বিজেপির বিরুদ্ধে বললেই টুইটার বন্ধের হুমকি দিয়েছিল সরকার! অভিযোগ কতখানি সত্য?

Jack Dorsey Indian Twitter Remark: বিজেপির নেতা সম্বিত পাত্র বলছেন, রাহুল গান্ধিই নেপথ্যে ডরসির পুতুল নাচাচ্ছেন।

ভারতে ব্যবসা করতে হলে রাজার কৃপাদৃষ্টিতেই রইতে হবে। নচেৎ, বিতাড়িত হতে হবে এই গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের চৌহদ্দি থেকে। রাজার পোশাকে রয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, আর ব্যবসায়ীদের তো ইয়ত্তা নেই। দেশের অন্যতম বড় আন্তর্জাতিক ব্যবসা সোশ্যাল মিডিয়ার। আর সেই সোশ্যাল মিডিয়ার অন্যতম বড় অংশ টুইটার। এই টুইটারকেই পড়তে হয়েছে বিজেপির হুমকির মুখে! সরকারের সমালোচনা করা টুইটার অ্যাকাউন্টগুলির বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেবে না টুইটার? কেন এদেশে বসেও সরকারের সমালোচনাকে প্রচার করবে টুইটার? মারাত্মক অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। যদি টুইটার ভারতে কৃষক বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে সরকারের সমালোচনা করা টুইটার অ্যাকাউন্টগুলিকে 'রেস্ট্রিক্ট' না করে, তাহলে দেশে টুইটার বন্ধ করার হুমকি দিয়েছিল বিজেপি সরকার! অভিযোগ এই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসির। নরেন্দ্র মোদির সরকার স্বাভাবিকভাবেই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

২০২১ সালে জ্যাক ডরসি টুইটারের প্রধান কার্যনির্বাহীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। বছর দুয়েক পর এক মারাত্মক অভিযোগ এনে ফের আলোচনার টেবিলে তুলে দিয়েছেন সরকার আর সোশ্যাল মিডিয়ার সম্পর্ককে। জ্যাক ডরসির অভিযোগ, বিজেপির বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট পোস্টগুলি সরিয়ে নেওয়ার সরকারি অনুরোধ মেনে না নিলে ভারত সরকার টুইটারের কর্মীদের উপর নজরদারি চালানোর হুমকিও দিয়েছিল। তবে বিজেপির বক্তব্য, ডরসি নিজে নন, তাঁকে এসব বলাচ্ছে কংগ্রেস। বিজেপির নেতা সম্বিত পাত্র বলছেন, রাহুল গান্ধিই নেপথ্যে ডরসির পুতুল নাচাচ্ছেন। প্রশ্ন ওঠেই, দেশেই যাকে বিজেপি একটি মাত্র আসন থেকেই উৎখাত করে দিয়েছে, বিরোধী স্বর হিসেবে তাঁর কথা উঠলেই যেখানে শাসকদল ঝাঁপিয়ে পড়ে দমিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, সেই রাহুল গান্ধি বিশ্বের 'টেক জায়ান্ট'-কে কীভাবে নাচাতে পারেন? কীভাবেই বা ক্ষমতাহীন একজন নেতার কথায় ডরসি এমন কঠিন অভিযোগ তুলতে পারেন?

 

আরও পড়ুন- উঠে এসেছে গুজরাত দাঙ্গার ভয়াবহতা, মোদিকে নিয়ে বিবিসির তথ্যচিত্র ফের তৈরি করল বিতর্ক

ইউটিউব নিউজ শো ব্রেকিং পয়েন্টকে একটি সাক্ষাত্কারে ডরসি বলেন, “বলা হয়েছিল যে, ‘আমরা ভারতে টুইটার বন্ধ করে দেব’। ভারত আমাদের জন্য খুব বড় একটা বাজার। বলা হয়, ‘আমরা আপনাদের কর্মচারীদের বাড়িতে অভিযান চালাব’, সেটা ওরা করেওছে। ভারত নাকি একটি গণতান্ত্রিক দেশ!” ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপমন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর ডরসির এই বক্তব্যকে 'ডাঁহা মিথ্যা' বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, “কেউ জেলেও যায়নি, টুইটারও ‘বন্ধ’ হয়নি। ডরসিরই নাকি টুইটার শাসনে ভারতীয় আইনের সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে সমস্যা হয়েছিল!

জ্যাক ডরসি জানিয়েছেন, তুরস্ক এবং নাইজেরিয়ার সরকারও আগে কয়েক বছর ধরে তাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে টুইটারের ডানা ছেঁটেছিল। কিন্তু এতদিন পর কেন এমন অভিযোগ তুললেন জ্যাক ডরসি? ডরসির মন্তব্য আবার মোদি সরকারের অধীনে কাজ করা বিদেশি প্রযুক্তি সংস্থাগুলির সমস্যার কথা তুলে ধরছে। উঠে আসছে দেশের বাকস্বাধীনতা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকার কথাও।

মোদি এবং তাঁর সরকারের মন্ত্রীরা প্রচুর পরিমাণে টুইটার ব্যবহার করেন কিন্তু বাকস্বাধীনতা কর্মীরা বলছেন, মোদি সরকার যেকোনও সমালোচনার জন্যই অতিরিক্ত 'সেন্সরশিপ' অবলম্বন করেন। অর্থাৎ সরকারের বিরোধিতা হচ্ছে এমন কোনও সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে কড়া নজর রাখে বিজেপির আইটি সেল। একটি প্রতিবেদন বলছে, ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে টুইটার থেকে পোস্ট সরানোর জন্য মোদি সরকারের আইনি দাবি ৪৮,০০০% বেড়েছে।

