বিজেপি-বিরোধী খবর করার জের! খুনের হুমকি সাংবাদিক তুলসি চন্দুকে

Thulasi Chandu, Telugu Journalist: 'হিন্দুত্ববিরোধী', 'আর্বান নকশাল' 'কমিউনিস্ট' এমন অনেক তকমাই জুটে গিয়েছে কপালে ইতিমধ্যেই। খুনের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয় তাঁকে।

গণতন্ত্রে বিরোধীশূন্যতা ভালো নয়। এমনটাই বলে থাকেন বিশেষজ্ঞেরা। কারণ সেক্ষেত্রে তা আর গণতন্ত্র থাকে না, বরং তা স্বৈরাচার হয়ে যায়। আর বিরোধী থাকা মানে গণতন্ত্রে বাকস্বাধীনতাও থাকতে হবে। অন্তত থাকাটা উচিত। কিন্তু সত্যিই কি তা হয় সবসময়? নাকি বহু ক্ষেত্রেই তা খর্ব হয়। আর বোধহয় তা সবচেয়ে বেশি খর্ব হয় সাংবাদিকদের, যাদের ক্ষেত্রে যেটা থাকাটা একান্ত দরকারি। মানুষের কাছে নিরপেক্ষ খবর পৌঁছে দিতে আজকাল প্রায়শই বেগ পেতে হয় সাংবাদিকদের। নানা রকম অঙ্ক, নানা ছক,খেলা এসে হাত-পা চেপে ধরে। কোথাও প্রতিষ্ঠানের প্রশ্ন, তো কোথাও ব্যক্তিগত টানাপড়েন, তো কোথাও আবার রাষ্ট্রের চোখরাঙানি। শুধু বেগই পেতে হয়, তা-ই নয়। মাঝেমধ্যে গৌরী লঙ্কেশদের মতো অনেকেরই গতি রুদ্ধ করে দেওয়া হয় বরাবরের মতো। কিংবা 'আর্বান নকশাল' তকমা দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় জেলে। বড় বড় দেশে এমন ছোটখাটো ঘটনা আখছার ঘটে।

আজকাল সাংবাদিকতার ধরন অনেকটাই বদলেছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের হাতে উঠে এসেছে প্রযুক্তির বহু অস্ত্র। সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে উঠেছে মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার স্বাধীন মাধ্যম। আপাত ভাবে দেখতে গেলে যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক চোখরাঙানি নেই। কিন্তু সত্যিই কি নেই! হয়তো আছে। সে প্রসঙ্গ অন্য। কিন্তু সত্যি বলতে সোশ্যাল মিডিয়া মানুষকে এমন একটা প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে, যেখানে কারওর মুখাপেক্ষী হয়ে না-থেকে নিজের কথাটুকু পৌঁছনো সম্ভব ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠীর কাছে। আর সেই সুবিধাটুকু নিয়েই বেড়েছে স্বাধীন সাংবাদিকতার সুযোগ। বহু ইউটিউবারই আজকাল এমন স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ বেছে নিয়েছেন। সেটাই তাঁদের পেশা, তাঁদের নেশাও।

আরও পড়ুন: বন্দুকের নলের মুখে অসহায় সাংবাদিক! সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়েছিলেন এই ফুটবলার

তবে ধরাবাঁধা প্রতিষ্ঠানের নাগপাশ নেই বলে যে তারা সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রেও ঠিক ততটাই মুক্ত, তা বললে বোধহয় ভুল হবে। কারণ সেখানেই পথ আটকে দাঁড়ায় নানা ধরনের হুমকি, এমনকী মৃত্যুভয়ও। ঠিক যেমনটা হয়েছে তেলুগু সাংবাদিক তুলসি চন্দুর সঙ্গে। সোশ্যাল মিডিয়া যেমন মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে, তেমনই জন্ম দিয়েছে 'ট্রোল' নামক একটি বিষ শব্দের। সমালোচনা, ব্যঙ্গের উর্ধ্বে উঠে যা ব্যক্তিমানুষকে ঠেলে দিতে বিপন্নতার খাদে। আগে রাস্তার ধারে রকের আড্ডায় বসে যা বলা যেত বা যেত না, তা-ই এখন অবলীলায় বলে ফেলা যায় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে। দেওয়া যায় হুমকি, এমনকী মৃত্যুরও। তিন বছর ধরে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে স্বাধীন সাংবাদিকতা করে আসছেন ৩৬ বছরের তুলসি। নানা কনটেন্টকে কেন্দ্র করে একাধিক বার বিরোধিতার মুখে পড়ছেন। একাধিক বার মুখোমুখি হয়েছেন ট্রোলিংয়েরও । আবার প্রশংসাও পেয়েছেন। এ তার কাজের অঙ্গ। তবে সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে যা হয়েছে, যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশে তা লজ্জার।

