টাকার বিনিময়ে আদানি-দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন! মহুয়া বিতর্কে কেন চুপ তৃণমূল?

Mahua Moitra Bribery Case: মহুয়ার বিরুদ্ধে এ হেন গুরুতর অভিযোগ ওঠা ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক শুরু হলেও আশ্চর্যজনক ভাবে মুখ খুলতে দেখা যায়নি তৃণমূলকে।

পুজোর মধ্যেই বিপাকে তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। বরাবরই লোকসভায় বেশ সক্রিয় তৃণমূল কংগ্রেসের বিদূষী এই নেত্রী। বরাবরই নানাবিধ ইস্যু নিয়ে লোকসভায় সরব হতে দেখা যায় তাঁকে। আর এবার সেই লোকসভায় প্রশ্ন করা নিয়েই তাঁর বিরুদ্ধে উঠল গুরুতর অভিযোগ। তিনি নাকি দুবাইয়ের ব্যবসায়ী দর্শন হীরানন্দানির কাছ থেকে অর্থ ও উপহারের বিনিময়েই লোকসভায় প্রশ্ন করেছেন। এমন অভিযোগ তুলে গত রবিবার লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লাকে একখানি চিঠি লিখে বসেন বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। এমনকী তাঁর সাসপেনশনেরও দাবি জানানো হয়। সম্প্রতি মহুয়া গলা তুলেছিলেন আদানি-দুর্নীতির বিরুদ্ধেও। তার জেরেই কি চাপে মহুয়া, উঠেছে প্রশ্ন। এদিকে, এ নিয়ে জলঘোলা শুরু হলেও মুখে কুলুপ তৃণমূলের।

প্রশ্ন করলেই গিলেটিনে চাপানোর যে প্রবণতা বিজেপি সরকারের অভ্যাসে প্রমাণিত হয়েছে, সে কথা অজানিত নয়। তবে এর আগে বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, কবি কিংবা সমাজকর্মী, কখনও কখনও পড়ুয়াদের উপর বর্তাতো এমন অভিযোগ। যে কারণে ভারভারা রাওয়ের মতো কবিকে আর্বান নকশাল তকমা নিয়ে জেলে কাটাতে হয়েছে দীর্ঘদিন। যে কারণে প্রখ্যাত সাহিত্যিক অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে ১৩ বছরের পুরনো মামলা কবর থেকে তুলে আনে দিল্লি পুলিশ। কিংবা যে কারণে নিউজক্লিকের মতো স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে কলুষিত করা হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায়। এ ইতিহাস আজকের নয়। তবে এ বার একই রকম ভাবে মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে সহ-রাজনীতিবিদেরও। এমনটাই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ।

আরও পড়ুন: প্রবীণ সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতাকে বারবার হেনস্থা, কীসের মাশুল?

জানা গিয়েছে, আইনজীবী জয় অনন্ত দেহাদ্রাও মহুয়ার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলেছেন। ইতিমধ্যে আবার তিনি চিঠি দিয়েছেন সিবিআই প্রধানকে। বিজেপি নেতা নিশিকান্ত হোক বা আইনজীবী দেহাদ্রাই দু'জনের মূল দাবি কিন্তু একই। অভিযোগ করা হয়েছে, আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য মহুয়া নাকি দুবাইয়ের ব্যবসায়ী দর্শন হীরানন্দানির থেকে মোটা অর্থ ও উপহার নিয়েছেন। স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে নাম জড়িয়ে গিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহেরও।

নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আদানিগোষ্ঠীর চেয়ারম্যান গৌতম আদানির দোস্তির কথা অজানিত নয় কারওরই। সেই সুযোগে নানাবিধ দুর্নীতিতে ফুলে ফেঁপে উঠেছে আদানি গ্রুপ। নানা রকম ভাবে আদানি গ্রুপকে বিভিন্ন সুবিধা পাইয়ে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে। আর তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই নড়েচড়ে বসেছে বিজেপি সরকার। আদানি-দুর্নীতি নিয়ে যাঁরা যাঁরা সরব হওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের সকলকে নিয়েই টানা হেঁচড়া করা হচ্ছে।

স্বাভাবিক ভাবেই পুজোর মুখে এমন অভিযোগ ওঠায় বেশ অস্বস্তির মুখেই পড়েছেন তৃণমূল সাংসদ। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যেই নিশিকান্ত ও দ্রেহাইয়ের বিরুদ্ধে আইনি চিঠি পাঠিয়েছেন মহুয়া। ওই দু'জনের বিরুদ্ধেই বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তাঁর। কৃষ্ণনগরের সাংসদ জানিয়েছেন, নিশিকান্ত ও দেহ্রাই দুজনেই তাঁর ঘনিষ্ঠ। প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা কুৎসা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তৃণমূলনেত্রীর। ইতিমধ্যেই তাঁদের বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগও দায়ের করেছেন তিনি।

