয় বিশ্রাম নেবে না ইজরায়েল। আর সেই সম্ভাবনাই আরও প্রবল হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে।

More Articles