সম্প্রতি তিনি তাঁর ইউটিউবে একটি ভিডিও বানান হায়দরাবাদের বাসিন্দা তুলসি। যেখানে তিনি ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছিলেন কীভাবে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও কট্টরপনায় বিজেপি এবং এআইএমআইএম (অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমে) একই পথের পথিক। সেই ভিডিওর টাইটেলটির মর্মার্থ ছিল অনেকটা এরকম- 'প্রিয় জনগণ, সাবধান, ধর্ম আসছে'। সেখানে তিনি এটুকুই বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, দুটি দলই ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন করার চেষ্টা করছে। বলতে চেয়েছিলেন, 'এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে দেশে ধর্মীয় হিংসার চেয়ে ক্ষতিকর আর কিছু নেই।' আর সেটাই কাল হল। কম সময়েই সেই ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়। এবং তার পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ধরনের হুমকি, কটুক্তির মুখোমুখি পড়তে হচ্ছে তুলসিকে। 'হিন্দুত্ববিরোধী', 'আর্বান নকশাল' 'কমিউনিস্ট' এমন অনেক তকমাই জুটে গিয়েছে কপালে ইতিমধ্যেই। এখানেই শেষ নয়, খুনের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয় তাঁকে।

আর এই বিষয়টি নিয়েই সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখ খুলেছেন তুলসি। গত সপ্তাহের একটি ফেসবুক পোস্টে তিনি জানিয়েছেন, রীতিমতো ভয় হচ্ছে তাঁর। তাঁকে খুন করা হতে পারে বলেও আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন তরুণ এই সাংবাদিক। মাতৃভাষায় লেখা ওই পোস্টে তুলসি জানান, কোনওদিন হয়তো ঘৃণা উগরে দিতে অস্ত্র হাতে আমার উপর চড়াও হবেন কয়েকজন নিষ্পাপ তরুণ। যাদের হৃদয় বিষিয়ে দিয়েছেন যুদ্ধবাজ বিভাজনকামী কয়েকটি রাজনৈতিক দল। মৃত্যুভয় অনুভব করছেন তিনি প্রতিপদে। আর এমন অসহায় পরিস্থিতির মুখে তাঁকে পড়তে হয়েছে শুধুমাত্র 'ধর্মীয় হিংসা'-কে 'ভয়ঙ্কর' বলার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায়। তুলসি জানিয়েছেন, ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছেন তিনি। বৃদ্ধা মা, ১২ বছরের সন্তান আর স্বামীর সঙ্গে থাকেন তুলসি। স্বামী সন্তানের থেকে বরাবর সমর্থন পেয়েছেন তিনি। আর আজ পরিবারের সুরক্ষার কথা ভেবে ভয় পাচ্ছেন তিনি। তুলসির বক্তব্য, তারা যে শুধুমাত্র তাঁর ভিডিওর বিরোধিতা বা সমালোচনা করেছে তা-ই নয়, ব্যক্তিগত স্তরে নেমে তুলসিকে আক্রমণ করা হচ্ছে। চলছে এন্তার 'বডিশেমিং'। তাঁকে হিন্দু-বিরোধী বলে প্রচারও চালানো হচ্ছে। এমনকী কেনিয়া থেকে পর্যন্ত হুমকি-ফোন এসেছে।

কোথায় বাকস্বাধীনতা? স্বাভাবিক ভাবেই এই ঘটনা ফের আরও একবার সেই প্রশ্নই আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। এত ভয়, এত আতঙ্কের মধ্যেও নিজের অবস্থান থেকে সরছেন না তুলসি। বরং তাঁর সাফ কথা, হিন্দু ধর্মকে অসম্মান করে কোনও কথা তিনি বলেননি বা কোনও ভিডিও বানাননি। বরং তাঁর ভিডিও সেইসব শিক্ষিত, শুভবোধসম্পন্ন মানুষদের জন্য, যাঁদের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যে বা যাঁরা বলছেন, কেন শুধু হিন্দুদের তিনি নিশানা করেছেন, কেন অন্য ধর্মাবলম্বীদের নয়।? তাঁদের জন্য একই কথা তুলসির।

আরও পড়ুন: বাকস্বাধীনতা শুধুই মুখের কথা! ভারতে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ নিয়ে যে প্রশ্ন উঠে আসছে

তবে সাংবাদিকদের জন্য এই ধরনের বিরোধিতা, হিংসাবাক্য বোধহয় ভারতে নতুন নয়। কখনও খুনের হুমকি তো কখনও বুকে এঁকে দেওয়া বুলেট, কখনও 'দেশদ্রোহী' তকমা তো কখনও জেলের ঘানি। আজ থেকে নয়, বহু বছর ধরে বারবার অবরুদ্ধ করা হয়েছে সাংবাদিকদের পথ, খর্ব করা হয়েছে বাকস্বাধীনতা। সংবাদমাধ্যম বা গণদর্পণের কাজ নিরপেক্ষ ভাবে সমাজের সত্যটুকু জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সেই সত্য এবং তাঁর জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সংবাদমাধ্যম ও সংবাদকর্মীরা। এভাবে তাঁদের সাময়িক ভাবে থামানো যেতে পারে হয়তো। কিন্তু একেবারে মুখ বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয় কোনও মতোই। দীনেশ পাঠক, গৌরী লঙ্কেশ থেকে শুরু করে আজকের তুলসি চন্দু। হাত বদলালেও ব্যাটনটা কিন্তু একই থেকে যাবে।

More Articles