ভারত সরকার কিন্তু বলছে, পোস্ট সরিয়ে নেওয়ার আদেশ ব্যবহারকারীদের এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার লক্ষ্যেই করা হয়। কিন্তু ব্রেকিং পয়েন্টের সাক্ষাত্কারে, ডরসি বলছেন, যে অ্যাকাউন্টগুলি সরিয়ে নেওয়ার আদেশ দেয় সরকার তাদের অনেকগুলিই "বিশেষ সাংবাদিকদের যারা সরকারের সমালোচনা করেছিল"।

কৃষকদের বিক্ষোভের বিবরণ আর কৃষক আন্দোলনের জেরে কেন্দ্রের নাস্তানাবুদ হওয়ার কথা চেপে যেতে চেয়েছিল বিজেপি। কয়েক হাজার কৃষক নতুন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লিতে জড়ো হন। সরকারের জন্য স্বাভাবিকভাবেই এই বিক্ষোভ ছিল মাথা ব্যথার কারণ। দেশে মোদি বিরোধিতার, ভিন্নমতের ব্যাপক ঝড় তুলেছিল কৃষক আন্দোলন। সেই সময়, মোদি সরকারের অনুরোধে (যাকে আদেশ নামে ডাকা যায়) বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং বিভিন্ন সংবাদ ওয়েবসাইটগুলি সহ বিক্ষোভের কথা উল্লেখ করা শতাধিক টুইটার অ্যাকাউন্টগুলি বন্ধ করার পরে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে টুইটার বেশিরভাগ অ্যাকাউন্টই ফিরিয়ে আনে। সরকারের অনুরোধে 'ভুল তথ্য' ছড়ানোর অভিযোগে আরও ১,১০০ অ্যাকাউন্ট তুলে নিতেও অস্বীকার করে টুইটার।

জবাবে, ভারত সরকার ভারতের টুইটার কর্মীদের জরিমানা এবং সরকারের দাবি না মানলে সাত বছরের জেলের হুমকি দিয়েছে। পুলিশ অন্য তদন্তের অংশ হিসাবে টুইটারের অফিসগুলিতে হানা দিয়েছে।

আরও পড়ুন- টুইটারের সাজানো বাগান কীভাবে তছনছ করলেন এলন মাস্ক

তবে গত বছর ৪৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে এলন মাস্ক টুইটার কেনার পর থেকে টুইটার এবং ভারত সরকারের মধ্যে বিরোধ কমে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের পরে ভারতই হচ্ছে টুইটারের তৃতীয় বৃহত্তম বাজার কিন্তু এলন মাস্ক দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি ৯০% ভারতীয় টুইটারকর্মীকে ছাঁটাইও করেছেন।

মাস্ক মুখে বলেছেন টুইটার বাকস্বাধীনতার পরাকাষ্ঠা কিন্তু টুইটার ভারত সরকারের এই জাতীয় সব অনুরোধই মেনে নিয়েছে। চন্দ্রশেখর মাস্কের নাম উল্লেখ না করেই বলেছিলেন টুইটার ২০২২ সালের জুন থেকে 'কথামতোই' চলছে। গত জানুয়ারিতেই প্রায় ৫০টি অ্যাকাউন্ট সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই প্রতিটি অ্যাকাউন্ট বিবিসির বিতর্কিত তথ্যচিত্রের একটি লিঙ্ক টুইট করেছিল। ওই তথ্যচিত্রে গুজরাত দাঙ্গায় মোদির ভূমিকার উল্লেখ করেছিল। যাতে দেশের মানুষ মোদির এই গুজরাত দাঙ্গার রূপ না দেখতে পান তাই সরকার সোশ্যাল মিডিয়ায় এটির যে কোনও ক্লিপ শেয়ার করা নিষিদ্ধ করে। এপ্রিল মাসে, সরকারের দাবি মেনেই টুইটার তখন রাজনীতিবিদ, কবি এবং বিবিসি পঞ্জাব ব্যুরোর ১২০ টিরও বেশি অ্যাকাউন্ট ব্লক করে যারা পঞ্জাবের পলাতক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা সম্পর্কে টুইট করেছিলেন।

দ্য ক্যারাভান ম্যাগাজিনের টুইটার প্রোফাইল, অভিনেতা সুশান্ত সিংয়ের প্রোফাইল, কিষাণ একতা মোর্চার সঙ্গে যুক্ত একটি অ্যাকাউন্ট এবং কর্মী হংসরাজ মীনার অ্যাকাউন্ট পুরোপুরি বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। টুইটার প্রাথমিকভাবে তা মেনে চললেও, পরে সমস্ত অ্যাকাউন্ট ফিরিয়ে আনা হয় বাক স্বাধীনতার প্রসঙ্গে ওঠা ক্ষোভের কথা মাথায় রেখেই।

তৎকালীন আইটি সচিব অজয় প্রকাশ সাহনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টুইটারের দু'জন কার্যনির্বাহীর সঙ্গে কথা বলেন। সেই কথোপকথনের পরে সরকারের তরফেই এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, "আদেশের উল্লেখযোগ্য অংশই মেনে চলেছিল টুইটার"। কিন্তু কিষাণ একতা মোর্চা বাদে উপরোক্ত অ্যাকাউন্টগুলি ফের আনব্লক করা হয়েছে।

এপ্রিলে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এলন মাস্ক বলেছিলেন, টুইটার ভারতের কঠোর সোশ্যাল মিডিয়া আইন মেনে চলবে। তথ্য বলছে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে, ভারত বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম সূচকে ১৮০ টি দেশের মধ্যে ১৪০ তম স্থান থেকে ১৬১ তে নেমে এসেছে।

More Articles