এর মধ্যেই আবার বিতর্ক উস্কে সামনে এসেছে ব্যবসায়ী হীরানন্দানির হলফনামা। যেখানে মহুয়ার বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগই কার্যত মেনে নিয়েছেন তিনি। হীরানন্দানি জানান, মহুয়াকে ব্যবহার করে লোকসভায় আদানি-সম্পর্কিত প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। মহুয়া শিল্পপতিকে সংসদের লগ-ইন আইডি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ তুলেছিলেন নিশিকান্ত। সেই অভিযোগও স্বীকার করে নেন হীরানন্দানি। এমনকী মহুয়ার বিরুদ্ধে নানা উপহার নেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, তাতেও মান্যতা দেওয়া হয়েছে ওই হলফনামায়।

ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন মহুয়া। একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট মহুয়া জানান, 'প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কাছে একটি প্রভাবশালী বন্দুক রয়েছে। দর্শন এবং তাঁর বাবার মাথায় সেই বন্দুক ধরে ২০ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যেই সই করতে বলা হয়েছে ওই চিঠি। তাঁদের সমস্ত ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে।' মহুয়ার অভিযোগ, বিজেপি সরকার যেনতেন প্রকারে আদানি ইস্যুতে তাঁর কথা বলা বন্ধ করতে চাইছে। তাঁর বক্তব্য়, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের এমন কেউ এই হলফনামাটি ড্রাফট করেছেন যিনি পার্ট টাইমে বিজেপির আইটি সেলের ক্রিয়েটিভ রাইটার হিসেবেও কাজ করেন।

মহুয়ার প্রশ্ন, হীরানন্দানির যে বয়ান প্রকাশ্যে এসেছে, তা কি আদৌ তাঁর লেখা? নাকি সেই বয়ানের খসড়া তৈরি করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দফতর (পিএমও) থেকে? নেত্রীর বক্তব্য, হীরানন্দানির ওই ‘হলফনামা’ সাদা কাগজে লেখা হয়েছে। এমনকী তাতে কোনও ‘অফিশিয়াল লেটারহে়ড’ বা ‘নোটারি’ করা নেই। তৃণমূল সাংসদের প্রশ্ন, মাথায় বন্দুক ঠেকানো না হলে কি হীরানন্দানির মতো একজন  শিক্ষিত ব্যবসায়ী কি কখনও এ রকম সাদা কাগজে সই করবেন?

আরও পড়ুন:Hindenburg 2.0: আরও কোণঠাসা আদানি! মোদির ছত্রছায়ায় শেষরক্ষা হবে?

মহুয়ার বিরুদ্ধে এ হেন গুরুতর অভিযোগ ওঠা ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক শুরু হলেও আশ্চর্যজনক ভাবে মুখ খুলতে দেখা যায়নি তৃণমূলকে। তবে কি এর মধ্যেও রয়েছে অন্য সমীকরণ। তেমন সম্ভবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ। আসলে ব্যাপারটা নিয়ে একটু সাবধান ভাবেই পদক্ষেপ ফেলতে চাইছে তৃণমূল। এর আগেও একাধিক বার বিতর্কে জড়িয়েছেন এই তৃণমূল সাংসদ। দেবী কালী নিয়ে বিতর্কের সময়ও বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন মহুয়া। আরও একবার তেমনই বিতর্কে জড়ালেন তৃণমূল সাংসদ। লোকসভা স্পিকার ইতিমধ্যেই মহুয়ার বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছে লোকসভার এথিক্স কমিটিকে। রীতিমতো উচ্চশিক্ষিত মহুয়া। বরাবরই নিজের রাজনৈতিক জীবনেও একটু অন্যরকম ছাপ রেখেছেন তিনি। লোকসভা হোক বা সংবাদমাধ্যমের সামনে, বরাবরই স্পষ্টবাদী মহুয়া। এ হেন একজন সাংসদ সত্যিই কি আদানিকে প্রশ্ন করার জন্য ব্য়বসায়ীর থেকে অর্থ বা উপহার নিয়েছিলেন, নাকি গোটাটাই তাঁকে কলুষিত করার চেষ্টা- প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। নাকি মহুয়ার মতো বিরোধীস্বরের কণ্ঠরোধ করে আদতে বিরোধিতার আঁচটাকেই কমাতে চাইছে মোদিসরকার? সেই প্রশ্নটা ঘুরছেই হাওয়ায়।

 

More Articles